বাংলাদেশের পোশাক শিল্পখাতে ট্রেড ইউনিয়ন উৎপত্তির ইতিহাস

59

মোহাম্মদ হামিদুল ইসলাম

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। তখন গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১০০ এর নিচে।
বর্তমানে ২০২০ সালে এসে এ শিল্পের সাথে সরাসরি প্রায় ৪০ লক্ষ এর ঊর্ধ্বে শ্রমিক-কর্মচারী কর্মে নিয়োজিত। তার পাশাপাশি ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ কারখানা, ব্যাংক, বীমা ও ট্রান্সপোর্টসহ প্রায় ১ কোটি শ্রমিক-কর্মচারী এ শিল্পের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। মাত্র ১ লক্ষ ডলার দিয়ে হাটিহাটি পা পা করে শুরু করা এ সেক্টরে বর্তমানে ৩৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
আশির দশকের প্রথম দিকে চট্টগ্রামে তথা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পখাতে প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠায় আজিম গ্রুপের ভূমিকা প্রশংসনীয়। বর্তমানে চট্টগ্রামে প্রায় চার শতাধিক গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে যার মধ্যে ১১০ টি প্রতিষ্ঠানের ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে। জানা মতে, সারা দেশে ৪০০০ এর ঊর্ধ্বে পোশাক শিল্পকারখানা রয়েছে যার মধ্যে ৪০০ টির অধিক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে।
দেশের সিংহভাগ রপ্তানি আয় এ খাত থেকে আসে। এই সেক্টরের উন্নতিকল্পে শ্রমিক-কর্মকর্তাগণ ও কর্তৃপক্ষ সম্মিলিতভাবে সার্বিক ও সুষ্ঠু পরিচালনায় একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পে শ্রমিক ইউনিয়ন ও কর্তৃপক্ষের সম্পর্কের মধ্যে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ছিল হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী, প্রান্তিক কৃষিনির্ভর অর্থনীতির একটি দেশ। পোশাক শিল্পকারখানা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক যুগান্তকারী অধ্যায় সৃষ্টি করে।
শিল্পায়নের মাধ্যমে পোশাকখাতসহ অপরাপর খাত সমূহের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়েছে। নতুন পণ্য সেবা সৃষ্টি গুণগত মান বৃদ্ধি যে কোন ধারণার মাধ্যমেই উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারযোগ্য সম্পদে পরিণত করতে গবেষণা, আবিষ্কার, উন্নতি ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে তা উৎপাদন কাজে প্রয়োগ করা হয়। নতুন নতুন পণ্য ও পদ্ধতি আবিষ্কারের ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বহন করে। শ্রমিক কর্মচারীর সহযোগিতায় উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করে।
দেশের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর শতকরা ৮০ ভাগ নারী। আর এই শিক্ষাবিহীন অর্ধশিক্ষিত জনগোষ্ঠী অত্র শিল্পে যোগদান করার কারণে নারী ক্ষমতায়নের কথা বহির্বিশ্বে প্রচার পাচ্ছে তেমনি নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। পোশাক শিল্পে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরী, বোনাস, উন্নত ও নিরাপদ কাজের পরিবেশ সৃষ্টি এবং পোশাক শিল্পে নিয়োজিত প্রায় ৩০ লক্ষাধিক নারীকে কেবল শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি, তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক পরিচয়ও দিয়েছে। সচ্ছল নারী শ্রমিকগণ তাদের শিশুসন্তানদের বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সুযোগ করে দেওয়ায় দেশে শিক্ষার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে।
পোশাক শিল্পে বিশাল শ্রমিক জনগোষ্ঠী রয়েছে। শ্রমিক জনগোষ্ঠীর শ্রম অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, জীবন জীবিকার নিশ্চয়তা বিধানে শ্রমিক ইউনিয়ন বিশেষ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে।
তৈরী পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণ বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ছাড়াও তৈরি পোশাক শিল্প বিশেষ করে নারী শ্রমিকের জীবনযাত্রার লক্ষণীয় পরিবর্তন সাধন করেছে। শ্রমজীবী নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন পরিবারে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন আনয়নে সক্ষম হয়েছে, আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের কারণেএসব নারী শ্রমিকের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। চাকুরীর সুবাদে শ্রমজীবী নারীরা পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও অংশগ্রহণ করতে পারছে। সমাজে বাল্যবিবাহের সংখ্যা কমেছে, সেই সাথে হ্রাস পেয়েছে জন্মহার।
বাংলাদেশে ২টি শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য সংস্থা বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ সরকারকে সংশ্লিষ্ট নীতিমালা তৈরিতে সহযোগিতা দেয় এবং পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণে গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তৈরী পোশাক শিল্প ইতোমধ্যেই পরিপক্ক তা অর্জন করেছে, এই শিল্প আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে শিশুশ্রম বন্ধ, ন্যূনতম মজুরী নিশ্চিত করাসহ ক্রেতাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজের পরিবেশ উন্নত করেছে।
উল্লেখ্য আইএলও, এ্যালায়েন্স ও একর্ড এর উপদেশ অনুযায়ী বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে স্ট্রাকচারাল সেইফটি, ইলেকট্রিক্যাল সেইফটি ও ফায়ার সেইফটির ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে।
বর্তমানে সারাবিশ্বে “করোনাভাইরাস” মহামারী আকার ধারণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করার জন্য অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রদত্ত স্বাস্থ্য বিধিগুলো পালন করা হচ্ছে যার ফলে এখানকার কারখানাগুলোতে শ্রমিকরা নিরাপদে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সার্বিক সহযোগিতা প্রশংসনীয়।
যেকোন প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি নির্ভর করে শ্রমিক ও কারখানা কর্তৃপক্ষের পারস্পরিক সহযোগিতা, সুসম্পর্ক ও গঠনমূলক কার্যক্রমের উপর। অন্যদিকে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপি যে সকল প্রতিষ্ঠান সফল হয়েছে তা শ্রমিক ও কর্তৃপক্ষের গঠনমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। অন্যথায় কোন প্রতিষ্ঠান তার কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনা করা এবং প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে সৌহার্দ পূর্ণ সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক