বাংলা কথাসাহিত্যে হরিশংকর জলদাস

720

কৈবর্ত সমাজের সুযোগ্য প্রতিনিধি হরিশংকর জলদাস। শ্রী প্রমথ চৌধুরীর মতো পরিণত বয়সে কলম ধরেন তিনি। গল্প ও উপন্যাস নিয়ে তিনি প্রবেশ করলেন বাংলাসাহিত্যে। প্রবেশের সাথে সাথে দখল করলেন মঞ্চ। বাকপটু হরিশংকর জলদাস তার কথাসাহিত্যে ধীবর সমাজের খুটিনাটি স্বভাবসুলভ বাকবৈদগ্ধে উপস্থাপন করলেন সূক্ষ জীবনবোধের মুন্সিয়ানা। ‘জলপুত্র’ উপন্যাস রচনা করে তিনি সাহিত্যপাড়ায় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। প্রথম উপন্যাসেই জয় করলেন পাঠক হৃদয়। সাহিত্যের কুলীনদের পাশে স্থান পাকাপোক্ত হলো হরিশংকরের।
আধুনিক উপন্যাস বস্তুতান্ত্রিক সাহিত্যেরই সৃষ্টি। উপন্যাস বলতে এমন এক ধরনের সাহিত্য সৃষ্টিকে বোঝায়- যাতে লেখকের জীবন দর্শন ও জীবনানুভূতি কোনো কাহিনি অবলম্বনে, গদ্যভাষায়, বর্ণনাত্মক শিল্পকর্মে রূপায়িত হয়। এর পটভূমি থাকে বিস্তৃত। কাহিনির নাটকীয়তা, বর্ণনার গীতিময়তা, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চরিত্র সৃষ্টির সূক্ষ বাস্তবধর্মিতা, আকর্ষনীয় গল্পরস, সামঞ্জস্যপূর্ণ ঘটনা বিন্যাস, মনোমুগ্ধকর বর্ণনাভঙ্গি, সাবলীল সংলাপ ইত্যাদি একটি সার্থক উপন্যাসে অভিপ্রেত।
জেলে মাঝিদের জীবনযাত্রা নিয়ে বাংলাসাহিত্যে প্রথম উপন্যাস রচনা করেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। তাঁর ‘পদ্মানদীর মাঝি’ একটি জনপ্রিয় ও সার্থক উপন্যাস হিসেবে বাংলা কথাসাহিত্যে সর্বজনস্বীকৃত। পদ্মানদীর জেলে মাঝিদের জীবনযাত্রাকে অত্যন্ত দরদের সাথে চিত্রায়িত করেছেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। সমাজতান্ত্রিক দর্শনে বিশ্বাসী মানিক বন্দোপাধ্যায় পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসে সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বর্গ হিসেবে ময়নাদ্বীপ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এরপর বাংলা কথাসাহিত্যে ধীবর মালোদের জীবন দিয়ে উপস্থিত হলেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ। নদীকেন্দ্রীক উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস নিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলা কথাসাহিত্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন। তিনি নিজে মালো সমাজের লোক হওয়ায় মালোদের জীবন জীবিকা বাস্তব সুষমায় উঠে এসেছে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে। এরপর সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’, সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘গহিন গাঙ’ এবং ঘনশ্যাম চৌধুরীর ‘অবগাহন’ সহ বহু উপন্যাস বাংলা কথাসাহিত্যে রচিত হয়েছে। তৎমধ্যে পদ্মানদীর মাঝি ও তিতাস একটি নদীর নাম বিশিষ্ট। বুদ্ধিমান হরিশংকর জলদাস লক্ষ করলেন- কৈবর্ত সমাজের জীবন কাহিনি নিয়ে নদী কেন্দ্রীক উপন্যাস রচনায় বিশেষ কোনো নতুনত্ব সৃষ্টি হবে না। তিনি পরিণত বয়সের বৈদগ্ধের উপর ভর করে চিন্তা করলেন নদী নয়, সমুদ্র কেন্দ্রীক কৈবর্ত সমাজের সুখ-দুঃখ, বিরহ-মিলনের যাপনলীলা নিয়ে উপস্থিত হবেন বাংলা কথাসাহিত্যে। সমুদ্র কেন্দ্রীক কৈবর্ত সমাজের নিখুঁত করুণ আলেখ্য ‘জলপুত্র’। মানিক বন্দোপাধ্যায় ছিলেন কুলীন সমাজের লোক। মানিক বাবুকে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে পদ্মানদীর মাঝি রচনা করতে। জেলেপাড়ায় একনিষ্টভাবে সময় দিতে হয়েছে তাকে। জেলে মাঝিদের জীবনের সাথে জীবন যোগ করে সাহিত্যের অমর এই উপন্যাস রচনা করতে হয়েছে। অদ্বৈত মল্লবর্মণের অতোশতো ভাবতে হয়নি। তিনি নিজেই ছিলেন মালো তথা জেলে সমাজের সদস্য। একইভাবে হরিশংকর জলদাস জেলেপাড়ায় জন্মে কঠোর সংগ্রাম করে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিএ (সম্মান) এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাসাহিত্যে এমএ ডিগ্রি অর্জন করে সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করে অবসর নিয়েছেন। কবি ময়ুখ চৌধুরীর তত্ত¡াবধানে ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করেছেন। জেলেদের জীবন হরিশংকর জলদাসের মজ্জাগত। সময় যাপনের অংশই ছিলো। নিজে তিনি ভদ্রসমাজে উঠে আসলেও কৈবর্ত সমাজের নিবিড় সান্নিধ্য তার অন্তরে প্রোথিত ছিলো। চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গার জেলেপাড়ায় জন্মগ্রহণকারী হরিশংকর দীর্ঘদিন অন্তরে লালন করেছেন সমুদ্রে মাঝ ধরতে যাওয়া চন্দ্রমণি, তার স্ত্রী ভুবনেশ্বরী, সন্তান গঙ্গাপদ, হরিদাসের পাশাপাশি বকুলি, মঙ্গলী, তীর্থবালা, হারাধন, মাগইন্যা, বিজন বহদ্দার, দীনদয়াল, গৌরাঙ্গসাধু, জয়ন্ত প্রমুখদের। বাংলা উপন্যাসে যখন তিনি কলম ধরেন তখন স্বাভাবিকভাবে জেলে পল্লীর বিচিত্র চরিত্রের মানুষগুলো নিজস্ব স্বভাব ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসহ বাস্তব মূল্যমানে উঠে আসলো হরিশংকরের উপন্যাসে। তার মৌলিক উপন্যাস ‘জলপুত্র’। সমুদ্র কেন্দ্রীক কৈবর্তজনদের জীবনের সাথে এ উপন্যাসে যোগ হয়েছে উপন্যাস শিল্পের তাবৎ বৈশিষ্ট্য।
জলপুত্র উপন্যাসের নায়ক গঙ্গাপদ। তার পিতা চন্দ্রমণি মাছ ধরতে গিয়ে সলিল সমাধির শিকার হয়েছিলো। মা ভুবনেশ্বরী, বৃদ্ধ শ্বশুর ও গঙ্গাকে নিয়ে সংগ্রামী জীবন শুরু করে নতুন করে। জীবনযুদ্ধের পাশাপাশি সে চেয়েছে তার সন্তান গঙ্গাকে যেনো সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে না হয়। গঙ্গা লেখাপড়া করে চাকরি করে উন্নত জীবনে পদার্পণ করুক এমন একটি আশায় বুক বেধেছিলো ভুবন। শেষ পর্যন্ত গঙ্গা ভুবনের সব আশা ধ্বংস করে হাতে তুলে নিলো মাছ ধরার জাল। মা ভুবনেশ্বরীর পরিশ্রম গঙ্গাকে নবম শ্রেণি থেকে আর পড়ালেখায় অগ্রসর হতে দেয়নি। সে একদিকে মায়ের মাছ বিক্রির সাহায্যে এগিয়ে যায়, অন্যদিকে নিজে রোজগার করতে শুরু করে। ভালোই চলছিলো তাদের সংসার। গঙ্গা নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেছে। তার চরিত্রে শিক্ষার প্রভাব পড়েছে। জেলেদের অধিকাংশই পড়ালেখা জানে না। বহদ্দার ও মহাজনদের কাছ থেকে ঠকে প্রতিনিয়ত। গঙ্গা এক্ষেত্রে সচেতন জেলেপুত্র। তার মধ্যে জেলেদের উপর মহাজনদের প্রতারণা, ডাকাতদের অত্যাচার, ভদ্রলোকদের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনা সৃষ্টি হয়েছে। তাই সমুদ্রে ডাকাতদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে সে পুরো জেলেসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছে। শুক্কুর মহাজনের হিসাবের চুরি ধরে দেয়। মাকে হাটে অন্যায় আক্রমণ করলে তথাকথিত ভদ্রলোককে পাল্টা প্রহার করে। গঙ্গার প্রচেষ্টায় উত্তর পতেঙ্গায় জেলে পল্লীর ধীবররা শুক্কুর ও শশি মহাজনের অত্যাচার থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু গঙ্গার উপর শুক্কুর ও শশিভূষন চটে গেলো। তারা জেলেপাড়ার বহদ্দারদের জালের সামনে জাল বসানোর ব্যবস্থা করলো। জেলেরা তা প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নিলো। তার আগের রাতেই শুক্কুর-শশির ষড়যন্ত্রে নিহত হলো গঙ্গাপদ। এমন একটি বিয়োগান্তক ঘটনার মধ্য দিয়ে জলপুত্র উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে।
হরিশংকর জলদাস জলপুত্র উপন্যাসের কাহিনি নাটকীয়ভাবে শুরু করেন। গঙ্গাপদের মা, জেলেপাড়ার চন্দ্রমণির স্ত্রী ভুবনেশ্বরীর উৎকণ্ঠা আর প্রতীক্ষার মধ্য দিয়ে। আগের দিন চন্দ্রমণি ঝড়ের রাতে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিলো। পরদিন বাড়ি ফিরে আসেনি। ‘উথাল-পাতাল বঙ্গোপসাগরের দিকে তাকিয়ে আছে উনিশ বছরের ভুবনেশ্বরী। দু’চোখে ভীতি। সমস্ত মুখে উৎকণ্ঠা। অন্য কোনো দিকে খেয়াল নেই তার। গভীর ব্যাকুলতায় সে আচ্ছন্ন। তার অসহায় চোখ দুটো সাগরের বুকে কী যেন খুঁজে মরছে।’ চন্দ্রমণি আর শেষ পর্যন্ত ফিরে আসেনি। কোনো খবর পাওয়া যায়নি তার। অবশেষে বুড়ো শ্বশুর এবং একমাত্র সন্তান গঙ্গাপদকে নিয়ে জীবিকার জীবন সংগ্রাম শুরু করেছিলো ভুবনেশ্বরীর।
ভুবনেশ্বরী জেলেপাড়ার বউ। স্বামীহারা, বিধবা, সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী। তার ধৈর্য অসাধারণ। মাগইন্যার উৎপাত, ননদী উর্বশীর ছেলেমেয়েদের দৌরাত্ম্য সে হজম করে। ধৈর্যের সাথে শ্বশুরের সেবায় তার ত্রæটি নেই। সন্তানের পড়ালেখার জন্য সে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। তার জীবনে সুখের মুখ দেখেনি। প্রয়োজনে সে রুদ্রমূর্তি ধারণও করতে পারে। শান্ত-শিষ্ট ভুবন অন্যায় দেখে জুনাইপ্যার বাপরে শায়েস্তা করতে দ্বিধা করে না। ঔপন্যাসিক হরিশংকর ভুবনেশ্বরী চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করেছেনÑ ‘বেশির ভাগ নারী যে ধরনের বৈষয়িক স্বামী চায়, চন্দ্রমণি সে রকম ছিল না। একটা সময়ে উচ্ছ¡ল চন্দ্রমণি তার মনে জায়গা করে নিতে পেরেছিলো। একে অন্যের শরীরের সান্নিধ্য লাভের পর উভয়ের মানসিক দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছিলো। নিত্যদিনের অভ্যাসে জড়িয়ে থেকে শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা-যতœ করে, রান্নাবান্না, স্বামীর দেখাশোনা, পরিবারের সকলের অসুখ-বিসুখ, মৃত্যু, ছেলের পড়াশোনা- এসব নিয়ে জীবনের চল্লিশটি বছর কাটিয়ে দিলো ভুবন। ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, কলুষতা- এসব নিয়ে পূঁতিগন্ধময় যে জেলেসমাজ, তার মধ্যেই জীবনটাকে এতদূর টেনে এনেছে সে।’ চরিত্রগুণে সমাজ এবং সমাজের মানুষগুলো তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সবসময়। ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করতে পারেনি, এটা ছিলো জীবনের বড় দুঃখ। অবশেষে তার একমাত্র সন্তান গঙ্গাপদ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কারণে খুন হয়। জনম দুঃখিনী মায়ের একটি দীর্ঘশ্বাস জেলেপাড়ার আকাশ বাতাস ভারি হয়ে থাকে। ভুবন চরিত্রের প্রতি লেখকের দরদ পাঠককে বারবার একটি আদর্শ নারীর কথা মনে করিয়ে দেয়।
শুধু ভুবনেশ্বরী চরিত্র মাত্র নয়, জলপুত্র উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্রের মধ্যে বাস্তব রক্তমাংসের মানব চরিত্রকেই লেখক তুলে ধরেছেন। আমাদের সমাজে বিচিত্র চরিত্রের মানুষের বসবাস। সমাজে ভালো মানুষ, মন্দ মানুষ, লোভীজন যেমন আছে, তেমনি নির্লোভ-ত্যাগী মানুষও আছে। জলপুত্র উপন্যাসের চরিত্রগুলো একটাও টাইপ চরিত্র বলে মনে হয় না। চিরায়ত রক্তমাংসের মানুষই স্বতন্ত্র চরিত্র মহিমায় ধরা দিয়েছে জলপুত্র উপন্যাসে। সকলেই জেলেপাড়ার পরিবেশে বেড়ে ওঠে। ঔপন্যাসিক চাইলে জেলেপাড়ার পাঠশালার মাস্টার দীনদয়ালের চরিত্রটি অন্যভাবে গড়ে তুলতে পারতেন। যা তিনি গৌরাঙ্গ সাধুর চরিত্রে আরোপ করেছেন। সাধু তো সাধুই, রক্তমাংসের মানুষের চেয়ে একটু ভিন্ন রকম। ব্যতিক্রম হয়তো আছে। তা হরিশংকর চিন্তা করেননি। সাধুকে সাধুর জায়গায় ঠিকটাক রেখেছেন। কিন্তু দীনদয়াল চরিত্রে ডেন্ডেরির পরিবেশ সৃষ্টি না করলেও পারতেন। কিন্তু তিনি দীনদয়ালকে মঙ্গলীর সাথে সমাজবিরোধী কাজে জড়িয়ে দিলেন। অথচ তার জন্য যথেষ্ট সম্ভাব্যতা তৈরি করেছেন বলে মনে হয় না। বলরামের ছোট ছেলে হরিলাল দীনদয়ালের পাঠশালায় পড়ে। মঙ্গলী তাকে নিয়ে সেখানে যায়, ছুটি না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকে। দীনদয়ালের মা-বাপের সাথে তার বউ চরণদাসী স›দ্বীপ যাওয়ার পর মঙ্গলীর সাথে দীনদয়ালের প্রেমের বিষয়টিকে আরো পরিবেশসম্মত করা যেতো। হঠাৎ করে মঙ্গলীর শরীরের উপর দীনদয়ালকে তুলে দেয়া আমাদের বাস্তবসম্মত মনে হয়নি। বৃষ্টির পরিবেশে দীনদয়ালের মন ভালো ছিলো না। ‘চরণদাসীর অনুপস্থিতি দীনদয়ালের মনকে আজ বিক্ষিপ্ত করছে বারবার।’ এমন কথার পর- নারায়ণের বউ ছেলের পড়ানোর বকেয়া টাকা বৃষ্টিতে নিয়ে মাস্টারের বাড়িতে এসে দেখলো দরজা বন্ধ। বাহির থেকে বোঝা যাচ্ছে ভেতরে মানুষ আছে। ‘মাস্টর ঘরত আছ না’? বলে দরজা খুলতেই রাধারাণী দেখলো- বিছানো একটা চাটাইয়ে মঙ্গলী চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। শাড়িটা কোমর দিকে তোলা। উদোম বুক। চোখ দুটো আধবোজা। আর দীনদয়াল তার বুকের উপর হামলে পড়ে ঘন ঘন কোমর দোলাচ্ছে। ‘ও মারে! বলে রামনারায়ণের বউটি পড়ি কি মরি করে দাওয়া থেকে উঠানে, উঠান থেকে পথে বেরিয়ে এলো। তার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। চোখে আঁধার আঁধার লাগছে।’ এ অংশটা পড়ে আমার ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ এর গোবিন্দ লালের পিস্তলের গুলিতে রোহিনীর মৃত্যুর কথা মনে পড়ে গেলো। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিধবা বিবাহের বিপক্ষে ছিলো। তাই হয়তো বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষে এমন হঠাৎ অবিশ্বাস্য ঘটনার অবতারণা হতেই পারে। কিন্তু ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাস কলেজ শিক্ষক। অনেক মাস্টারের মাস্টার তিনি। যেই দীনদয়াল জেলেপাড়ায় শিক্ষাবিস্তারে পরিশ্রম করে যাচ্ছে তাকে হঠাৎ মঙ্গলীকে দিয়ে মাস্টারের চৌদ্দগোষ্ঠীর জাত মারা কতটুকু পরিবেশ সম্মত হয়েছে এটাই পাঠক হিসেবে আমার প্রশ্ন। ঔপন্যাসিক কবি নয়, কথাসাহিত্যিক। ঔপন্যাসিকরা ঘটনার চুলছেঁড়া বর্ণনা দেন। পাঠককে কবিতার এক লাইনের সাথে দশ লাইন সৃষ্টি করে ধ্যানমগ্ন হয়ে কবিতা বুঝতে হয়। গল্প-উপন্যাস সে ধরনের সাহিত্য নয়। কবিতার শব্দব্যঞ্জনা উপন্যাসে আরোপ করা যায়, কিন্তু ঔপন্যাসিক চরিত্রের বিশ্লেষণধর্মীতা পরিহার করলে চলে না। দীনদয়াল চরিত্র তৈরিতে হরিশংকর জলদাস প্রথমে খুবই আন্তরিক দেখা যায়। পরে কি কারণে এ চরিত্রটাকে হঠাৎ কালিমাযুক্ত করলেন তা আমাদের বুঝে আসে না।
আমরা জলপুত্র উপন্যাসে দেখলাম- বিজন বহদ্দারের সাথে বকুলবালার অবৈধ দেহলীলা। গোপাল তার বউ গোপালীকে দিয়ে বিজন বহদ্দারের কাছে মাছের টাকা পাঠায়। বিজন বকুলিকে বিশেষ খাতির করে। বিজনের বউ শান্তিবালা সম্পর্কে লেখক বলেন- ‘নামের মতোই শান্ত সে। শরীরে কোনো উত্তাপ নেই। বিছানায় চুপচাপ চিৎ হয়ে শুয়ে থেকে বহদ্দারের প্রয়োজন মেটায়। বছর বছর বাচ্চা বিয়োয়। চোখ কোটরে বসা। স্তন চুপসে গেছে। শান্তিবালাকে দেখলে মনে হয় না, এক সময় তার শরীরে যৌবন ছিলো।’ এমন বউ যার ঘরে তার চোখ বকুলির দিকে যেতেই পারে। যৌবনবতী বকুলীকে মাছের টাকা কম পরিশোধ করলেও কিছু বলে না বিজন। আরো সময়ে অসময়ে কিছু টাকা হাতে গুঁজে দেয়। বলে- ‘তোঁয়াত্তুন এই টিয়া ফেরত দওন পইত্তো নো। শুধু আঁর মিক্কে ইক্কিনি চাইবা।’ লেখক বলেন- ‘এ কথার অর্থ বকুলি বোঝে। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। টাকাগুলো আঁচলের কোনায় বেঁধে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। আসার সময় অর্থপূর্ণ বাঁকা চাহনিতে বহদ্দারকে ছেঁড়াবেড়া করে দেয়। বহদ্দারের বুকের ধুকধুকানি বাড়ে।’ বকুলির মৌন সম্মতি আছে- এ কথা বিজন জানে। উপন্যাসে লেখক তার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছেন। যার কারণে বিত্তশালী বহদ্দার বিজন রাতের আঁধারে গোপালের বাড়ি যায়। পাকঘরের দরজায় মৃদু টোকা দেয়। তখন চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে বকুলি খই-মুড়ি, সীমের বিচি, বুট ভাজতে ভাজতে একসময় আনমনা হয়ে পড়েছিলো বকুলি। হঠাৎ সে খেয়াল করলো রান্নাঘরের দরজায় কে যেনো মৃদু টোকা দিচ্ছে।’
এক পর্যায়ে বিজন বকুলিকে ঝাপটে ধরে পাকঘরের মেঝেতে শুইয়ে দিলো। ‘পাশে মৃদু আলো ছড়াচ্ছিলো। ফুঁ দিয়ে সেটা নিভিয়ে দিলো বকুলি।’ এমন ঘটনার জন্য পাঠক অপ্রস্তুত ছিলো না। তাছাড়া হারাধইন্যা আর তীর্থবালার ঘটনাও স্বাভাবিক। রামহরির মেয়ে তীর্থবালার পরিচয় ঔপন্যাসিক দিয়েছেন এভাবে- ‘মেয়ে তীর্থবালার বয়স পনেরো ছুঁই ছুঁই। কিন্তু বয়সের তুলনায় তার শরীরের গঠন বাড়বাড়ন্ত। মনটা তার একদম চুলোবুলো করে। এক ধরনের খাই খাই ভাব তার শরীরে, চলনে, বলনে। এমন মেয়ে আলাভোলা মা পেলে গোলক বিহারীর গাউর হারাধনের যৌনসঙ্গী হতেই পারে। এজন্য তীর্থবালার মা বাদাইম্যার লগে মেয়ের বিয়ে দিতে হচ্ছে দেখে বলে- ‘বজ্জাতিনির হেঁড়াত যেএন চুলকাইয়ে হেএন বিষ মরক।’ মঙ্গলী যে দীনদয়ালের মতো নিরিহ জেলেপাড়ার কল্যাণকামী মাস্টারের জীবনে অমঙ্গল ডেকে আনলো তার জন্য পাঠক মনোকষ্ট পেয়েছে। এ বিষয়টা ব্যতীত জলপুত্র উপন্যাস শিল্প বিচারের মাপকাঠিতে একটি স্বার্থক উপন্যাস।
উপন্যাসটির ভাষা খুবই ঝরঝরে, কাব্যিক সুষমামÐিত ও হৃদয়গ্রাহী। তার সাথে এ উপন্যাসের পাত্রপাত্রির মুখে আঞ্চলিক তথা চট্টগ্রামী ভাষার কথোপকথন অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত হয়েছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বাংলা উপন্যাসে ব্যবহার করার প্রথম কৃতিত্ব ড. আলাউদ্দিন আল আজাদের। কর্ণফুলী উপন্যাসে প্রথম আলাউদ্দিন আল আজাদ পাত্রপাত্রির কথোপকথনে এ ভাষা ব্যবহার করেন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের বাইরের লোক। চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষকতা করতে এসে কর্ণফুলী উপন্যাস রচনায় হাত দেন। এ উপন্যাসের চট্টগ্রামী আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ করতে ড. আলাউদ্দিন আল আজাদকে অনেক চট্টগ্রামী ভাষাভাষীর স্মরণাপন্ন হতে হয়েছে। হরিশংকর জলদাস চট্টগ্রামের লোক হওয়াতে চট্টগ্রামী ভাষাকে হৃদয়গ্রাহী করে মান ভাষার সাথে অভিজাত করে প্রয়োগ করতে সক্ষম হন। চট্টগ্রামী ভাষা ধীরে ধীরে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছে হারিয়ে যাচ্ছে। হরিশংকর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষাকে উপন্যাসে ব্যবহার করে শুধু উপন্যাসের চরিত্রের বাস্তবতাকে প্রকাশ করেছেন তা নয়- আমাদের চট্টগ্রামী ভাষাকে সফলভাবে কথাসাহিত্যে ব্যবহার করে এ অঞ্চলের ভাষার আঞ্চলিক রূপটাকে সাহিত্যে স্থায়ী প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। জলপুত্র উপন্যাস প্রকাশের পর থেকে অনেকেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার চর্চা করতে শুরু করেছেন সাহিত্য রচনায়।
জলপুত্র উপন্যাসে আলাদা কোনো শাখা কাহিনি নেই। কিন্তু কৈবর্ত জীবনের নৈমিত্তিক যাপনে ছোট ছোট ধর্মীয় বিষয়, সংস্কার, আচার সর্বোপরি জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টার খÐাংশগুলো একই সূত্রে গাঁথা। যার ফলে উপন্যাসটিতে ধীবর সমাজের একটি পরিপূর্ণ পরিচয় ধরা পড়েছে। নদীতে মাছ ধরার চেয়ে সমুদ্রে মাছ ধরার কৌশল ঝুঁকিপূর্ণ ও কঠিন। এখানে ক্ষুধার জ্বালায় জেলে সমাজের পাশাপাশি স্বাভাবিক রিরংসার চিত্রও স্বতঃস্ফূর্ত।
হরিশংকর জলদাস সাহিত্য কর্মের জন্য ড. রশীদ আল ফারুকী সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন সম্মাননা পদক, স্বাধীনতা পদক, ব্র্যাক ব্যাংক সমকাল সাহিত্য পুরস্কার, প্রথম আলো সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। জলপুত্র দিয়ে হরিশংকর জলদাসের সাহিত্যে উত্থান। এরপর দহনকাল, কসবি, মোহনা, রামগোপাল, প্রতিদ্ব›দ্বী, হৃদয়নদী, আমি মৃণালিনী নই, এখন তুমি কেমন আছ, একলব্য ইত্যাদি উপন্যাস এবং ছোটগল্পের বই জলদাসীর গল্প, লুচ্চা, হরকিশোরবাবু, কোন এক চন্দ্রাবতী, মাকাল লতা ইত্যাদি গল্পগ্রন্থও পাঠকের জন্য খুবই সুখপাঠ্য।
হরিশংকর জলদাস নিজেকে অভিজ্ঞতাপুষ্ট করার পর লিখনী ধারণ করাতে কথাসাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশের পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বিশেষ করে গল্প ও উপন্যাসে তিনি বর্তমান সময়ে বিজয়পতাকাবাহী একজন। তার ভাষার চালটা গল্পে ও উপন্যাসে একই রকম। জলপুত্র পাঠ করার পর সকলের মনে হতে পারে তার কৈবর্ত জীবন ভিত্তিক সকল উপন্যাস জলপুত্রেরই সম্প্রসারিত রূপ। তবে কসবি ও আমি মৃণালিনী নই ভিন্নধর্মী। তার গবেষণাও কৈবর্ত জীবন কেন্দ্রিক।
সুতরাং জেলেদের সমুদ্র কেন্দ্রিক জীবন সংগ্রামের শ্রেষ্ঠ রূপকার হরিশংকর জলদাস। তার ভাষা সহজ, সরল, গীতিময় ও ব্যঞ্জনাধর্মী। ভাষার সারল্যে এবং এক ধরনের যাদুকরী গল্প বলার ভঙ্গির মুন্সিয়ানায় তিনি পাঠককে ধরে রাখেন তার রচনায়। যৌনগন্ধী গালি চট্টগ্রামী ভাষার একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য। এ দেশের জেলেসমাজ এতে সবচেয়ে পটু। হরিশংকর তার উপন্যাস ও গল্পে চট্টগ্রামী ভাষার গালিবুলির বিষয়টিকে সফলতার সাথে তার ভাষায় ব্যবহার করতে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। যা পড়ে চট্টগ্রামের পাঠকসমাজ খুবই পুলকিত হয়। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় হরিশংকরের পাত্রপাত্রিদের গালি মিশ্রিত উক্তিসমূহ বেশ উপভোগ্য।