বাংলাদেশিদের জন্য লিবিয়া মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছে

33

বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ধীরে ধীরে মৃত্যুপুরী হয়ে উঠছে লিবিয়া। গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির অভ্যন্তরে চলছে ক্ষমতা দখলের লড়াই। সেই লড়াইয়ের বলি হচ্ছে অনেক বাংলাদেশি। একইসঙ্গে মানবপাচারের রুট হিসেবে আলোচিত লিবিয়া থেকে ইউরোপে পাড়ি জমাতে গিয়ে প্রায়ই বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। কোনোভাবেই এই মানবপাচার ঠেকাতে পারছে না বাংলাদেশ সরকার।
লিবিয়ায় গত ২৮ মে মানবপাচারকারীর স্বজনদের হাতে নিহত হয়েছেন ২৬ বাংলাদেশি। একই ঘটনায় আরও ১১ বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। পালিয়ে বেঁচেছেন এক বাংলাদেশি। আহত বাংলাদেশিরা এখন ত্রিপোলির হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
গত বছর ১১ মে লিবিয়া থেকে নৌকাযোগে ইউরোপ পাড়ি দেওয়ার সময় নৌকাডুবিতে ৩৯ বাংলাদেশি নিখোঁজ হন। এর আগেও একাধিকবার লিবিয়া থেকে ইউরোপ যাওয়ার পথে বাংলাদেশি নাগরিকদের মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িত কয়েকজন মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করলেও কাউকেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হয়নি।
এদিকে লিবিয়ার অভ্যন্তরেও প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিপদ কম নয়। ২০১১ সাল থেকে লিবিয়ায় দুইটি প্রশাসন দেশ পরিচালনা করছে। একদিকে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের নেতৃত্বে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল সেরাজ। অপরদিকে জেনারেল খলিফা হাফতারের বিদ্রোহী মিলিশিয়া বাহিনী। দেশটির বিভিন্ন জায়গায় সরকার ও বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে লড়াই চলছে। লিবিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল সরকার ও বিদ্রোহী বাহিনী দখল করে শাসন পরিচালনা করছে। আর তাদের লড়াইয়ের বলি হচ্ছে দেশটির সাধারণ মানুষ। সেইসঙ্গে বাংলাদেশি নাগরিকরাও মৃত্যুবরণ করছেন। গত বছর ১৮ নভেম্বর ত্রিপোলির একটি বিস্কুট কারখানায় বিমান হামলায় ৭ বেসামরিক নাগরিকের সঙ্গে এক বাংলাদেশি নিহত হন।
দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপে মানবপাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে লিবিয়া। বিশেষ করে আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলো থেকে মানবপাচারকারীরা নানা পথে লিবিয়ায় লোক এনে তাদের নৌকাযোগে ইতালি পাঠিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের মানবপাচারকারীরাও নানা পথে লোক লিবিয়ায় নিয়ে সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পাঠান। তবে লিবিয়ায় গিয়ে বেশির ভাগ লোককে জিম্মি করা হয়। জিম্মি করে তাদের পরিবারের কাছ থেকে দফায় দফায় অর্থ আদায় করা হয়। অর্থ আদায়ের পর নৌকাযোগে ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করে মানবপাচারকারীরা। নৌকায় পাড়ি দিতে গিয়ে কখনো কখনো ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধিও ঘটে।
বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি করে অর্থ আদায়ের ঘটনা এর আগেও বহুবার ঘটেছে। গত ২৮ মে যে ৩৮ জন বাংলাদেশি নাগরিককে জিম্মি করা হয়, তার মধ্যে আফ্রিকার কিছু নাগরিকও ছিলেন। জিম্মি হওয়া আফ্রিকার নাগরিকরা লিবিয়ার স্থানীয় মানবপাচারকারীকে হত্যা করেন। আর এই হত্যার প্রতিশোধ নিতেই লিবিয়ার স্থানীয় মানবপাচারকারীদের স্বজনরা গুলি করে হত্যা করে ৩০ জনকে। এর মধ্যে বাংলাদেশি ২৬ জন, আর আফ্রিকার ৪ জন।
লিবিয়ায় মানবপাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে প্রবেশে বেশ কয়েকবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও মানবপাচারকারীরা বিভিন্ন রুট দিয়ে লিবিয়ায় লোক নিয়ে চলেছে। আর সেখানে নিয়ে গিয়ে জিম্মি করে দেশের স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও ঘটছে। নির্যাতনের কারণেও মৃত্যু হয়ে থাকে অনেকের। এছাড়া গৃহযুদ্ধ কবলিত লিবিয়ায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই নাজুক। সব মিলিয়ে মৃত্যুপুরী হয়ে উঠছে লিবিয়া।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, আমাদের দেশের পাচারকারীরা লিবিয়ায় লোক নেওয়ার জন্য অনেক টাকা নেন। তাদের সেখানে নিয়ে গিয়ে জিম্মি করে আরও টাকা আদায়ের চেষ্টা করা হয়। লিবিয়ায় নিহত ২৬ বাংলাদেশির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। আমাদের দেশের যুবকরা যেন বাইরে গিয়ে এই ধরনের ঘটনার শিকার না হন, সেই বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। এর আগে যখন লিবিয়ায় নৌকাডুবিতে বাংলাদেশিরা মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তখন সেই ঘটনায় জড়িত পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। পাচারকারীরা যদি সক্রিয় থাকে এই ধরনের ঘটনা আরও ঘটতে পারে। তবে আমাদের ভয়, পাচারকারীরা এখনো সক্রিয় রয়েছে। খবর বাংলানিউজের