বাংলাদেশে ফুসফুসের অসুখের মূল কারণ কী

29

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের হেলথ বুলেটিন অনুযায়ী, বাংলাদেশে অসংক্রামক ব্যাধিতে যাদের মৃত্যু হয় তার ১০% শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাজনিত কারণে। শিশু মৃত্যুর যে ১০টি প্রধান কারণ রয়েছে তার মধ্যে দুই নম্বরে রয়েছে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা। উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্টজনিত রোগে।
বাংলাদেশ লাঙ ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ডা. আসিফ মুজতবা মাহমুদ বলছেন, বাংলাদেশে ফুসফুসের সবচেয়ে প্রধান রোগ হলো য²া। এছাড়া হাঁপানি, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিস এবং শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণও অনেক বেশি। বায়ু দূষণের কারণে ফুসফুসের সমস্যায় অনেকেই আক্রান্ত হন। এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের য²া বিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন বলছে, যে দেশগুলোতে যক্ষা রোগের হার সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে আক্রান্ত ছয়টি দেশের মধ্যে।
ডা. আসিফ মুজতবা মাহমুদ বলছেন, এই অবস্থান প্রতি বছর মোটামুটি একই জায়গায় থাকে। যুগযুগ ধরে যক্ষার প্রবণতা এত বেশি কারণ, বাংলাদেশ খুব ঘনবসতি। বাংলাদেশে সব জায়গায় এত ভিড় যে শ্বাসপ্রশ্বাসের রোগগুলো হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে একজনের থেকে আর একজনের শরীরে সংক্রমিত হওয়া খুব সহজ। যক্ষায় আক্রান্ত একজন রোগী আরও দশজনকে আক্রান্ত করতে পারে।
যক্ষায় ছয় মাসের চিকিৎসা নিতে হয়। সকল রোগী চিহ্নিত না করতে পারা, চিকিৎসা অসম্পন্ন রাখার কারণে রোগটি রয়ে যায়। আর দারিদ্রের কারণে অনেকে চিকিৎসা নিতে যেতে পারেন না যদিও বাংলাদেশে কম খরচে এর চিকিৎসার যথেষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণের মধ্যে তিনি উল্লেখ করলেন পরিচ্ছন্নতার ধারণার অভাব।
আমাদের দেশে হাঁচি ও কাশির যে এটিকেট- মুখ রুমাল দিয়ে ঢেকে নেয়া, রুমাল তা না থাকলে বাহু দিয়ে মুখ ঢেকে হাঁচি ও কাশি দেয়া- সেই অভ্যাসটা বেশিরভাগের মধ্যেই নেই। এটা ভিড়ের মধ্যে ঘটলে চিন্তা করুন সংক্রমণ কত সহজ।
ঢাকার বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালে রেসপারেটরি মেডিসিনের চিকিৎসক ডা. রওশন আরা খানম বলছেন, আপনি যদি এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের দিকে তাকান দেখবেন বিশেষ করে ঢাকা শহরে বায়ুর মান যত দিন যাচ্ছে খারাপ হচ্ছে। বায়ুতে ধুলো ও ধোয়ার কারণে শহরের আকাশ কেমন ঝাপসা দেখায়। হাঁপানির মতো শ্বাসকষ্ট এখন আমরা অনেক বেশি পাই।
বছরের শেষের দিকে ইটের ভাটার চিমনি শুধু শহরে নয় গ্রামেও দূষণ তৈরি করে। যারা দুষিত বায়ু রয়েছে এমন পরিবেশে নিয়মিত লম্বা সময় কাজ করেন তাদের ফুসফুসে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হবে।
ডা. রওশন আরা খানম বলছেন, ধূমপান ফুসফুসের অনেক বড় শত্রূ। ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিস মেয়েদের মধ্যে অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে ইদানিং। এর একটি কারণ হচ্ছে সরাসরি ধূমপান না করলেও ধুমপায়ীদের আশপাশে যারা থাকেন তাদেরও অনেক ক্ষতি হয়। মেয়েরাও ইদানীং আগের থেকে বেশি ধূমপান করছেন।
২০১৮ সালের গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে অনুযায়ী, বাংলাদেশে চার কোটির বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজ বাড়িতেই পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়।
ডা. আসিফ মুজতবা মাহমুদ বলছেন, করোনার আক্রমণের প্রধান লক্ষবস্তু ফুসফুস। শ্বাসতন্ত্র মানুষের শরীরে তার প্রবেশ পথ এবং করোনা ফুসফুসে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে যায়।
তিনি বলছেন, করোনা ফুসফুসে একটা বড় তান্ডবলীলা করে যায়। কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের একটা বড় অংশের পালমোনারি ফাইব্রোসিস হচ্ছে। রোগটিতে যা ঘটে, ফুসফুসের কোষগুলোতে সে বাসা বাঁধে এবং সেখানেই তার প্রসার ঘটে। করোনা এই কোষগুলোর মারাত্মক ক্ষতি করে যায়।
শুধু করোনাভাইরাসের জন্য নয়, ফুসফুসকে সুস্থ সারা বছরই চেষ্টা থাকা উচিৎ, বলছেন জাতীয় বক্ষব্যাধি ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. কাজী সাইফুদ্দিন বেননুর।
তিনি বলছেন, ফুসফুস সুস্থ রাখতে সবচেয়ে বেশি দরকার নির্মল বায়ু। কিন্তু সেটি পাওয়া যেহেতু খুব সহজ নয় তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ফুসফুস সুস্থ রাখতে তিনি কয়েকটি উপায় বলছেন, ধূমপান যত দ্রুত সম্ভব ত্যাগ করা, ধূমপান শুধু ফুসফুসের ক্ষতি নয়, শরীরের অন্যান্য অঙ্গেরও ক্ষতি করে। ধূমপান ত্যাগ করলে পুরো শরীরের মঙ্গল।
শাকসবজি, ফল ও মাছ বিশেষ করে টক জাতীয় খাবার খাওয়া উচিৎ। লেবু, কমলা, মাল্টা, বাতাবি লেবু, আমড়া, বড়ই এই ধরনের টক জাতিয় ফল ফুসফুসের জন্য উপকারী। ফুসফুসে যে ক্ষয় হয় সেজন্য ভিটামিন-সি, ডি এবং জিঙ্ক যুক্ত খাবার খাওয়া খুব জরুরি।
ডা. কাজী সাইফুদ্দিন বেননুর বলছেন, স্কুলে শরীর চর্চার সময় যেমনটা করতেন তেমনটা দুই হাত আস্তে আস্তে একসাথে মাথার উপরে তুলতে হবে। তোলার সময় মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে হবে। দুই হাত প্রসারিত করে মাথার উপরে তুললে বক্ষ পিঞ্জর প্রসারিত হয়।
এতে বেশি বাতাস প্রবেশ করে। মাথার উপরে হাত কিছুক্ষণ রাখতে হবে। দশ সেকেন্ডের মতো শ্বাস ধরে রাখতে হবে। এরপর হাত নামাতে হবে একই সাথে জোরের সাথে মুখ দিয়ে ধরে রাখা বাতাস ছেড়ে দিতে হবে। এই ব্যায়াম সকাল ও বিকাল ১৫ মিনিট করার পরামর্শ দিচ্ছেন ডা. বেননুর।