বাংলাদেশকে পথ দেখাচ্ছে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগ

119

চট্টগ্রাম একটি মডেল সিটি। চট্টগ্রাম থেকে অনেকের অনেক কিছু শেখার আছে। এক সময় চট্টগ্রাম নিখিল ভারতকে পথ দেখিয়েছে। সেই সময় মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, Chittagong to the Fore. আর এক সময় চট্টগ্রাম অবিভক্ত বাংলাকে পথ দেখিয়েছে। সেই সময় মনীষী গোখলে বলেছিলেন, What Bengal thinks today, India thinks tomorrow. আর একটু এগিয়ে বলা যায়-What Chittagong thinks today, Bangladesh thinks tomorrow. ’৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন শুরু করে চট্টগ্রাম বাংলাদেশকে সেই দেখিয়েছে ’৭১ সালে সবার আগে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ করেও পথ দেখিয়েছিলো চট্টগ্রাম।
এখনো পথ দেখাচ্ছে চট্টগ্রাম। মহানগর আওয়ামী লীগের কথা ভেবেই একথা বলছি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগেরই প্রায় সমকালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি মাহতাবউদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সিটি মেয়র আ জ ম নাছিরের সুদক্ষ পরিচালনায় নগর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা যেভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন এবং নগরীর আওতাভুক্ত সকল সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সমস্ত দলীয় প্রার্থীকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করতে সক্ষম হয়েছেন, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
কারণ বড় সব দলের মতোই মহানগর আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও নানা মত-পথের বিরোধ রয়েছে। বিরোধ যে সবসময় দলের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়, বিভিন্ন সময়ে তা’ বিভিন্ন উপলক্ষে প্রকাশ্য রূপ পরিগ্রহ করে। বিরোধ থেকে গ্রুপ-উপগ্রুপ সৃষ্টি হয়েছিলো। এইসব গ্রুপ উপদলের মধ্যে কত মারামারি, খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে। এসব দলাদলি, মারামারি, কোন্দল সামাল দিয়ে দল চালাতেন এম এ মান্নান ও মহিউদ্দিন চৌধুরী। এম এ মান্নান অনেক আগেই গত হন। মহিউদ্দিন চৌধুরীও সম্প্রতি পরলোকগমন করলে বিশৃঙ্খল দলটাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার গুরুদায়িত্ব পড়ে যায় মাহতাব-নাছিরের কাঁধে। উপদলীয় কোন্দলে লিপ্ত কর্মীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ, অসন্তোষ প্রশমিত করে দলীয় নেতা-কর্মীদের রাজনীতিমুখী করে গড়ে তুলে দলের কাজে লাগানোর কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন তাঁরা এবং সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাঁরা যে সম্পূর্ণরূপে সফল হয়েছেন তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
নাছির নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক; মাহতাব ছিলেন সিনিয়র সহ-সভাপতি, সভাপতি মহিউদ্দিনের মৃত্যুতে তাঁকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে পূর্ণাঙ্গ সভাপতির দায়িত্বও দেওয়া হয় তাঁকে। মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী নগর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরীর দ্বিতীয় পুত্র। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্রলীগ করতেন। স্বাধীনতার পর দু’বার ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে জহুর আহমদ চৌধুরীর কোরবানী সর্বাধিক। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী ’৭১-এর ১৩ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে শাহাদাত বরণ করেন। সাইফুদ্দিন চট্টগ্রাম শহরের বিশিষ্ট ছাত্রনেতা এবং সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের এজিএস ছিলেন।
শহর আওয়ামী লীগের রাজনীতি বহু বছর ধরে জহুর আহমদ চৌধুরীর দামপাড়া পল্টন রোডের বাড়িকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। আজও শহরের আওয়ামী রাজনীতির তীর্থভ‚মি বা প্রাণকেন্দ্র জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসভবন। তাঁর এই বাসভবনটি একটি ঐতিহাসিক বাড়ি এবং এটিকে স্বাধীনতার আঁতুরঘর বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। বঙ্গবন্ধু ’৭১-এর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এই বাসভবনের টেলিফোনেই তা’ চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে প্রেরণ করেছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে এই তথ্য অজানা ছিলো না। তাই তারা ক্র্যাকডাউনের পর চট্টগ্রাম দখল করে প্রথম সুযোগেই জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসভবনটি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে বিরান করে দিয়ে তাদের রাগ ও প্রতিহিংসা মিটিয়েছিলো।
শহর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছাড়াও জহুর আহমদ চৌধুরী ’৪৯ সাল থেকে ’৭১ সাল পর্যন্ত সমস্ত আন্দোলন-সংগ্রামের তিনিই ছিলেন মধ্যমণি; তাঁর নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় পঞ্চাশের দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ষাটের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। তিনি সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন, একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনার জন্য গঠিত জেলা সংগ্রাম কমিটির আহব্বায়ক, সর্বপ্রথম ভারতে গমনকারী রাজনৈতিক নেতা, মুক্তিযুদ্ধে পূর্বাঞ্চলীয় লিবারেশন কাউন্সিলের সভাপতি এবং স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে প্রবাদপুরুষ এবং জীবিতকালেই কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি একটি ইনস্টিটিউশনে পরিণত হয়েছিলেন। জহুর আহমদ চৌধুরীর বিপুল প্রভাব ও জনপ্রিয়তা মাহতাবকে সকলের কাছে সম্মানের পাত্র ও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। তাঁর সেক্রেটারি আ জ ম নাছিরও তাঁকে সম্মান করেন।
আন্দরকিল্লার ঐতিহ্যবাহী মোহাদ্দেস পরিবারের কৃতী সন্তান আ জ ম নাছির উদ্দিন তো ছাত্র জীবন থেকেই নেতা। তিনি শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হিসেবে চট্টগ্রামের শীর্ষ ছাত্রনেতা হিসেবে ছাত্র সমাজের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। তিনিই একমাত্র আওয়ামী লীগ নেতা, যিনি একসঙ্গে রাজনীতি, সমাজসেবা, ক্রীড়া, ব্যবসায়িক কর্মে প্রবৃত্ত হয়ে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনি যখন যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানে সাফল্যের বরমাল্য গলায় তুলে নিয়েছেন। এই সময় চট্টগ্রামে নাছিরের চেয়ে সাফল্যের বরপুত্র আর কেউ নেই। নাছিরকে দেখলে আমার কেবলই মনে হয় পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে শহরের বুকে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন একজন রাজকুমার-তাঁর নাম আ জ ম নাছির উদ্দিন।
জনাব নাছির চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক, ব্রাদার্স ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক, কদম মোবারক মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী হাই স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং সুগন্ধা আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির নির্বাচিত সভাপতি। এ সমস্ত কারণে নাছিরও এখন চট্টগ্রামের রাজনীতি, ক্রীড়া ও সামাজিক অঙ্গনের একজন মান্য ও সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব; যাঁকে নিয়ে তাঁর দলের নেতাকর্মীরা গর্ববোধ করতেই পারেন।
মাহতাব ভাই ও নাছির ভাই তাই কঠিন সময়ে মহানগর আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করেও সে দায়িত্ব পালনে অসম্ভব সফল ও সার্থক। দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে হানাহানি, বিভেদ ঘুছিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ সত্তায় পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন। কিছুদিন আগেও যে দলের নেতাকর্মীদের মহিউদ্দিন গ্রুপ, নাছির গ্রুপে বিভক্ত হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, রাস্তাঘাটে মারামারি করতে দেখা যেত, তারা এখন সেসব ভুলে মাহতাব ও নাছির ভাইয়ের পেছনে কাতারবন্দী হয়েছেন। সেজন্য আমি বলেছি, মাহতাব-নাছিরের নেতৃত্বে নগর আওয়ামী লীগ এখন সমগ্র দেশকে পথ দেখাচ্ছে। এক্ষেত্রে সমগ্র দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও যুবলীগ কর্মীদের যেভাবে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা যায়, তাদের যে বিরোধ অবসানে চট্টগ্রামকে অনুসরণ করতে পারে।
পাদটীকা : চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ বহু পুরোনো সংগঠন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রায় একই সময়ে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। নগরও নয়, তখন বলা হতো সিটি আওয়ামী লীগ; সিটি পরে শহর হয়, শহর থেকে নগর এবং বর্তমানে মহানগর আওয়ামী লীগ। সংগঠন যেমন পুরোনো, গ্রুপিংও তেমনি আরো পুরোনো। যাত্রারম্ভ থেকেই দলাদলির সূত্রপাত বললেও অত্যুক্তি হবে না। প্রথম দিকে ছিলো সিটি-ডিস্ট্রিক্ট গ্রুপিং। সিটির নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী, ডিস্ট্রিক্টের নেতা এম এ আজিজ। দু’জনকে কেন্দ্র করে দু’টি গ্রুপ।
সময় যত এগিয়েছে, সংগঠন তত বড় হয়েছে। সংগঠন বড় হওয়ার সাথে সাথে নেতা-কর্মীর সংখ্যাও বেড়েছে। ক্রমে গ্রুপিংও বিস্তৃত হয়েছে। আরো নেতার নামে গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে, প্রত্যেক গ্রুপের আলাদা আলাদা সমর্থক গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে। আশির দশকে এসে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে নতুন করে গ্রুপিং সৃষ্টি হয়। প্রথমে মহিউদ্দিন বনাম আখতারুজ্জামান চৌধুরী, তারপর মোশাররফ বনাম আখতারুজ্জামান চৌধুরী, আরো পরে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বনাম জাফর-সুলতান-ইদ্রিস বি.কম-ফয়েজ, আবার মহিউদ্দিন বনাম মোশাররফ, মান্নান বনাম মহিউদ্দিন, মহিউদ্দিন বনাম আ জ ম নাছির- এমনিভাবে নানা সময়ে গ্রুপিং-এর কবলে পড়ে আওয়ামী লীগের শক্তিক্ষয় হয়েছে। সেই অবস্থা থেকে নগর আওয়ামী লীগকে গ্রুপিং-মুক্ত করেছেন বর্তমান নেতৃত্ব। এটা সম্ভব হয়েছে একমাত্র মাহতাব-নাছিরের চমৎকার সমঝোতা ও বোঝাপড়ার কারণে। মাহতাবকে সহজেই মেনে নিয়েছেন নাছির, আর মাহতাবও নাছিরের যোগ্যতাকে উপযুক্ত সম্মান দিয়ে তাঁকে দল পরিচালনায় সুযোগ দিচ্ছেন। মাহতাব নাছিরকে একান্ত ছোট ভাই হিসেবেই দেখেন।

লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক