বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প এবং বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ

85

শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্র যাত্রা শুরু করে ১৮৯৬ সালে। চলচ্চিত্র শিল্পের বয়স প্রায় সোয়া’শ বছরের। সেকালের বায়োস্কোপ থেকে শুরু করে একালের সিনেপ্লেক্স পর্যন্ত আমাদের সিনেমা পার করেছে প্রায় ৯০ বছর। সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ কে ভিত্তি ধরা হলে, তাও ৬০ বছর পার করেছে দেশের চলচ্চিত্র। সত্তর দশক ছিলো আমাদের চলচ্চিত্রের সোনালী অধ্যায়। জনবহুল বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিশ্বের বিচারে তেমনভাবে বিকশিত হয়নি। প্রথম বিশ্বের তুলনায় আমরা বহুপথ পিছিয়ে আছি। আমাদের বিকাশের গতি বড়ই ধীর। সাথে আছে চলচ্চিত্রকে সামাজিকভাবে গ্রহণের সংকটও। ২০১৯ সালে এসেও আমরা আমাদের সোনালী সময়কে অতিক্রম করতে পারিনি, বরং ধূসর সময়ের আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছি, পিছিয়েছি। পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে এখন।
সম্প্রতি প্রথম আলো পত্রিকায় ছাপানো একটি লেখার কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করতে চাই। কয়েকটি বাক্যেই চমৎকারভাবে উঠে এসেছে দেশের চলচ্চিত্রের সেকাল-একালের অবস্থা। একসময় কী জমজমাটই না ছিল এ দেশের সিনেমা হলগুলো! চিরচেনা ছবিগুলো ছিল হাসি-কান্নার সিকোয়েন্সে ভরপুর।’ দর্শক প্রাণভরে উপভোগ করে তৃপ্তি নিয়ে সিনেমা হল থেকে বেরিয়েছেন। এরপর কয়েকটা দিন ছায়াছবির দৃশ্যগুলো স্মৃতিপটে ভাবনাবিলাসের রিল টেনে যেতো। আনমনে দর্শক বারবার সুর ভাঁজতেন ছবির হৃদয়ছোঁয়া কোনো গানের। কল্পনায় ছবির হৃদয় বা জীবন ঘনিষ্ঠ কোনো চরিত্রের মধ্যে আবিষ্কারের চেষ্টা করতেন নিজেকে। আর এখন? দেশি চলচ্চিত্রের দৈন্য। হাজারো সিনেমা হলের অস্তিত্ব বিলীন হতে হতে এখন শতকের ঘরে বন্দি। হতাশা এখানেই ঝাপটা মেরে ক্ষান্ত নয়। এসব হল বছরজুড়ে সচল রাখার মতো নতুন ছবির আকাল। জবরদস্ত লগ্নি নেই, এক নামে ঘাই মারার মতো পরিচালক নেই, আর নায়ক-নায়িকার আক্রা তো আছেই।
ঢাকাই সিনেমার সেকালের সাফল্য একালের ব্যর্থতা। শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া। ২৭ মে, ২০১৯। প্রথম আলো দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন ব্যবস্থা একটা খারাপ সময় পার করছে। দু-একটা ছবি মাঝে-মধ্যে সিনেমা হলের দৃশ্যপট বদলে দেয়। ভালো ব্যবসাও করে। শুধুমাত্র দু-একটা ছবির ওপর একটা শিল্প তো দাঁড়াতো পারে না।
আমাদের হল নেই, ছবি নেই, ছবিতে গল্প নেই, বাজেট নেই, প্রযুক্তি নেই। দেশের হাজারো সিনেমা হল এখন শপিং সেন্টারে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। কোথাওবা কমিউনিটি সেন্টারে। আমাদের পাশের দেশ ভারতের কোলকাতায় নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্র বলিউডের সিনেমার সাথে টক্কর দিয়ে জাতীয় পুরস্কার পর্যন্ত বাগিয়ে আনছে। সেসব সিনেমায় বাংলাদেশের অভিনেত্রীরা অভিনয় করে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছেন, স্বীকৃতিও পাচ্ছেন। আর আমাদের চলচ্চিত্র তার পথের দিশা হারিয়ে ফেলেছে।
চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন ব্যবস্থা দুটোই সমানতালে কমেছে আমাদের দেশে। ১৭ কোটি মানুষের এদেশে সর্বসাকুল্যে দেড়’শ থেকে পৌনে দু’শ হল বর্তমানে আছে কিনা সন্দেহ। চট্টগ্রাম শহরেও ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ২০-২২টি সিনেমা হল ছিলো। বর্তমানে ২/৩টি হল কোনোরকমে ধুকে ধুকে চলছে। অথচ যখন জনসংখ্যা নয়-দশ কোটি ছিলো তখন আমাদের দেশে ১ হাজার ৩০০ সিনেমা হল ছিলো। যা বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হিসেবে দাপট দেখিয়েছে। তখন গড়পড়তায় ছবি নির্মিত হতো ১০০ থেকে ১১০টি। তখনো কিন্তু হলিউডের ছবি আমদানি হতো।
আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ৪৮ বছর। এই ৪৮ বছর ধরে প্রটেকশনের নামে আমাদের চলচ্চিত্রের শৈশবকে আমরা প্রলম্বিত করেছি মাত্র, সাবালক হতে দেইনি। একজন দর্শকের অধিকার রয়েছে সিনেমা হলে গিয়ে বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন স্বাদের চলচ্চিত্র দেখার। সুদূর আমেরিকার চলচ্চিত্র এ দেশে আসতে পারলে প্রতিবেশী দেশের চলচ্চিত্র কেন আসতে পারবে না? এই নিষেধাজ্ঞা আগে ছিল না। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তৎকালীন সরকার প্রধান আয়ুব খান নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। কিন্তু ২০০৬ সাল থেকে পাকিস্তানেই ভারতীয় চলচ্চিত্র চলছে। ২০০৫ সালে পাকিস্তানে মাত্র ২০টি সিনেমা হল ছিলো। এখন প্রায় দু’শোর অধিক হল আছে। আছে বড় বড় শহরে মাল্টিপ্লেক্স। স্থানীয় চলচ্চিত্র নির্মাণেও এসেছে পরিবর্তন। ভারতীয় চলচ্চিত্র পাকিস্তানি চলচ্চিত্রকে ধ্বংস করতে পারেনি, বরং পরিবর্তনে পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশের চেয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনীতি ও চলচ্চিত্রের জন্য অপেক্ষাকৃত ছোট বাজারের দেশ নেপালেও ১৪০টি সিনেমা হলের মধ্যে ৫৮টি আধুনিক সিনেপ্লেক্স রয়েছে।
বর্তমান বিশ্ব প্রতিযোগিতামূলক। প্রতিযোগিতার সুযোগ না থাকলে প্রতিযোগীর উন্নয়ন ঘটে না। বাংলাদেশ এর বাইরে থাকতে পারে না। আমাদেরও ভালো সিনেমা তৈরি করতে হবে। করতে হবে ভালো মানের সিনেমা হল। পৃথিবীর সব দেশের নির্বাচিত সিনেমা বড় পর্দায় দেখানোর সুযোগ করে দিতে হবে।
বদলে গেছে সময়, পরিবর্তন হয়েছে রীতির। এসেছে রুচিরও পরিবর্তন। সিনেমা শিল্পে প্রযুক্তি এগিয়েছে অনেকদূর। বিশ্বায়নের বিষয়টি চলে এসেছে সামনে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে না পারলে আমরা অনেক পেছনেই পড়ে থাকবো। একবিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়াতেই ডিজিটাল সিনেমা নির্মাণ ও প্রদর্শন উভয় ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য মান নির্ধারণ ও বজায় রাখার লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে ‘ডিজিটাল সিনেমা উদ্যোগ’ বা উঈও (উরমরঃধষ ঈরহবসধ ওহরঃরধঃরাব)।
মূলত ২০০৬ সাল থেকে ২ক এবং ৪ক রেজুলেশন মানসম্পন্ন ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে সিনেমাশিল্প। এতদিনের বহুল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় ফিল্ম ফরম্যাটের বিপরীতে একেবারে নতুন এক ফরম্যাট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণ করার সামর্থ্য ও সক্ষমতা আমাদের অর্জন করতে হবে। এছাড়া এগিয়ে যাওয়ার আর কোন পথ সামনে খোলা নেই।
সিনেমা বাঁচাতে হলে আগে সিনেমা হল বাঁচাতে হবে। হাল আমলে সিনেমা হলে ভালো ছবি চালাতে দরকার ২ক প্রজেকশন মেশিন, ৫.১ বা ৭.১ সিনেমা সাউন্ড সিস্টেম। দরকার ভালো আসন আর ভালো পরিবেশ। তা না হলে মানুষেকে সিনেমা হলে নেয়া যাবে না। ভালো ছবি নির্মাণ করুন কিংবা আমদানি করুন, প্রদর্শন ব্যবস্থা ভালো না হলে সব বিনিয়োগই কার্যত মাঠে মারা যাবে। তাই সবার আগে প্রদর্শন ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি।
২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপনে চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা দেয়া হয়। বলা হয় অন্যান্য শিল্পের মতোই যাবতীয় সুযোগ সুবিধা পাবে চলচ্চিত্র। এখন পর্যন্ত এটি কেবল ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রদর্শনের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের ডিজিটাল প্রজেক্টর, সাউন্ড সিস্টেম, সিলভার স্ক্রিন (বড় পর্দা) ইত্যাদি যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়। আমদানি তালিকায় প্রতিটি ক্যাটাগরির ওপর আলাদা হারে শুল্ক নির্ধারণ করা আছে। এসব পণ্যে শিল্প হিসেবে শুল্ক ছাড় পাওয়ার কথা। কিন্তু শুল্ক বিভাগের তফসিলে পণ্যের হালনাগাদ করা হয়নি। ফলে বিনিয়োগ বোর্ডে প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন সত্তে¡ও সিনেমা হলের যন্ত্রপাতি আমদানি করতে কোন রকমের শিল্পসুবিধা বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং বাণিজ্যিক পণ্য বিবেচনায় উচ্চ হারে শুল্ক দিয়ে সিনেমা যন্ত্রপাতি ছাড় করাতে হচ্ছে।
চলচ্চিত্রের এই সংকটের মুহূর্তে শিল্পের সুবিধা পাওয়াটা খুব জরুরি। কেননা এখন পুরো চলচ্চিত্র শিল্পকে নতুন করে সাজাতে হবে। ছবি নির্মাণ এবং নতুন সিনেপ্লেক্স বানানো এমনকি পুরনো হল সংস্কারে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
চলচ্চিত্রকে সার্বিকভাবে শিল্প হিসেবে দাঁড় করানো না গেলে বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ নেয়া আমাদের পক্ষে কোনভাবে সম্ভব হবে না। সংকটের আবর্তে ঘুরপাক না খেয়ে উত্তরণের জন্য সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শিল্পটাকে বস্তুত কাগুজে করে রাখাটা আমাদের অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। এ শিল্পের সব পক্ষকে একসাথে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেখাতে হবে এখন।
চলচ্চিত্র পড়ারও বিষয়। চলচ্চিত্রশিক্ষার সংকট আমাদের চলচ্চিত্রের একটা বড় দুর্বলতা। সিনেমা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিষয় এখন চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বা ফিল্ম স্টাডিজ। আশার কথা হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন চলচ্চিত্র নিয়ে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বায়নের এই যুগে চলচ্চিত্র নিয়ে ক্যারিয়ার বিস্তৃত হয়েছে অনেক। দেশে-বিদেশে সিনেমার দুনিয়ায় কাজের সুযোগ আছে শিক্ষার্থীদের। প্রাতিষ্ঠানিক ক্যারিয়ার ছাড়াও সৃজনশীল সব ফ্রিল্যান্স কাজের বিশাল সুযোগ মেলে চলচ্চিত্র অধ্যয়নে পড়ার মাধ্যমে। ঢাকার কবিরপুরে যে বঙ্গবন্ধু ফিল্ম সিটি করার পরিকল্পনা সরকারের আছে সেখনে সরকার চাইলে পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটের আদলে চলচ্চিত্রশিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান করতে পারে।
সংগীত, সাহিত্য, চিত্রকলা, আলোকচিত্র, নাট্যকলা-এসব মৌলিক শিল্পমাধ্যমের একটি সমন্বিত রূপ হচ্ছে চলচ্চিত্র। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চাই একটি অসাম্প্রদায়িক ও শৃঙ্খলাপূর্ণ সমাজ গড়তে পারে। সংস্কৃতি প্রদর্শনের পর্যাপ্ত জায়গা রাখতে হবে। নয়তো অপসাংস্কৃতি এসে সেই জায়গা দখল করবে।
কনিষ্ঠতম হয়েও চলচ্চিত্র সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যম। শুধু সময়ের নিরিখে নয়, প্রযুক্তির ব্যবহারে, কলাকুশলতায় এবং বৈচিত্রের গুণে চলচ্চিত্র আধুনিকতম বলেও মানতে হয়। এখন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর বাণিজ্যিক মাধ্যমও চলচ্চিত্র।
১৭ কোটি মানুষের এই দেশে শক্তি ও সম্ভাবনা অফুরন্ত। এই সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে চলচ্চিত্র শিল্পকে জাগিয়ে তোলার কাজটা করতে হবে সম্মিলিতভাবে। সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারলেই আমরা তাল মেলাতে পারবো বিশ্বায়নের সাথে।

লেখক : সম্পাদক, সুপ্রভাত বাংলাদেশ