বাংলাদেশের রাজনীতির ‘আনস্যাং হিরো’

163


বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে তিনি একজন ‘আনস্যাং হিরো’। মেধা মননে অনন্য একজন পুরদস্তুর ‘আলোকিত মানুষ’। এই ‘মানুষ’ শব্দটির ব্যাপ্তি যতটুকু ঠিক ততটুকু জুড়েই তিনি মহান একজন নেতা। এই লাল সবুজের পতাকার বিশালত্ব মাপতে গেলে, এই স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করতে গেলে যার নাম অধিকবার লেখা হবে তিনি হলেন, তাজউদ্দীন আহমদ। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, মুখে মায়াবী হাসি। অত্যাধিক মোহনীয় শক্তির অধিকারী মানুষটি সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যেতে পারতেন সহজেই। তিনি হয়েছিলেন এই বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তৎকালীন আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের এক নম্বর রাজনৈতিক দলে পরিণত হওয়া ও স্বাধিকার আন্দোলনে সাধারন মান্ষুকে একত্রিত করার পেছনে যে রসায়নটা কাজ করেছিল সেটা হল; জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব, জ্বালাময়ী ভাষণ দেওয়ার ক্ষমতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক ভাবমূর্তির সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমেদের সাংগঠনিক দক্ষতা, পরিশুদ্ধ চিন্তাবোধ ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। আমাদের ছোটবেলায় সার্কাসে দেখা ম্যাজিসিয়ানের হাতে থাকত একটা ছোট্ট জাদুর কাঠি। হরেক রকমের অবাস্তব কাজ হয়ে যেত সেই কাঠির পরশে। জাদু দেখানো শেষ করে তিনি মিলিয়ে যেতেন ধোঁয়ায় সাথে, আবার কখনও হারিয়ে যেতেন পর্দার আড়ালে। এরকম চরিত্রটা হুবহু মিলে যায় বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের সাথে।
ঢাকার অদূরে কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমদ। বাবা মৌলভি মুহাম্মদ ইয়াসিন খান ও মা মেহেরুন্নেসা খানম। চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে তাজউদ্দীন রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেন এক অনন্য উচ্চতায়। বাবার কাছে আরবী শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রজীবনের শুরু করেন রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের সন্তান তাজউদ্দীন আহমদ। অত্যন্ত মিতভাষী, সংযমী, শান্ত স্নেহপরায়ন ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন এক অনন্য গুণাবলীর মানুষ হিসেবে শৈশব-কৈশোরে বেড়ে ওঠেন তাজউদ্দীন আহমদ। শৈশবেই তিনি ছিলেন অত্যান্ত দূরদৃষ্টি স¤পন্ন। বুদ্ধিদীপ্ত মেধার বিকাশ ঘটেছিল তখনই। শিশুকালে এই রাজনীতিক প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন প্রথম স্থান নিয়ে। পুরস্কার পান কলম ও কালির দোয়াত। দ্বিতীয় শ্রেণীতেও প্রথম হন। কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ প্রাইমারি স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মফিজউদ্দীন সাহেব তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে তাজউদ্দীন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে সব শিক্ষকের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘সে হলো গ্রেট স্কলার। সে হলো রত্ন। তার মাঝে আমি বিরাট ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি।’ (সূত্র: স্বকৃত নোমান- তাজউদ্দীন আহমেদ, পৃ: ১৮)। শৈশবে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত মেধার অনন্য এক নজির হল, তিনি নিয়মিত ডায়েরী লিখতেন। প্রতিদিনের ডায়েরীতে তিনি এমন ভাবে খুঁটিনাটি লিখতেন একেবারে সেদিনের ঘটিনার বিস্তারিত বর্ননার সাথে সাথে ঐ দিনের আবহাওয়ার চিত্র পর্যন্ত তুলে ধরতেন। তিনি ভর্তি হন ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাইস্কুলে। তারপর সেন্ট গ্রেগরীজ হাইস্কুলে। ১৯৪২ সালে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল, তাজউদ্দীনের বয়স তখন ১৭। তরুণ তাজউদ্দীন তখন বেসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। অদম্য মেধাবী তাজউদ্দীন প্রত্যক ক্লাসে ফাস্ট বয় ছিলেন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে এমই স্কুলারশিপ পরীক্ষায় তিনি ঢাকা জেলা থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে দ্বাদশ স্থানের অধিকারী হন এবং ১৯৪৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে চতুর্থ স্থান লাভ করেন। বাংলা ইংরেজি লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি পবিত্র কোরআন হাফেজ ছিলেন। তিনি আজীবন স্কাউট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অদম্য মেধাবী তাজউদ্দীন আহমেদ জীবনের সমগ্র পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের সহিত পাশ করেন।
নেতৃত্বর সূচনা ও বিকাশ; তাজউদ্দীন আহমদ স্কুলজীবন থেকে রাজনীতি তথা প্রগতিশীল আন্দোলন ও সমাজসেবার সঙ্গে অত্যান্ত সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৪৩ সাল থেকে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি কলেজে ভর্তি না হয়ে রাজনীতিতে চলে যান। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি, তিন বছর পরে মূলত মায়ের চাপে আইএ পড়া শুরু করেন। সরকারি ঢাকা কলেজেই ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু নিয়মিত ক্লাস করা হয়নি, রাজনৈতিক কাজের প্রতি আগ্রহের কারণে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর থেকে ভাষার অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী যত আন্দোলন হয়েছে, তাজউদ্দন এর প্রতিটিতেই নিজ চিন্তা ও কর্মের সাক্ষর রাখেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) গঠিত হয়। তিনি ছিলেন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তাজউদ্দীন আহমদ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ১৯৪৮ সাল থেকে ভাষার প্রশ্নে যে বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে, তিনি ছিলেন তার সক্রিয় অংশী।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। তাজউদ্দীন ছিলেন এর মূল উদ্যোক্তাদের অন্যতম। নিয়মিত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষা দেওয়া তাঁর ভাগ্যে বড় একটা জোটেনি; তবুও রাজনীতি ও শিক্ষা তার হাতে হাত ধরে চলেছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে অংশ নেওয়ার কারণে তার এমএ পরীক্ষা দেওয়া সম্বব হয়নি। এম এল এ নির্বাচিত হয়েও তিনি আইন বিভাগের ছাত্র হিসেবে নিয়মিত ক্লাস করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে তিনি আইন শাস্ত্রেও
স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পেশায় তিনি ছিলেন একজন আইনজীবী। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশ নেন এবং কারাবরণ করেন। ১৯৬৪ সালে কারাবন্দি অবস্থাতেই এলএলবি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। এর পরের বছরগুলো তাজউদ্দীন আহমদ এবং আওয়ামী লীগের জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৬ সালে তিনি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধীদলীয় সম্মেলনে যোগ দেন। এই সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন। আপন সাংগঠনিক দক্ষতা ও একনিষ্ঠতার গুণে ইতিমধ্যে তিনি বন্ধবন্ধু শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠেন।
বঙ্গবন্ধু যেদিন পূর্ব পকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হন; সেদিনই তাজউদ্দীন হন সাধারণ সম্পাদক। শুরু হয় বাংলার রাজনৈতিক আকাশে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন জুটির ঘনিষ্ঠভাবে পথ চলা। আর এই রাজনৈতিক জুটির ঘনিষ্ঠতা দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর। তাই পকিস্তানের স্বৈরাচারী সামরিক সরকার তখন থেকেই শেখ মুজিবের কাছ থেকে তাজউদ্দীন আহমদকে দূরে সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ পকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাজউদ্দীনকে ভয় পেত। ভয় পেত তাঁর প্রখর মেধা, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি এবং কৌশলকে। তাই তাকে ঢাকা জেল থেকে ময়মনসিংহ জেলে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। কেননা তাজউদ্দীনের মেধা, যোগ্যতা, দূরদর্শিতা ও বিশ্বস্ততার প্রতি শেখ মুজিবের ছিল প্রগাঢ় আস্থা। বস্তুত বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন ছিলেন যেন একে অন্যের পরিপূরক। ছয় দফার প্রচারাভিযানের সময় ১৯৬৬ সালের ৮মে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং গণ-অভ্যুত্থানের ফলে ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মুক্তিলাভ করেন। এরপর ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তাজউদ্দীন আহমদ ওই নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর গণরায় অস্বীকার করে বাঙালিদের অধিকার অর্জনের দাবি নস্যাতে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ১ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আকস্মিকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয় অভ‚তপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন। এই অসহযোগ আন্দোলনে সাংগঠনিক দিকগুলো পরিচালনা ও জনগণের কর্তৃত্বের পরিপ্রকাশক নির্দেশাবলি প্রণয়নে তাজউদ্দীন আহমদ অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা প্রদর্শন করেন। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই পাকিস্তানের সামরিক শাককদের সঙ্গে ঢাকায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আলোচনা শুরু হয়। ১৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া এই আলোচনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজন সহযোগী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ অতুলনীয় বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার পরিচয় দেন।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে ইয়াহিয়ার নির্দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে শুরু করে গণহত্যাযজ্ঞ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিতিতে নেতৃত্বের মূল দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমদের ওপর। এই বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি করে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়, তিনি সর্বসম্মতভাবে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এবং সেদিনই স্বাধীন বাংলা বেতারযোগে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন বিশ্ববাসীকে নবজাত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহব্বান জানান। ১১ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্যে তিনি বিভিন্ন সেক্টরের নাম ঘোষণা করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ এবং প্রস্তাবিত মন্ত্রিসভার বাকি সদস্যদের খুঁজে বের করেন। দেশের মাটিতেই শপথগ্রহণ হবে, এই ছিল তাঁর ইচ্ছা। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। তাজউদ্দীন তাঁর প্রিয় নেতার নামে এই ঐতিহাসিক স্থানটির নতুন নামকরণ করেন ‘মুজিবনগর’ যা ছিল বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী। তিনি বলেছিলেন, ‘যুদ্ধাবস্থায় সরকার যেখানে যাবে সেখানেই রাজধানী স্থানান্তরিত হবে।’ শুরু হয় বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের ইতিহাসের ঐতিহাসিক এই সন্ধিক্ষণে তাজউদ্দীন আহমদের ভ‚মিকা ছিল অবিস্মরণীয়। চরম প্রতিক‚লতার ভেতর দিয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সামরিক, রাজনৈতিক, ক‚টনৈতিক বিষয়াদিসহ সব দিক সংগঠিত করে তোলেন। বাংলাদেশ মাত্র নয় মাসেই মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর ত্যাগ, নিষ্ঠা, দক্ষতা ও স্বদেশপ্রেম সবাইকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। বঙ্গবন্ধুর অর্বতমানে মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্বদানকে তাজউদ্দীন আহমদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে নির্দ্বিধায় অভিহিত করা চলে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়, সেই মন্ত্রিসভায় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। মন্ত্রী হিসেবে আত্মনির্ভর বিকাশমান অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য তিনি বিশেষ সচেষ্ট ছিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ষড়যন্ত্রকারীরা বসে ছিল না। দেশি-বিদেশি চক্রান্ত গোপনে কাজ করে যাচ্ছিলো। চক্রান্তকারীরা এটা ভালো করে বুঝেছিলো বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন একত্রে থাকলে তাদের স্বপ্ন কোন দিন পূরণ হবে না। তাই তারা প্রথমে চেষ্টা করে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে তাজউদ্দীনকে দূরে সরিয়ে দিতে। ষড়যন্ত্রকারীদের এই চেষ্টা সফল হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন চরমপত্রের রচয়িতা ও পাঠকারী এম আর আখতার মুকুলের ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধুর কোমর থেকে শাণিত তরবারি অদৃশ্য হয়ে গেল।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একই দিন সকালে তাজউদ্দীন আহমদকে গৃহবন্দি করা হয় এবং পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগারের সব নিয়ম ভঙ্গ করে বর্বরতার চ‚ড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বন্দি অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় তাজউদ্দীন আহমদ সহ বাংলাদেশের জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের প্রতি অবিচল বিশ্বস্ত ছিলেন বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমেদ। নিজের প্রাণের বিনিময়ে তাজউদ্দীন আহমদ প্রমাণ করেন যে, তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুগত ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমেদকে হুদা সরকার গঠনের অনুরোধ জানালে তাজউদ্দীন আহমেদ জবাবে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে আমি প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্ট হতে চাই না’। আজকের এই বাংলাদেশ হতে পারতো অন্য এক বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাজউদ্দীন আহমেদ বড় আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ আমি যদি মন্ত্রিসভায় থাকতাম, তাহলে কেউ বঙ্গবন্ধুর গায়ের লোম পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারতো না।’
তিনি আরো বলেছিলেন, ‘মুজিব ভাই জেনে যেতে পারলেন না, কারা তাঁর বন্ধু ছিলো আর কারা তাঁর শত্রু ছিলো।’ এই দেশের মানুষ ও বঙ্গবন্ধুর জন্যে আজীবন কস্ট করেছেন তিনি। দিন রাত খেয়ে না খেয়ে পরিশ্রম করেছিলেন। এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, যিনি আজীবন জনগণের কল্যাণ নিয়ে ভেবেছেন, যিনি বাঙালি জাতির জন্য সুখী স্বাধীন জীবন গড়ার সংগ্রামে পরমভাবে নিবেদিত ছিলেন, সেই প্রচারবিমুখ ত্যাগী ও কৃতী দেশপ্রেমিক মানুষটিকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকের দল। এভাবে তাঁর মৃত্যু কেউ কামনা করবে না। ইতিহাসে এমন উদাহরণ আর নেই। বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাঙালি জাতির জন্য তিনি রেখে গেছেন অনন্য নজির, যা তাঁকে চিরকাল স্মরণীয় করে রাখবে। জন্মবার্ষিকীতে কীর্তিমান এই মহান নেতার প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধাঞ্জলি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে বঙ্গতাজ থাকবেন লাল সুর্য হয়ে।
লেখক : প্রাবন্ধিক