বাংলাদেশের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবে সারাবিশ্ব

71

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশকে এমনভাবে গড়ে তুলবো, যেন সারাবিশ্ব বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। বাংলাদেশের মানুষ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। জীবনযাত্রায় স্বচ্ছলতা আসবে।
গতকাল রোববার দুপুরে পতেঙ্গায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের বোরিং (খনন) কার্যক্রম এবং লালখানবাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বে সম্মানজনক অবস্থানে এসেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম টানেল হচ্ছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে। ২০১০ সালে এ টানেল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলাম। টানেল করার জন্য মহিউদ্দিন চৌধুরী আন্দোলন করেছিলেন। টানেল নির্মাণে মহিউদ্দিন চৌধুরীর যুক্তি ছিল সেতু করা হলে নদীতে পলি জমবে। আজ তাকে স্মরণ করছি। মুক্তিযুদ্ধ, আন্দোলন-সংগ্রামে তার যথেষ্ট অবদান রয়েছে।
তিনি বলেন, আমি কাজ করতে চাই দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হবে। এর মাধ্যমে সরাসরি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এক টানে চলে আসতে পারবে। আর তার সঙ্গে সংযুক্ত হবে এই টানেল। কাজেই খুব সহজেই এই টানেল হয়ে একেবারে কক্সবাজার যাওয়া যাবে। এদিকে ঢাকা থেকেও ফোর লেন রাস্তা। কাজেই যোগাযোগটা আরও দ্রুত হবে। আমি মনে করি এটা চট্টগ্রামের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এটা বিরাট অবদান রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, চট্টগ্রামে প্রথম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আওয়ামী লীগ সরকার করে দিয়েছে। আরেকটি কাজ করে দিচ্ছি লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এটি পোর্ট সিটি। ব্যবসা-বাণিজ্য সব কিছু এ জায়গা থেকে হয়। চট্টগ্রামে বিশাল আকারে অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। শহরে যানজট কমানোর জন্য বাইপাস করে দিচ্ছি। টানেল নির্মাণ হলে চট্টগ্রামে যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়ন হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কক্সবাজার যেহেতু পর্যটন শহর। আমরা আলাদা কর্তৃপক্ষ করে দিয়েছি, যাতে পরিকল্পিতভাবে এই পর্যটন শহরটা গড়ে উঠে। তাছাড়া মেরিন ড্রাইভ আমরা সেখানে করে দিয়েছি। ভবিষ্যতে এটাও চিন্তা আছে আমার, যাতে চট্টগ্রাম থেকেই সোজা সমুদ্রের পাড় দিয়ে মেরিন ড্রাইভ করে কক্সবাজার পর্যন্ত সংযুক্ত করা যায়, সেই ব্যবস্থা করবো। মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এটা করতে পারলে সবচেয়ে বেশি কাজের হবে। সেই লক্ষে কাজ করে যেতে আমরা চেষ্টা করবো।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের নতুন ধাপে প্রবেশ করলো। টানেলটি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলাকে শহরাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম শহরকে বাইপাস করে সরাসরি কক্সবাজারের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এতে চট্টগ্রাম শহরের যানজট কমাসহ যাতায়াতের সময়ও অনেকাংশে কমে যাবে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, টানেলের ওপাশে আনোয়ারা থেকে পটিয়া এবং পটিয়া থেকে কক্সবাজার সড়কে সংযোগ সড়ক করে দেব। ১০ কিলোমিটার সড়ক করবো। চারলেনের সড়ক করে দেব। বাইপাস সড়ক করা হয়েছে। সেই বাইপাস সড়কের সাথে সংযুক্ত করে দশ কিলোমিটার সড়ক করে দেব।
জীবনে কোনো কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে দেশের জন্য কাজ করতে এসেছি। আমার বাবা সারাটা জীবন এ দেশের জন্য কষ্ট করেছেন। আমার মাও কষ্ট করেছেন। তারা এদেশের গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। এ দেশের কোনো মানুষ গৃহহারা থাকবে না। প্রতিটি মানুষ শিক্ষা পাবে। এটা বাবা চাইতেন। আমরা রক্ত দিয়ে দেশের স্বাধীনতা এনেছি। আমরা বিজয়ী জাতি। সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচবে এ দেশের মানুষ। দুর্ভিক্ষের দেশ বলে বদনাম ছিল। বিশ্বের বিস্ময় হবে বাংলাদেশ। ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে এ স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মানুষ জানতে পারছে। এ টানেলের মাধ্যমে চট্টগ্রামের গোটা অঞ্চল সমৃদ্ধশালী হবে। জিডিপিতে আরও অনেক অর্জন যোগ হবে। ডাবল ডিজিটে নিয়ে যাবো।
তিনি বলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আমরা প্রতিটি জেলায় শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে চাই। যেসব এলাকায় এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি সেসব এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া, সড়ক উন্নয়নেও সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে ‘অনেক মিথ্যা অপবাদ ও অপপ্রচারের’ শিকার হতে হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, পদ্মাসেতু প্রকল্প নিয়ে বিশ্ব ব্যাংক ও সরকারের টানাপড়েনের সময় নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুস এবং স্বনামধন্য দুই পত্রিকার সম্পাদক ‘মিথ্যা অপপ্রচারে’ লিপ্ত হয়েছিলেন।
দেশের লোক দেশের বদনাম করেছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশের লোক আমাদের বদনাম করে। আমাদের দেশের দুটি স্বনামধন্য পত্রিকার এডিটর প্লাস মালিক তারা, সঙ্গে আপনাদের চট্টগ্রামের সন্তান আছে, যিনি জনগণের টাকা খেয়ে সুদের ব্যবসা করে নোবেল পেয়েছেন। তারা স্টেট ডিপার্টমেন্টে আমাদের বিরুদ্ধে সমানে অপপ্রচার করে।
এ ছাড়া সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের কাছে ইমেইল পাঠিয়ে নানাভাবে যোগাযোগ করে। কাজেই পদ্মা সেতুকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলেন বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে বিশ্ব ব্যাংক চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে পিছু হটেছিল। এ নিয়ে দীর্ঘ টানাপড়েনের পর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের পথে এগিয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী নামে পদ্মাসেতুর নামকরণের প্রস্তাব এলেও কেন তা করেননি, সেই ব্যাখ্যাও এ সময় তিনি দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পদ্মা সেতুর নাম রাখতে চেয়েছিলেন ‘শেখ হাসিনা সেতু’। কিন্তু তিনি তা নাকচ করে দিয়েছেন, কারণ এই সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক ‘মিথ্যা অপবাদ ও অপপ্রচারের’ শিকার হতে হয়েছে।
কর্ণফুলী টানেলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের নতুন ধাপে প্রবেশ করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই দেশের জনগণ সারা বিশ্বে যাতে সম্মান নিয়ে চলতে পারে সেই লক্ষ্যেই সরকার উন্নয়ন কর্মকাÐ করে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ডেল্টা প্ল্যান প্রণয়ন করেছি। ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবো। মুজিব বর্ষ ঘোষণা করেছি। ২০৭১ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষ। আমাদের প্রজন্ম উন্নত, সমৃদ্ধশালী দেশে তা উদযাপন করবে।
সুধী সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। স্বাগত বক্তব্য রাখেন চায়নার রাষ্ট্রদূত জেন জু ও সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, গৃহায়ন ও গণপুর্তমন্ত্রী স ম রেজাউল করিম, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে সচিব সাজ্জাদুল হাসানসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বীর চট্টগ্রাম এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেলের বোরিং কার্যক্রমের উদ্বোধন অনুষ্ঠান। এ স্বপ্নের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এ টানেলের নামকরণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামবাসীর বারে বারে অনুরোধের প্রেক্ষিতে এ নামকরণ।
সেতুমন্ত্রী বলেন, মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ সড়কের চিন্তাভাবনা চলছে। কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভের কাজ শেষ করার পেছনে শেখ হাসিনার অবদান রয়েছে। সড়কটি না হলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে দুর্দশায় পড়তাম। কক্সবাজার দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে বিনোদনের ব্যবস্থা করা হবে। আগামী ঈদের আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তিনটি চার লেনের সেতু দৃশ্যমান হবে। ভবিষ্যতে চট্টগ্রামে মেট্রোরেল করার চিন্তাভাবনা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর।