বহুমুখী প্রতিভা ও গুণের ধারক নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী (র.)

79

“দা-দে হক্বরা কাবলিয়াত শর্ত নীস্ত।” অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা কাউকে কোন বিশেষ নি’মাত দ্বারা ধন্য করতে চাইলে তজ্জন্য তার মধ্যে আগে থেকে সেটার যোগ্যতা থাকা পূর্বশর্ত নয়; বরং আল্লাহ তা’আলা যখনই ইচ্ছা করেন, কারো মধ্যে অসাধারণ ও অসংখ্য যোগ্যতা ও মর্যাদা দান করতে পারেন। যেমন কারো মধ্যে পুথিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চতর ডিগ্রী না থাকলেও তাকে আল্লাহ তা’আলা সরাসরি গভীর জ্ঞান দান করতে পারেন; তিনি যখনই চান কোন বিত্তহীনকে বিত্তবান বানাতে পারেন; তিনি চাইলে একজন সাধারণ নাগরিককে অগণিত নাগরিকের অতি মর্যাদাবান নেতা বা কর্ণধারের আসনে আসীন করতে পারেন; তিনি ইচ্ছা করলে কোন সাদাসিধে মুসলমানকে কোন কামিল-মুকাম্মিল বুযুর্গের সান্নিধ্য ও তাঁর কৃপাদৃষ্টিতে পৌঁছিয়ে ধর্মীয় ক্ষেত্রে অকল্পনীয় উচ্চ মর্যাদায় আসীন করতে পারেন। আল্লাহ তা’আলা ইচ্ছা করলে কোন মা’মুলী বিত্তের ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিকে অগাধ সম্পদের অধিকারী করে দ্বীন, মাযহাব ও দুঃস্থ-মানবতার সেবায় অকাতরে দান করিয়ে ‘আস্সাখিয়ু হাবীবুল্লাহ্’ (দানশীল ব্যক্তি আল্লাহ্র বন্ধু)’র আসনে বসিয়ে দিতে পারেন এবং তাঁর ইচ্ছায়, কেউ তার এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে অগণিত সাদক্বাহ্-ই জারিয়া ও বহুমুখী অবদান রাখার সুযোগ পেয়ে মৃত্যুর পরও অমর এবং স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে যেতে পারে। বিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে বার আউলিয়ার চট্টগ্রামের বাকলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী (রহ.) হলেন আল্লাহর এমনই বিশেষ নি’মাতপ্রাপ্ত ক্ষণজন্মাদের একজন। জন্মসূত্রে তাঁর মধ্যে ছিলো অসাধারণ মেধা ও প্রতিভা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা আরম্ভ করার পূর্বেই তিনি পৈত্রিক ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করলেও তার মেধা, শ্রম, অধ্যবসায়, তীক্ষèবুদ্ধি ও দূরদর্শিতা বলে জীবনের এক পর্যায়ে তিনি এক বিশেষ ব্যক্তিত্বের মর্যাদায় আসীন হন। ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি তাঁর খোদাপ্রদত্ত অসাধারণ যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে যেতে সক্ষম হন। তিনি তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের অগণিত অবদানের মাঝে অমর, স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন ও থাকবেন। উল্লেখ্য, তাঁর ওইসব গুণের সাথে সংযুক্ত হয়েছে তাঁর প্রতি আপন মুর্শিদ ও গাউসে যমানের কৃপাদৃষ্টি, যা তাঁর জীবনে এনে দেয় অকল্পনীয় পূর্ণতা।
১৯২২ ইংরেজি মোতাবেক ১৩৭৪ হিজরির ১৯ মুহররম আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলক্বাদেরী বাকলিয়ার এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত ও ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি পৈত্রিক ক্ষুদ্র ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়াসী হন। সুতরাং অল্প সময়ে তিনি পুরো চট্টগ্রামে এক সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি বক্সিরহাট মার্চেন্ট ডিফেন্স কমিটির সভাপতি, চট্টগ্রাম শিল্প ও বণিক সমিতির সম্মানিত সদস্য, চট্টগ্রামের ভোজ্য তৈল ও তুলা আমদানিকারক সমিতির সভাপতি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ট্রাস্ট সদস্য হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসায়ী পরিমন্ডলে খ্যাত হন। এমনকি তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের দাবি-দাওয়া আদায়ে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, রাজনীতির অঙ্গনেও তিনি এক বিশেষ পদমর্যাদায় আসীন হন। তিনি ছিলেন জন দরদী, প্রসিদ্ধ সমাজ সেবকও। তিনি জমিয়াতুল ফালাহ্ জাতীয় মসজিদের বোর্ড অফ গভর্নরস্ এর সদস্য ও হজ্জ্ব কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী নিজে যেমন জ্ঞানপিপাসু ছিলেন, তেমনি সমাজে জ্ঞান ও শিক্ষার প্রসারের গুরুত্বকে যথাযথভাবে অনুভব করেছেন। সুতরাং তিনি চট্টগ্রাম শহর এলাকায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হন। তিনি লামাবাজার, চরচাক্তাই বালক উচ্চ বিদ্যালয়, গুলজার বেগম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং বাকলিয়ার প্রসিদ্ধ ফোরক্বানিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। সর্বোপরি এশিয়া বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া (চট্টগ্রাম), জামেয়া ক্বাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া (ঢাকা) এবং হালিশহর ও চন্দ্রঘোনা মাদ্রাসাসহ বহু দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কায়েমের ক্ষেত্রে সর্বাধিক অবদান রাখেন এবং এগুলোর আজীবন অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। শরীয়ত, ত্বরীকত, বর্তমানে সারাদেশে শতাধিক মাদ্রাসার পরিচালনাকারী, বহু আধ্যাত্মিক সংগঠন, যেমন ‘গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ, অনেক ধর্মীয় যুগোপযোগী গ্রন্থপুস্তক ও আহলে সুন্নাতের একমাত্র মাসিক মুখপত্র ‘তরজুমান-এ আহ্লে সুন্নাত’ ইত্যাদির পরিচালক ও প্রকাশক সংগঠন আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার আজীবন সহ-সভাপতি ছিলেন আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলক্বাদেরী। তিনি স্ব-উদ্যোগে যে জ্ঞান-ভাÐার আয়ত্ব করেছিলেন তা সত্যি বিস্ময়কর। তাঁর কথাবার্তা, বক্তব্য ও যেকোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে এ সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
বহু ভাষার পারদর্শী : পাকিস্তানে সফরকালে তাঁর উর্দুভাষায় প্রদত্ত এক সারগর্ভ বক্তব্য সেখানকার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। একজন বাংলা ভাষির মুখে ভিন্ন ভাষায় এমন প্রাঞ্জল ও সারগর্ভ বক্তব্য সেদেশে খুব প্রশংসিত হয়েছিলো। সিলসিলাহ বা তরীক্বতের মাহফিলগুলোতে তার বাংলা-আরবি-উর্দু ভাষার দীর্ঘ সাবলীল মুনাজাত আলিম-ওলামা ও বুদ্ধিজীবী সহ সবাইকে হতবাক করে দিতো। সবাই অবাক হতেন এবং একবাক্যে স্বীকার করতেন এসবই তাঁর প্রতি আল্লাহর বিশেষ দানই।
ফানা ফিশ্ শায়খের মর্যাদা লাভ : যথাসময়ে কামিল মুর্শিদের হাতে বায়’আত গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। কামিল মুর্শিদ তাঁর নিষ্ঠাবান মুরীদকেও কামিল করে দিতে পারেন। ইসলামি জগতে এর উদাহরণ প্রচুর। তাই কামিল মুর্শিদের সন্ধান করা যেমন বুদ্ধিমানের কাজ, তেমনি যথাসময় তাঁর হাতে বায়’আত গ্রহণ করে তাঁর নির্দেশানুসারে অনুশীলন করাও সৌভাগ্যের কারণ। আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরীর মধ্যে এ উভয়েরই সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি যথা সময়ে উপমহাদেশের সুপ্রসিদ্ধ মুর্শিদে বরহক্ব আওলাদ-ই রসূল হযরতুল আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (ওরফে হযরত পেশোয়ারী সাহেব) আলায়হির রাহমাহ্র হাতে বায়’আত গ্রহণ করেন এবং তাঁর সান্নিধ্যে অতি অল্প সময়ে ‘ফানাফিশ্ শায়খের’ মর্যাদায় উন্নীত হন। ইতোমধ্যে তিনি শরীয়ত, ত্বরীকত, বিশেষত আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের নিষ্ঠাপূর্ণ খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন। সিলসিলাহ্-ই আলিয়া ক্বাদেরিয়া সিরিকোটিয়ার জন্য তিনি যে অসাধারণ অবদান রাখেন, তা চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এরই অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় এতে যে, তাঁর মহান মুর্শিদের সুযোগ্য উত্তরসূরি মাদারাযাদ ওলী মুর্শিদে বরহক্ব সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তা’আলা আলাইহি) তাঁকে খিলাফতের মহা মর্যাদায় আসীন করেছিলেন। তাছাড়া তাঁর নামের সাথে ‘সওদাগর’ -এর স্থলে ‘আলক্বাদেরী’ও শোভা পেতে থাকে। আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী আপন মুর্শিদে বরহক্বের আনুগত্য তথা ত্বরীকত জগতের এক অনন্য উদাহরণ। মুরীদ আপন মুর্শিদের আনুগত্য কীভাবে করতে হয় এবং এ ক্ষেত্রে কত নিষ্ঠার সাথে অনুশীলন করলে আপন কামিল মুর্শিদের কৃপাদৃষ্টি লাভ করা যায়, একজন মুরীদ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নিকট কিভাবে প্রিয় হতে পারে তার সমুজ্জ্বল উদাহরণ হলেন আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী। কামিল মুর্শিদের রায-রমূয (ইঙ্গিত ও রহস্য) বুঝা ত্বরীকতের জগতে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এতে যেমন আপন মুর্শিদ খুশী হন, তেমনি তাঁর ইচ্ছার বাস্তবায়ন সম্ভব হলে জাতি ও সমাজ অকল্পনীয়ভাবে উপকৃত হয়। আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলক্বাদেরী হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোট ও হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহিমা)’র দীর্ঘ সান্নিধ্য পান এবং তিনি তাঁদের ইচ্ছা, ইঙ্গিত ও ভেদ অনুধাবনে পারদর্শী ছিলেন। এর বহু প্রমাণও আজ সুপ্রসিদ্ধ। যেমন একটি পুণ্যময় মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য মজবুত সংস্থা-সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। শাহেনশাহে সিরিকোটের সুদূর প্রসারী ও যুগান্তকারী দ্বীনী মিশন ছিলো শরীয়ত ও ত্বরীকতের আলোয় গণ-মানুষের অন্তরাত্মাকে ব্যাপকভাবে আলোকিত করা। এ গুরুত্বপূর্ণ ধারার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য শাহেনশাহে সিরিকোট ‘আনজুমান-ই- শূরা-ই রহমানিয়া (পরবর্তীতে আন্জুমান -ই রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ত্বরীক্বতের কার্যাবলী পরিচালনার জন্য ‘খানকাহ্-ই ক্বাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া এবং শরীয়তের দক্ষ ও সাচ্চা আলিম তৈরীর জন্য জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে এদেশে শরীয়ত ও ত্বরীকতের শিক্ষা ও দীক্ষার প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের সুদূর প্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাছাড়া বিশ্বের অনন্য দরূদ শরীফগ্রন্থ ‘মাজমূ ‘আহ্-ই সালাওয়াত-ই- রসূল’ ও ‘শাজরা শরীফ’ প্রকাশের মাধ্যমে আন্জুমানের বিরাট প্রকাশনা কার্যের দ্বার উন্মুক্ত করেন। বলাবাহুল্য, আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী আপন মুর্শিদের এ যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আন্জুমানের তিনি সর্বপ্রথম সহ-সভাপতি নিযুক্ত হন।
তিনি বলুয়ারদীঘি পাড়স্থ নিজ বাসভবনের পূর্ণ এক তলা খানক্বাহ্ শরীফের জন্য ওয়াক্বফ করে দেন ও নিজ খরচে পরিচালনা করেন। জামেয়া প্রতিষ্ঠার সময়ও তিনি আপন মহান মুর্শিদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। জামেয়া প্রতিষ্ঠার এমন পরামর্শ সভায় বাঁশ-বেড়া ও টিনের ছাউনী কিংবা সেমি পাকা ঘর তৈরীর প্রস্তাবাবলী উপস্থাপিত হলে হুযূর ক্বেবলা তাতে রাজি হননি। হুযূর ক্বেবলার ইচ্ছা যে প্রথম থেকেই জামেয়া একটি মনোরম পাকা দালানেই প্রতিষ্ঠিত হোক সেটা আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী সহজেই অনুমান করতে পেরেছিলেন এবং তিনি সাথে সাথে প্রস্তাব দিয়েছিলেন জামেয়ার জন্য পাকা দালানই হবে আর যাবতীয় রড-সিমেন্ট তিনিই প্রদান করবেন মর্মে প্রতিশ্রæতি ঘোষণা করলেন। এতে হুযুর কেবলা অত্যন্ত খুশী হন এবং বিশেষভাবে দো’আ করেন। এভাবে জামেয়া প্রতিষ্ঠা লাভ করলো। আর আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী আজীবন জামেয়া-আন্জুমানের সর্বোচ্চ খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যান। মোটকথা হযূর কেবলার শরীয়ত ও ত্বরীকত সমন্বিত অনন্য সুন্দর এ মিশনকে দ্রæত এগিয়ে নিয়ে যান এ নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব। তাছাড়া হুযূর ক্বেবলা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামেয়া কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া (ঢাকা)’র প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তর জশনে জুলুসের প্রবর্তনের গোড়ায়ও আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরীর ভূমিকা চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রবর্তিত বিশাল জশনে জুলুসের প্রথম দু’ বছর তিনিই নেতৃত্ব দেন।
বরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন : ত্বরীকতের ক্ষেত্রে আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী তো সমস্ত পীর ভাইদের নয়নমণি ছিলেন। তাঁর সুন্দর পরিচালনা, সুন্নাত সম্মত চলাফেরা, আলিম ও বুযুর্গ লেবাস-পোষাক ও অমায়িক ব্যবহার, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, খোদাপ্রদত্ত বাগ্মিতা ও সাবলীল ভাষার মুনাজাত পরিচালনা ইত্যাদিতে অগণিত নারী-পুরুষ হুযূর ক্বেবলার এ মহান ত্বরীকতের অমীয় সুধাপানে তৃপ্ত হতে পারতেন। তদ্সঙ্গে তিনি জামেয়ার সম্মানিত শিক্ষকগণ ও ছাত্রদের পরম বরণীয় ও ¯েœহবৎসল মুরুব্বী ছিলেন। তিনি জামেয়ায় সুন্নি দক্ষ অধ্যক্ষ ও শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। শিক্ষক-ছাত্র এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী সমন্বয়ে যাতে জামেয়ার লেখাপড়া ও সুস্থ পরিবেশ বজায় থাকে সেদিকে তিনি সবসময় খেয়াল রাখতেন। জামেয়া অঙ্গনে যেকোন উদ্ভূত সমস্যার তাৎক্ষণিক সফল সমধান প্রদানে তার বিচক্ষণ মুরব্বিয়ানা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ছিলো। এসব ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিটি ফয়সালা বা মীমাংসায় সকল পক্ষ অভাবনীয়ভাবে প্রীত হতো এবং সাথে সাথে পূর্বের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে আসতো। এসব কারণে তিনি সকলের নিকট শুধু শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন না বরং সকলের হৃদয়ে তিনি অকৃত্রিম ভালবাসার স্থান ও করে নিয়েছিলেন, যা তাঁর হৃদয়বিদারক ইন্তিকালের সময় প্রকাশ পেয়েছিলো। আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী ১৯৭৯ ইং সাল মোতাবেক ১৪০০ হিজরির ১৯ মহররম ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। তাঁর ইন্তেকালের সাথে সাথে অগণিত পীরভাই-বোন, সর্বস্তরের জন সাধারণ ও জামেয়ার ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। সেদিন তাঁকে শেষ বারের মতো দেখার জন্য এবং তাঁর নামাযে জানাযায় শরীক হবার জন্য অগণিত মুসল্লী অশ্রæসিক্ত নয়নে ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাঁর বাসভবন এলাকায় সমবেত হন। তখনই সহজে অনুমিত হয়েছিলো তার অসামান্য জনপ্রিয়তা। জামেয়া ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জানাযা নামাযের পর তাঁকে জামেয়ার পাশেই সমাধিস্থ করা হয়। এখানে তাঁর মনোরম সমাধি রয়েছে যাতে অগণিত মুসলমান নিয়মিত যিয়ারত করে ধন্য হন।
আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলক্বাদেরীর মধ্যে অসংখ্য খোদাপ্রদত্ত গুণের সমাবেশ ঘটেছিলো। তিনি স্বভাবগতভাবে ছিলেন অকৃত্রিম ধর্মপরায়ণ, আপন মুর্শিদে বরহকের অকৃত্রিম অনুসারী ও অসাধারণ প্রিয়ভাজন। তদুপরি, তিনি ছিলেন ইলম ও আলিমদোস্ত। সর্বোপরি তিনি ছিলেন অকৃত্রিম আশেকে রসূল ও আউলিয়া কেরামের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধাশীল। ইমামে আহলে সুন্নাত আ’লা হযরতের প্রতি ছিলো তাঁর অগাধ ভক্তি। ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা শেরে বাংলা রাহামাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হিকে তিনি খুব ভালবাসতেন। হযরত শেরে বাংলাও তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। হুযূর ক্বেবলা ও আল্লামা গাজী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহিমার মধ্যে ভালবাসা ও হৃদ্যতা ছিলো অপূর্ব। আর এ ভালাবাসাপূর্ণ সম্পর্কের অন্যতম যোগসূত্র ছিলেন আলহাজ্ব নূর মোহাম্মদ আলক্বাদেরী। তিনি হুযূর ক্বেবলাগণের সান্নিধ্যে ছায়ার মতোই থাকতেন। হজব্রত পালনসহ দেশ-বিদেশ সফরে হুযূর ক্বেবলার সাথে ছিলেন। তিনি হুযুর ক্বেবলা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্’র সাথে বাগদাদ শরীফ, আজমীর শরীফ, ইয়াঙ্গুনসহ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফর করেন। এ মহান ওলীগণের সান্নিধ্যের ফলে বেলায়তের বহু রহস্য প্রত্যক্ষ করতে তিনি সক্ষম হন। যার সুপ্রভা তাঁর ব্যক্তিজীবনের উপর প্রতিফলিত হয়েছিল।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তিনি অকৃত্রিম দেশ প্রেমের পরিচয় দেন। তদানীন্তনকালীন দেশে যেই রাজনৈতিক মোর্চারই তিনি সমর্থক থাকুন না কেন, কল্যাণমুখী রাজনীতি সমাজসেবা ও দেশপ্রেমই তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছিলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাঁর পরিচালনাধীন আন্জুমানের অধীনে জামেয়া সহ যত প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছিলো কোন প্রতিষ্ঠানের কোন ছাত্র-শিক্ষক স্বাধীনতা বিরোধী কোন কর্মকাÐে জড়িত হয়নি; বরং জামেয়ায় তখন কঠোরভাবে নোটিশ জারি করা হয়েছিলো যেন কেউ তদানীন্তন তথাকথিত শান্তি কমিটির আহŸানে সাড়া দিয়ে কিংবা অন্য কোনভাবে স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠনে ও কর্মকাÐে জড়িত না হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে মাদ্রাসা থেকে বহিস্কার করার নির্দেশ ও দেয়া হয়েছিলো। ওই নোটিশের তোয়াক্কা না করার অপরাধে তখনকার সময়ে দু’জন ছাত্রকে বহিস্কার করা হয়েছিলো। উল্লেখ্য, স্বাধীনতাত্তোরকালে জামেয়া পরিদর্শনে এসে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী ও আওয়ামী ওলামা পরিষদের সভাপতি মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ প্রমুখ এসব রের্কড দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। জামেয়া ও আন্জুমানের ভূয়সী প্রশংসা করে পরিদর্শন বইতে স্বাক্ষর করেন। (সূত্র: বাঙ্গাল কেন যুদ্ধে গেল: কৃত সিরু বাঙ্গালী ও জামেয়ার রেকর্ডপত্র)।
সুন্নিয়াত প্রতিষ্ঠার প্রতি আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরীর অকৃত্রিম ইচ্ছা ও আগ্রহের স্বাক্ষর বহন করে তার প্রতিষ্ঠিত বলুয়ার দীঘি পাড়স্থ খানকাহ্ শরীফ। দেশ বিদেশের সুন্নি মুসলিম ব্যক্তিবর্গের জন্য এ খানকাহ্ শরীফে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা করা হতো। তার আদর্শে অনুপ্রাণিত তাঁর সুযোগ্য উত্তসূরিগণ ওই ঐতিহ্যকে সযতেœ ধারণ করে আসছেন। এ ধরনের অগণিত অসাধারণ অবদানের কারণে আলহাজ্ব নুর মোহাম্মদ আলক্বাদেরী ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্বে অবস্থানরত অগণিত মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় অতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসাপূর্ণ বিশেষ স্থান করে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে শাহেনশাহে সিরিকোট ও তাঁর বরকতমÐিত উত্তরসূরি হুযূর ক্বেবলাগণের অদ্বিতীয় প্রিয়ভাজন ছিলেন এ পরম সৌভাগ্যবান ব্যক্তিত্ব।

লেখক: মহাপরিচালক, আন্জুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম