বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবায় নৈরাজ্য : রোগীদের বিদেশমুখিতা

191

একটি দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের অন্যতম হল সুস্বাস্থ্যের জন্য সুচিকিৎসার নিশ্চয়তা। কারণ সুস্থ দেহ সুস্থ মন দেশ ও জাতির উন্নয়নের অন্যতম উপায়। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এখনও জনগুরুত্বসম্পন্ন প্রতিটি সেক্টরে পরিপূর্ণতা আসেনি। তারই ধারাবাহিকতায় চিকিৎসা সেবায় জনগণের চাহিদার তুলনায় সরকারি, বেসরকারি ভাবে সেবার পরিমাণ অপ্রতুল। দক্ষ চিকিৎসক, পর্যাপ্ত হাসপাতাল, প্রয়োজনীয় ও সূলভ মূল্যে ঔষধ সরবরাহ,ইত্যাদি সংকটে চিকিৎসা সেবা।এদেশের ষোলকোটি মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করণে যে পরিমাণ ডাক্তার , হাসপাতাল ও ঔষধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠা দরকার সে তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। সে সংকটকে পুঁজি করে চিকিৎসা সেবায় এক হযবরল অবস্থা বিরাজ করছে। প্রয়োজনের তুলনায় যে কয়টি সরকারি হাসপাতাল শহরে এবং গ্রামে রয়েছে সেখানথেকে গ্রামাঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে নিযুক্ত সরকারি ডাক্তাররা যেতে চাননা কিংবা গেলেও থাকতে চাননা।কারণ তারা ভাল করে জানেন যে সরকারি মেডিকেলে সরকারি সময় ব্যয় করার চেয়ে বেসরকারি প্রাইভেট ক্লিনিকে সেবা দিলে বেশী লাভবান হওয়া যায়। একারণে অনেক ডাক্তার এম বি বি এস সনদ লাভ করার পর রীতিমত বি সি এস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে চাননা শুধুমাত্র সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করতে হবে বলে। চিকিৎসকদের এহেন চিন্তারকারণে চিকিৎসা পেশায় ব্যাঙের ছাতার মত বেসরকারি হাসপাতাল ও অগণিত ডায়াগনষ্টিক সেন্টার গড়ে তোলার প্রতিযোগিতা চলছে। একই ডাক্তার যিনি সরকারি হসিপাতালে রোগী দেখার সময় রোগীর রোগের বর্ণনা শুনে জটিল রোগী হওয়া সত্তে¡ও ভালভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা না করে দায়সারা চিকিৎসা দেনতিনিই আবার ক্লিনিকে গিয়ে মোটা অংকের টাকার প্রত্যাশায় অত্যন্ত যত্ম সহকারে সময় নিয়ে চিকিৎসা দেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় একজন ডাক্তারের কাছে সরকারি মেডিকেলে নিয়োজিত পেশাগত দায়িত্বের চেয়ে বেসরকারি ক্লিনিকের প্রাইভেট কলের গুরুত্ব বেশী। মানবসেবামূলক পেশায় যেখানে একজন মানবসেবীকে মানবিক গুণাবলীসম্পন্নও সাধারণের সাথে মিলেমিশে সাধারণভাবে কাজ করতে হয়। সেখানে ডাক্তাররা অতিরিক্ত আভিজাত্যের চর্চা করে অমানবিকতার পরিচয় দেয়। দরিদ্র, গ্রামীণ রোগীর প্রতি চিকিৎসকদের নজরদারি, দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ, জনসাধারণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ।সাধারণ মানুষের সক্ষমতা, ক্রয় ক্ষমতা , ও সামর্থ বিবেচনা না করে অতিমাত্রায় চিকিৎসা ফি.ডায়াগনষ্টিক পরীক্ষা , সপ্তাহ পনেরদিন কিংবা একমাস পর আবার আসলে পূনফি.নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। বর্তমানে অনেক ডাক্তার প্রদত্ত ডায়াগনষ্টিক পরীক্ষার রিপোর্ট দেখানো বাবদও ফি. নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কি অমানবিক সিদ্ধান্ত !একজন সাধারণ মানুষ যেখানে দৈনিক ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় করতে পারেননা , সেখানে একজন ডাক্তার দৈনিক (৫০০*৪০)= ২০,০০০/- থেকে ডাক্তারের সুনাম অনুপাতে ৫০,০০০/-টাকা আয়ের জন্য প্রতিযোগিতা করেন। একদিকে চড়া ফি.অন্যদিকে ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে প্রদত্ত ৪০% কমশিন ,তার উপর খ্যাত, অখ্যাত , ঔষধ কোম্পানী গুলোর বিভিন্ন ডাক্তারকে দেওয়া কোম্পানির ঔষধ প্রেসক্রাইভ করার জন্য প্রনোদনা সবমিলিয়ে কোন পরিবারে একজন ডাক্তার জন্ম নিলেই সম্পদের পাহাড় গড়ার উৎস পেয়ে যায়। এ ডাক্তাররা বাড়ীর উপর বাড়ী , গাড়ীর উপর গাড়ী, হাসপাতালের উপর হাসপাতাল, ক্লিনিকের উপর ক্লিনিক প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। তারা একটিবার চিন্তা করেননা যে রোগী কিভাবে তার ফি. টা যোগাড় করছে। অনেক রোগীতো ডাক্তার ফি. ও ডায়াগনস্টিক খরচের ভয়ে চিকিৎসকের কাছেও যেতে চাননা। ডায়াগনস্টিক সেন্টার তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার ডাক্তারদের যে প্রণোদনা দেয় সে টাকাটাও জনগণের পকেট থেকে আদায় করে দেয়। অথচ এ গুলেঅর পরীক্ষার মানের মধ্যে সমস্যা রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় একই পরীক্ষা একেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একেক রকম। মৌলিক ডাক্তারদের এহেন মন মানসিকতা ও রোগীদের অসহায়ত্ব দেখে এলাকায় এলাকায় অনেক ভুয়া ডাক্তারের জন্ম নিচ্ছে যা আমরা পত্রিকান্তরে প্রশাসনের বিভিন্ অভিযানে ধরা পড়তে দেখি। অনেক ডাক্তার তো বেশী রোগী দেখতে গিয়ে তাড়াহুড়া করে স্লিপ লেখেন যা অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য। যা অনেক সময় ফার্মসিস্টরা বুঝেননা । এবিষয়ে প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ডাক্তাররা অসতর্ক। একারণে দেখা যায় একদিকে ভূয়া ডাক্তার, অন্যদিকে অস্পস্ট স্লিপের কারণে ভুল ঔষধ খেয়ে অনেক রোগী অকালে প্রাণ হারান।ডাক্তার চিকিৎসা করেন , প্রেসক্রাইব করেন।কিন্তু রোগ মুক্ত হয় ঔষধে। যে ্ঔষধ খেয়ে মানুষ সুস্থ হয় সে ্ওষধ সেক্টরের অবস্থা আরও ভয়াবহ। ধারাবাকিভাবে মূল্যবৃদ্ধি, ঔষধে ভেজাল, নকল ঔষধ কোম্পানী কর্তৃক এক মূল্য, ফার্মসিস্ট কর্তৃক আরেক মূল্য সব মিলিয়ে সাধারণ জনগণ মহা বিপাকে। ্ঔষধের মধ্যে রয়েছে কিছু রোগ ভিত্তিক প্রয়োজনীয়। কিছু ্ঔষধ আছে নিত্য প্রয়োজনীয়। যেমন অমিপ্রাজল জাতীয় ঔষধ, বিভিন্ন প্রকারের এন্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিকস, ব্লাড প্রেসার সংশ্লিষ্ট ঔষধ। আমাদের দেশে সার্বজনীন রোগ হল গ্যস্ট্রিক, ডায়াবেটিকস, আলসার,ব্লাড প্রেসার, বিভিন্ন প্রকার বাতব্যাধি ও জ্বর। আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করছি যে , বিগত পাঁচ বৎসরে নিত্য প্রয়োজনীয় ঔষধের দাম প্রায় পাঁচ থেকে সাতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৫ বৎসর পূর্বে যেখানে অমিপ্রাজল ২০গ্রাম ঔধের দাম ছিল ২৫ টাকা তার বর্তমান মূল্য হল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। এভাবে সকল প্রকার ঔষধের মূল্য৫ গুণ থেকে ৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নীরবে এভাবে দাম বৃদ্ধির বিষয়টির দিকে সরকারের কোন নজর আছে বলে মনে হয়না। একদিকে দাম বৃদ্ধি অন্যদিকে মানুষের চাহিদাকে পুঁজি করে একশ্রেণীর মানুষরূপি নরপিশাচনকল ও নিম্নমানের ঔষধের ব্যবসায় নেমেছে। এদের ঔষধ গ্রামীণ ও অনুন্নত এলাকার ফার্মেসীর মালিকরা বাজারজাত করণের পাশাপাশি অল্পদামে কিনে প্রকৃত ঔষধের দামে বিক্রি করেন। ক্ষেত্রবিশেষে উন্নত এলাকায়ও নকল ও ভেজাল ঔষধ বিক্রি হয়।আমরা এর সত্যতা প্রশাসনের বিভিন্ন আভিযানে বিভিন্ন ভেজাল ঔষধ, ঔষধ তৈরীর কারখানা আবিস্কার হতে দেখি । এহেন অমানাবিক কর্মকান্ডে জড়িত ব্যবসায়ীরা সরকারি অভিযানের সময় দোকান বন্ধ করে দিয়ে ধর্মঘট ডেকে প্রশাসনের কাজকে বাধাগ্রস্ত করে। অন্যদিকে ফার্মসিস্টরা ক্রেতার গতিবিধি, চাহিদার গুরুত্ব, ও প্রয়োজনীয়তা বুঝে ঔষধের আসল দামের চেয়ে বেশী দাম গ্রহণ করে থাকে। রোগীরা অসহায়ভাবে ফার্মেসী মালিকের চাহিদামত দামেউক্ত ঔষধ কিনতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানীগুলো ঔষধের মান ও জনগণের ক্রয় ক্ষমতার কথা বিবেচনা না করে ডাক্তার ও ফার্মেসী মালিকদের উৎকোচ দেওয়ার ক্ষেত্রে তৎপরতা বেশী দেখা যায়। মেডিকেলে কিংবা ডাক্তারের চেম্বারে ঔষধ কোম্পানীর এম. আরদের ব্যাপকতা রোগীদের প্রয়োজনীয় সময় ক্ষেপণে বিরক্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে। ফলে ডাক্তাররা কোম্পানীগুলোর পক্ষ থেকে পাওয়া প্রণোদনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে বিভিন্ন নামী বেনামী অখ্যাত মানহীন ঔষধ কোম্পানগিুলোর ঔষধ প্রেসক্রাইভ করেন। যে রোগীরা ঔষধ কোম্পানীকে বাঁচিয়ে রাখে তাদের প্রতি কোম্পানীর কোন নজর নেই।অনেক সময় আমরা ফার্মেসীর মধ্যে বর্ধিত মূল্যের পূর্বে কেনা ঔষধ বর্ধিতমূল্যে বিক্রি করে। ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যায সরকারি হাসপাতালের গরীব মানুষের জন্য বিতরণযোগ্য ঔষধ ও ফার্মেসীতে পাওয়া যায়। কিন্তু মেডিকেলে গরীব মানুষরা সরকারি ঔষধ পায়না।
এদেশের সাধরণ মানুষের চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভরসার জায়গা হল সরকারি হাসপাতাল। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা ,নোংড়া পরিবেশ,ময়লা আবর্জনা, দুর্গন্ধময় পরিবেশ দেখে মনে হয়না হাসপাতালের কোন কর্তৃপক্ষ আছে। হাসপাতালে নিযুক্ত কর্মচারীদের রাজকীয় দুর্ব্যবহার, রোগীর সেবকদের প্রবেশে বাধা, প্রতিটি কাজের জন্য চাঁদা দাবী, নার্সদের রাজকীয় চালচলন। নার্সদের ইচ্ছেমত রাউন্ডে আসা সবমিলিযে নার্স ও কর্মচারীদের কাছে রোগীরা টোটালি জিম্মি। রোগীর প্রয়োজনীয় সময়ে তথা মুমূর্ষ অবস্থায ডাক্তার কাছে না পাওয়া সবমিলিয়ে সরকারি হাসপাতালে এক হযবরল অবস্থা বিরাজমান। একটি বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক যদি তার পরিচ্ছন্নতার মান ঠিক রাখতে পারে তাহলে জনগণের টাকায় পরিচালিত সরকারি মেডিকেল কেন পারেনা। কেন সরকারি হাসপাতালের কর্মচারীগুলো মানবসেবী ও জনদরদী মনোভাবের হয়না । এ পরিবেশের কারণে মোটামুটি সামর্থবান মানুষরা হাসপাতালে যায়না । যে কারণে বাংলাদেশের মানুষ ক্লিনিকের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। যারা অর্থনৈতিকভাবে বেশী সামর্থবান তারা এদেশে চিকিৎসার প্রতি আগ্রহী হয়না। তারা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করানোর প্রতি তাদের ঝোঁক বেশী। যার ফলে বাংলাদেশে একদিকে ক্লিনিক ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠছে।অন্যদিকে রোগীদের বিদেশমুখিতায় দেশীয় মুদ্রা বেহাত হয়ে যাচ্ছে। এ ক্লিনিকগুলোতে ধনীরা ভাল সেবা গ্রহণ করতে পারলেও সাধারণ মানুষ সেবা গ্রহণ করতে পারেনা। বাংলাদেশে ক্লিনিক ব্যবসা এত বেশী বৃদ্ধি লাভ রেছে যে রীতিমত রোগী টানার জন্য দালাল শ্রেনী সৃষ্টি করেছে। এ দালালরা বিভিন্ন সরকারি হাসপাতােেল রোগীদেরকে নানান রকম মুখরোচক কথাবার্তা বলে ক্লিনিকে ভর্তি করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে রোগীকে অপারেশন, ডেলিভারী রোগীর সীজার ,আই সি ইঊ, সিসি ইউর নামে রোগীদের থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়। ব্যাঙ্গের ছাতার মত গড়ে উঠা ক্লিনিকগুলোর প্রতিষ্ঠা পূর্ব সময়ে মান যাচাইয়ের কোন কর্তৃপক্ষ আছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। কি অমানবিক আচরণ আমাদের এ পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার। কেন চিকিৎসা পেশায় অতি মুনাফার মনসিকতা থাকবে ? সেবাতো সেবাই তাতে মানুষকে জিম্মিকরণ,অতিমুনাফার মানসিকতা,হয়রানির বিষয় থাকতে পারেনা । মানব সেবায় সেবায় মাদার তেরেসা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমরা কি সামান্য অতি মুনাফার মানসিকতা পরিহার করতে পারিনা।আসুন আমরা সবাই এদেশকে এদেশের মানুষকে ভালবাসি।
লেখক : প্রাবন্ধিক।