বাংলাদেশি পাসপোর্টে বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছে রোহিঙ্গারা

161

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছেন ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হয়ে কতিপয় দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে হচ্ছেন বিদেশমুখী। মোটা অংকের টাকা দিয়ে দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গারা ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশি পরিচয়ে। সেসব দেশে তাদের অপকর্মের ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। এভাবে অবৈধ পন্থায় বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তিন রোহিঙ্গা নারীসহ চারজনকে আটক করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা। তারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার পথে আটক হয়। আটককৃতরা হলো মিয়ানমার নাগরিক তথা রোহিঙ্গা আনোয়ার (৩০), রোকেয়া (১৯), মরিজান (২৩) ও আমেনা বেগম (২৬)।
বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে রোহিঙ্গাদের বিদেশে পাড়ি দেয়া ঠেকাতে সরকারের কঠোর নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের বিদেশে আশ্রয় নেয়ার ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আর বিদেশে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশকেই প্রধান রুট হিসেবে বেছে নিচ্ছেন তারা। এদের কেউ কেউ বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ সাগরপথে বিদেশে যাচ্ছেন। মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে রোহিঙ্গা নাগরিকরা সকলেই যে বাংলাদেশে অবস্থানের জন্য আসছেন, তা নয়। অনেকেই আসছেন বিদেশে পাড়ি দেয়ার জন্য। কেননা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দেয়াটা এখন তাদের জন্য অনেক সহজ। এক শ্রেণির দালাল ক্যাম্প থেকে ধর্ণাঢ্য রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট ধরিয়ে দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর সেই পাসপোর্ট নিয়ে চলে যাচ্ছে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের হিসেব অনুযায়ী, ২০০৮-১৮ সাল পর্যন্ত আট বছরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রায় লক্ষাধিক বাংলাদেশি অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন। ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশির সংখ্যা এখন বাড়ছে। এসব বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশকে এখন চাপ দিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তবে বাংলাদেশি পরিচয়ে যারা ইউরোপে গিয়েছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গাও রয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরেই তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। অন্য কোনো দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে আনবে না বাংলাদেশ।
এদিকে প্রতিবছর হজ্ব মৌসুমে বাংলাদেশ থেকে নাগরিকরা হজ্ব করতে যান। আর এই সুযোগে বিদেশে পাড়ি দেন রোহিঙ্গারা। আবার ওমরাহ ভিসায় বাংলাদেশি নাগরিকদের পাশাপাশি রোহিঙ্গারাও বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। রোহিঙ্গারা ওমরাহ হজ্বের নামে সৌদি আরবে পাড়ি জমালেও নাম হয়েছে বাংলাদেশি হিসেবে। কেননা তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি গেছে। হজ্ব শেষে রোহিঙ্গাদের দেশে না ফেরার দায় নিতে হয়েছে সরকারকেও। যে কারণে সৌদি আরব এক সময় ওমরাহ ভিসা বন্ধও করে দেয়।
এদিকে সৌদি আরবে রোহিঙ্গাদের কারণে দুর্ভোগে পড়ার অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশি নাগরিকরা। রোহিঙ্গারা সেখানে বিভিন্ন দুর্নীতি-অনিয়ম ও সামাজিক অনাচারে জড়িয়ে পড়ছেন। আর সৌদি প্রশাসন থেকে ধরা পড়লেই দাবি করছেন তারা বাংলাদেশি। এছাড়া সৌদি সরকার থেকে কাজের অনুমতিপত্রের (আকামা) জন্য রোহিঙ্গাদের প্রতি এখন অনেকটাই সদয়। একজন রোহিঙ্গা নাগরিকের জন্য কোনো কোম্পানি আকামার মেয়াদ যদি চার বছর করে থাকে, বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে সেটা করা হচ্ছে দুই বছর। মুসলিম ও নির্যাতনের শিকার হওয়ায় রোহিঙ্গাদের প্রতি সৌদি আরব বরাবরই আন্তরিক। সৌদি আরবে এখন প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক রয়েছেন। আর এসব রোহিঙ্গার বেশিরভাগই বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহারের মাধ্যমে সে দেশে গেছে।
সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এলাকার মানুষের সঙ্গে রোহিঙ্গা নাগরিকদের চেহারা ও ভাষার অনেকটা মিল রয়েছে। তাই অনেক সময় প্রশাসনের কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা নাগরিকদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেন না। তারা বিভ্রান্তিতে পড়েন। তাই প্রশাসনের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের নাগরিক ধরে নিয়ে রোহিঙ্গাদের চিনতে ভুল করেন। আর সেই সুযোগেই বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে থাকে রোহিঙ্গারা। একই ভুল করেন এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারাও। তারা রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের লোক মনে করে ছেড়ে দেন।
রোহিঙ্গা নাগরিকরা যেন কোনোভাবেই পাসপোর্ট না পায়, সে বিষয়ে সরকারের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের পাসপোর্ট অফিসকে এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। তবে প্রশাসনের কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্তে¡ও রোহিঙ্গারা পেয়ে যাচ্ছেন পাসপোর্ট। কখনওবা দালালদের মাধ্যমে তারা পাসপোর্ট জোগাড় করে পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে।


রোহিঙ্গা ক্যাম্প
কাঁটাতারের বেড়া
নির্মাণ অনিশ্চিত
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ঘিরে নিরাপত্তা বাড়াতে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এছাড়াও মাদকসহ অবৈধ পণ্য পাচার প্রতিরোধে মিয়ানমার সীমান্তেও কাঁটা তারের বেড়া দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণসহ আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় একাধিকবার আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়। তবে কবে নাগাদ এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে তা এখনও অনিশ্চিত। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
সংশ্লিষ্টরা জানান, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দু’টি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (১৪ ও ১৬) গঠন করা জরুরি বলে আইন শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির একটি সভায় মত দেন পুলিশের আইজি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় দায়িত্বরত সব বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর ওপরও জোর দেন অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
এরইমধ্যে এপিবিএন-এর একটি ব্যাটালিয়নের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে যাতায়াত, বাংলাদেশি পাসপোর্ট গ্রহণ এবং মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিয়েও আলোচনা করেন তারা। যে কারণে রোহিঙ্গাদের ওপর নজরদারি বাড়ানো ও কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণের ওপর জোর দেওয়া হয়। আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেনা সদরের নেতৃত্বে পরিচালিত যৌথ টহল কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিষয়েও বৈঠকে একমত পোষণ করা হয়।
ওই আইন শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের অন্যতম সদস্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, রোহিঙ্গাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্প এলাকার চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ জরুরি। রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনের তথ্য পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ডেটাবেজের সঙ্গে সমন্বয় করা হলে অবৈধ উপায়ে পাসপোর্ট গ্রহণ ও প্রতিহত করা সম্ভব হবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার চারপাশে কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক ও আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবু বকর ছিদ্দিক বলেন, রোহিঙ্গাদের গতিবিধি ক্যাম্প এলাকায় সীমিত রাখার জন্য ক্যাম্পের চারপাশে জরুরি ভিত্তিতে কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে। এখন তারা কতদূর এগোতে পেরেছে সেটা জানি না। যদি তারা কোনও কারণে এ ব্যাপারে অপারগ হয়, তাহলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারপাশে কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণের কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও অর্থায়ন করার কথা জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর)। ক্যাম্পের চারপাশে কাঁটা তারের বেড়া দেওয়ার বিষয়েও দ্বিমত রয়েছে সংস্থাটির। তাছাড়া এখনও অর্থের সংস্থানও করতে পারেনি তারা। তাই এ বিষয়ে এখনও কোনও পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি। ইউএনএইচসিআর আরেকটু দায়িত্বশীল হলেই এই প্রকল্পের অর্থ জোগাড় এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও শরণার্থী সেলের প্রধান শাহ্ রেজওয়ান হায়াত বলেন, প্রায় চার মাস আগে এ সেলের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণ সংক্রান্ত কোনও চিঠি এখনও তিনি পাননি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কাজ করে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সেটা সমন্বয় করে থাকে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারপাশে এবং বাংলাদেশের মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কক্সবাজারের রামু’র সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মনজুরুল হাসান খান জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার বিষয়টি তাদের এখতিয়ারে নেই। মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণের বিষয়টি কোন পর্যায়ে আছে সেই বিষয়ে তিনি অবহিত নন। তবে মাদকসহ সবধরনের অবৈধ পণ্য চোরাচালান প্রতিরোধে তারা ওই এলাকায় সার্বক্ষণিক নজরদারি ও অভিযান অব্যাহত রেখেছেন।