বহুমাত্রিক ড. মনিরুজ্জামান : তার ভাষাকেন্দ্রিক ভাবনাগুচ্ছ

400

ড. মনিরুজ্জামান, জন্ম ১৫ ফেব্রæয়ারি ১৯৪০। কোন পরিচয়ে তাকে চিহ্নিত করবো? কবি, ছোটগল্পকার, গীতীকার, সমালোচক, লোক সাহিত্য বিশারদ,সম্পাদক, সর্বোপরি তিনি অনন্য ভাষাবিজ্ঞানী।
স¤প্রতি এক সাক্ষাৎকারে নিজের বেড়ে ওঠা নিয়ে বলেছেন আদ্যপান্ত।
‘ বাবা পুলিশ অফিসারের তৎকালীন চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত ঝিনাইদহে চাকরির থাকা সূত্রে সেখানে জন্ম। প্রথমে নৈহাটি, পরে বরানগর, এরপর চব্বিশ পরগনার নামকরা স্কুল ডায়মন্ড হারবারে পড়াশোনা। ৪৭-এর দেশভাগের সময় চলে আসেন পৈত্রিক গ্রাম আদিয়াবাদে।
আদিয়াবাদ তখন ঢাকা জেলার অন্তর্গত, এখন নরসিংদি জেলায়। দেশে এসে গ্রামের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেশিতে ভর্তি। দেশে আসতে খুব সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ স্বরাজ আন্দোলনের কর্মীদেরকে সরকারের ভাষায় ‘ডাকাত’ সাহায্য করার কারণে আর শাহাদাৎ হোসেন, নজরুল ইসলাম এদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে তার বাবা পাকিস্তান সরকারের রোষাণলে পড়েন।
দেশভাগের কারণে হিন্দু টিচাররা ভারত চলে যাওয়াতে স্কুলটা প্রায় শিক্ষকশূন্য হয়ে পড়েছিল। পাশের স্কুলের (পিটিআই) শিক্ষকেরা পার্ট টাইম আমাদের স্কুলে পড়াতেন। ওখানকার একজন ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন অসম্ভব ভালো ইংরেজি পড়াতেন। তাঁর বাচনভঙ্গি, পড়ানোর স্টাইল এসব তাঁকে অসম্ভব মুগ্ধ করে। এ শিক্ষক খুব সাহিত্যমনা ছিলেন। সাহিত্যসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এসবের আয়োজন করতেন। মনিরুজ্জামান ওসব অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। ছড়া লিখতেন,, নাটকেও অভিনয় করতেন। পরের বছর একজন বিএসসি টিচার এসেছিলেন। উনিও খুব সাহিত্যমনা ছিলেন। তার প্রভাব কিশোর মনিরুজ্জামানের ওপর পড়ে।এরপর নটরডেম কলেজে পড়লেন। তখন এর নাম ছিল ‘সেন্ট গ্রেগরি কলেজ’। ফাদার হেরিংটন তখন প্রিন্সিপাল ছিলেন। ফাদার মার্টিন ছিলেন নামকরা শিক্ষক। হেরিংটনের সান্নিধ্য ও পান্ডিত্য তাকে মুগ্ধ করে। বাংলার শিক্ষক আফসার উদ্দিন তাকে বাংলা পড়ার জন্য উৎসাহিত করেন।বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য তিনি অন্য কোনো বিষয়ে পরীক্ষা দেননি। বাংলা বিভাগেই পরীক্ষা দিয়েছি, সেখানেই ভর্তি হয়েছেন।
পরিবারের দিক থেকে পড়াশোনায় সবচেয়ে বেশি যার অবদান তার ভগ্নিপতি এম এ তাহের। উনি জিওগ্রাফির মাস্টার্স ছিলেন, কিন্তু উনার সাহিত্যবোধ ছিল অসাধারণ। স্টেটসম্যান পত্রিকায় গল্প কবিতা লিখতেন। এসবের অবশ্য কোনো বই উনি করে যান নি। জিওগ্রাফির বই লিখেছিলেন। উনি মুসলিম লীগ করতেন, কিন্তু মজার ব্যাপার হলো প্রগতিশীল সাহিত্যের প্রতি তাকে প্রথম উনিই আকৃষ্ট করেছিলেন। সুকান্ত, মানিক এদের ব্যাপারে উনার কাছ থেকেই জেনেছিলেন। এমনকি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যাওয়ার পর স্কুলে উনি শোকসভার আয়োজন করেছিলেন। বন্ধুদের কারণে ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক কারণে মুসলিম লীগ করলেও মুক্তবুদ্ধি বলতে যা বোঝায় সেটার চর্চা তার মধ্যে ছিল। এমনকি নামাজ-রোজার ব্যাপারেও উনার অন্যরকম বক্তব্য ছিল। খুবই সংস্কৃতিমনা ছিলেন। অভিনয় করতেন, নাচ শিখেছিলেন খুব ভালো। বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে উনার খুব প্রতিযোগিতা ছিল নাচে। দেবদাস ছবিতেও অভিনয় করার কথা ছিল, মুসলমান বলে উনাকে বাদ দেওয়া হয়। যাকে বলে সত্যিকারের ভার্সেটাইল, উনি তাই ছিলেন। রাবার চাষের ব্যাপারে সর্বপ্রথম পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন উনি। পাট চাষের ভবিষ্যৎ কী হবে এটা নিয়ে মর্নিং নিউজ-এ অনেকগুলো আর্টিকেল লিখেছিলেন। বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও লেখালেখি করেছেন। শেষ দিকে টি বোর্ডের সদস্য হয়েছিলেন। যখন দেখলেন বিদেশিরা কী বলে সেটাই নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে, তখন সদস্যপদ ছেড়ে দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ৫৭-এ। সাথী হিসেবে পান আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মনজুরে মওলা, আতাউল হককে। এদেরকে নিয়ে একটা গ্র“প ছিলো ‘নীরব সঙ্ঘ’ নামে। মাঠের এক কোণায় সেই ‘নীরব সঙ্ঘে’র সভা বসত। ঐ কোণা থেকে আবার মেয়েদের কমন রুম দেখা যেত। মেয়েরা ঠাট্টা করে ঐ কর্নারের নাম দিয়েছিল ‘ইডিয়টস কর্নার’। আমরাও নামটা মেনে নিয়েছিলাম। তখন ডাকসু ও অন্যান্য সাহিত্য সংগঠনের উদ্যোগে সাহিত্যসভা হত। সেখানে বড় বড় সাহিত্যিকরা আসতেন। সুফিয়া কামাল, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা। কবিতা প্রতিযোগিতায় পরপর দুবছর প্রথম পুরস্কার পান। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, শওকত আলী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মমতাজউদ্দীন আহমদ এরা তাদের সিনিয়র গ্রুপ ছিলেন। মাঝে মাঝে সিনিয়রদের সঙ্গেও আড্ডা হতো। সওগাত, উত্তরণ, সমকাল, কাফেলা প্রায় সব পত্রিকাতেই তখন মনিরুজ্জামানের লেখা ছাপা হতো।
সহপাঠিনী হিসেবে পান নাজমা জেসমিন চৌধুরী, রফিকুন্নেসা পারুল , অল্পবয়স থেকেই খুব ভালো ছড়া লিখত।
সাহিত্য থেকে ভাষাবিজ্ঞানের দিকে কিভাবে ঝুঁকলেন, সে সম্পর্কে মনিরুজ্জামান বলেন: এটা পুরোপুরিই ধ্বনিবিজ্ঞানী আবদুল হাই সাহেবের কারণে। তখন তো ভাষাবিজ্ঞানের তেমন কোনো বই-ই ছিল না। কিন্তু হাই সাহেবের ক্লাস করার পর আর বইয়ের দরকার হত না। চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেওয়ার পরে তখনকার প্রিন্সিপাল আবদার রশীদ সাহেব আমাকে বললেন ভাষাবিজ্ঞান অংশটা পড়াতে। তখনই আমি ভাষাবিজ্ঞানের নানান বিষয়ে ভাবতে ও লিখতে শুরু করি। পরে লেখাগুলো জড়ো করে ভাষা সমস্যা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ বইটা বের করলাম। এ-বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন আবুল ফজল। ভাষাবিজ্ঞানে আমার পড়াশোনা তখনও তেমন বিস্তৃত হয় নি। আসল পড়াশোনাটা হল যখন তিনি পিএইচডি করতে যাই মহীশূরে।
এ ভাষাবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৬০ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন ভারতের মাইশুর বিশ্ববিদ্যালয় হতে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। কর্মজীবনের নানা সময়ে নজরুল ইনস্টিটিউটের পরিচালক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি এবং কলা অনুষদের ডিন ছিলেন।
তিনি ‘লিঙ্গুইস্টিক সোসাইটি অভ ইন্ডিয়া’,
‘দ্রাবিড়িয়ান লিঙ্গুইস্টিক এসোসিয়েশান’, ‘ফিলোলজিক্যাল এসোসিয়েশান অভ গ্রেট ব্রিটেন’ সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা ও সংঘের জীবনসদস্য। ভাষা, সাহিত্য ও ফোকলোর বিষয়ে এযাবৎ তাঁর ২৮টি বই এবং শতাধিক গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।একাধিক সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
স¤প্রতি (ফেব্রুয়ারি ২০১৮) বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর পাবলিশিং লিমিটেড (বিপিএল) প্রকাশ করেছে তার ভাষা নিয়ে গবেষণার নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন ‘ভাষা ও সাহিত্য সাধনা’র -ভাষা খন্ড টি।
এ সংকলনে সূচিবদ্ধ হয়েছে ড. মনিরুজ্জামানের নিন্ম শিরোনামাঙ্কিত ভাবনাগুলো:
ক.বিভাগ
ভাষা: ঐতিহাসিক, বৈয়াকরণিক এবং বানান ও অভিধান প্রসঙ্গ
১ ও ঐতিহাসিক তুলনামূলক পুনর্গঠন তত্ত¡, উত্তর কথন ও কারকবাদীদের প্রসঙ্গ
২ ও বাংলা, সংস্কৃত ও ইন্দেড়া ইউরোপীয় স¤প্রসারিত ঐতিহাসিক পুনর্গঠনতত্ত্বের ব্যবহার প্রসঙ্গ
৩ ও বাঙালীর ব্যাকরণ চিন্তা: ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
৪ ও বাংলা বানান রহস্য ও বাংলা ধ্বনির প্রতিবর্ণীকরণ
৪.১ বাংলা বানান রহস্য, ভ্রান্তি না ত্রুটি
৮.২ বানান: বাংলা বর্ণমালা পরিচয় ও প্রতিবর্ণীকরণ প্রসঙ্গে
দুটি কথা
৫ ও অভিধানে সংকট
খ’. বিভাগ
ভাষাসাধনা: প্রসঙ্গভাষা, ধ্বনি ও প্রাচীনপাঠ
৬ ও ড.মুহম্মদ শহীদৃল্লাহ্ র জীবনতথ্য এবং অবহেলিত আবিষ্কার
৬.১ ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
৬.২ ভাষাগুরু ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
৬.৩ আধুনিক ঐতিহাসিক ভাষাতত্বের দৃষ্টিতে বাংলাভাষা গবেষণার স্মরণীয় পুরুষ ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
৬.৮ নব্যভারতীয় ভাষার নবশাখায়ন ও স্তরক্রম পুনর্গঠনে ড. মুহম্মদ শহীদূল্লাহর অবদান
৭ ও ভাষা শ্রেষ্ঠী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
৮ ও ধ্বনিবিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুল হাই
৯। ভাষামুণি পদ্মশ্?ী ড. দেবী’প্রসন্ন পট্টনায়ক
১০। শরৎনাথ ভট্টাচার্য ওরফে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
১১। হরিচরণ, তাঁর সার্ধশত জন্মবর্ষ এবং ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’
গ. বিভাগ বিবিধ:
সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঔপভাষিক
১২। চন্দরা কহিল: ভাষা বিকাশে নারী
১৩।দাপ্তরিক ভাষা: আলোচনা
১৪।বাংলাভাযার মান ও মর্যাদা
১৫। একুশের ভাষাচিন্তা
১৬।ভাষার সমাজবিরোধী রূপ ও আমাদের ভবিষ্যৎ সমাজ
ঘ.বিভাগ
উপভাষা প্রসঙ্গ
১৭। উপভাষা ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি
১৮। বাংলাদেশের প্রান্তীয় ভাষা বৈশিষ্ট্য
১৮.১ উত্তরবঙ্গের ভাষা তথ্যের সমাহার
১৮.২ সাতক্ষীরার উপভাষা প্রসঙ্গ
১৮.৩ সিলেটের উপভাষা ১
১৮.৪ সিলেটের উপভাষা ২
১৯। পূর্ব বঙ্গায় কথ্যভাষা ও তার বৈশিষ্ট্য ;
২০। বাংলাদেশের উপভাষা চর্চার ধারা
২১। গোপাল হালদার: বাংলা উপভাষা চর্চার অন্যতম পূর্বসূরী
২২। ঢাকাইয়া ভাষা ও পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি ২২.১. ঢাকার ভাষা পরিস্থিতি; পূর্বকথা
২২.২ পরিবর্তনশীল ঢাকার উপভাষা
ড. মনিরুজ্জামান এর ভাষাকেন্দ্রিক এ ভাবনাগুলো নিয়ে অনন্য ভাষাবিজ্ঞানী, তার বন্ধু প্রফেসর ড. উদয় নারায়ণ সিংহ একটি চমৎকার রেখাচিত্র এঁকেছেন।

প্রফেসর ড. উদয় নারায়ণ সিংহ একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। তিনি সভাপতি ও প্রফেসর এমিটি সেন্টার ফর লিঙ্গুইস্টিক স্টাডিস, হারিয়ানা, এমিটি বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত।
সাবেক পরিচালক, (কেন্দ্রীয় ভারতীয় ভাষাসংস্থা (‘ওওখ), মহিসুর, দক্ষিণ ভারত।
সাবেক উপ উপাচার্য, বিশ্ব ভারতী, শান্তিনিকেতন, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত। তিনি গেল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২১ফেব্রুয়ারী-২০১৮ তে এ বই নিয়ে চমৎকার এ রেখাভাষ্যে লিখেছেন:
’ভাষাতাত্তি¡ক প্রফেসর মনিরুজ্জামানের সাথে আমার পরিচয় দীর্ঘ দিনের ও তাঁর গবেষণার বিষয় ভাষার ঐতিহাসিক তুলনামূলক পুনষ্ঠিন ও আরও স্পষ্ট করে বললে, নিয়ন্তিত ঐতিহাসিক পুনর্গঠন’
(ঈড়হঃৎড়ষষবফ ঐরংঃড়ৎরপধষ জবপড়হংঃৎঁপঃরড়হ) ও ঐতিহাসিক ভাষাতত্বে এটি একটি নব শাখা যা ঘবি ঞরিম. ভাষার উৎস সন্ধানের একটি নব প্রকরণ ? এই তত্তে¡র উদ্ভাবন ও পদ্ধতি বিস্তারে অবদান আছে হোয়েনিগসওয়াল্ড, রবার্ট হল, ফাপুঁসন, পল থীম, ডেল হাইম, সাউথওয়ার্থ প্রমুখের ও ভারতেও ঘাটগে, কাত্রে, মহেÐলে প্রমুখের তাত্তি¡ক দিকের প্রশংসনীয় কাজ আছে এক্ষেত্রে ও এতদ বিষয়ে মনিরুজ্জামানের গুরু পদ্মশ্?ী ড. ডি.পি পট্টনায়ক ফার্গুসনী মডেলটিকে ভারতীয় ভাষায় প্রথম প্রয়োগ করেন ও বিস্তার ঘটান ও এই মডেলটিতে প্রতিষ্ঠিত ধারণার বাইরে গিয়ে মনিরুজ্জামান উপভাষায় ক্ষেত্রে প্রথম প্রয়োগ করেন এবং পশ্চিম বাংলার উদাহরণ নিয়ে কাজ করেন ? বর্তমান গ্রন্থের প্রথম ভাগে এই বিষয়ের ওপর কিছ নতুন আলোকপাত করে সমস্যাটি বিশদ করার চেষ্টা আছে ও সেই সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু প্রসঙ্গ অর্থাৎ ব্যাকরণ চিন্তার ঐতিহ্য, ভাষা সংপঠনে বানানের কালিক সংলগ্নতা, অভিধানী রূপ এবং ট্রান্সলিটারেশনের ভূমিকার কথাও যুক্ত করা হয়েছে।
বহুভাষাবিদ জ্ঞানতাপস মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অবদানও এই ধারায় অসামান্য ও তিনি ইন্দো ইউরোপীয় মহাভাষার ভারতীয় রূপের পূর্বী শাখার স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করে ভারতীয় আর্যভাষার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন ও তাঁর কর্মকৃতি নিয়ে আলােচনাগুলি স্বতন্ত্র ভাগে [(খ) অংশে] রাখা হয়েছে এখানে ও তাঁর বিষয়ে মনিরুজ্জামানের মূল্যায়ন আরও খননী আলোচনার দাবীদার? একই সাথে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধ্বনিবিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুল হাই এর প্রসঙ্গও রাখা হয়েছে কিছুটা স্মৃতি মিশ্রিত ভাঙ্গিতে? ধ্বনিতত্তে¡র আলোচনায় ‘ প্রসডি তত্তে¡’ তাঁর অবদান এবং বাংলাদেশে ধ্বনিবিজ্ঞানের প্রসার ও সেই সাথে উপভাষায় বৈজ্ঞানিক আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোর আভা গার্দিয় ভূমিকার কারণে বাংলাদেশে ভাষা গবেষণার ইতিহাসে তাঁর খ্যাতি ও যশ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত ‘সাহিত্য পত্রিকা’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও এক বিস্ময়কর কীর্তি। ভাষার ক্ষেত্রে ভারতের অপর যে তিন কিংবদন্তি পুরুষের কথাও এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তারা ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চক্রোপাধ্যায়, চর্যাপদ ও তার লিপিসহ বহু প্রাচীন পাঠ ও প্রস্তরলিপির পাংঠাদ্ধার করে খ্যাত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং ভারতের অন্যতম ভাষাতাত্তি¡ক ও ভাষা পরিকল্পক পদ্মশ্?ী ড. দেবীপ্রসন্ন পট্টনায়ক। পাঠক তাদের সাথে পুনঃপরিচিতি লাভ করে ঋদ্ধ হবেন ?

তৃতীয় ভাগের আলেচেনাগুলি সমাজভাষা বিষয়ক। তবে ‘উপভাষা’র আলোচনাগুলিকে স্বতন্ত্র রাখা হয়েছে। উপভাষা যেমন সমাজভাষার, তেমনি সাংগঠনিক ভাষাতত্তে¡রও বিষয়। উপভাষা বিষয়ে মনিরুজ্জামানই প্রথম বাংলায় গ্রন্থ রচনা করেন (দেখুন, ‘উপভাষা চর্চার ভূমিকা’, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৪)। তবে এখানকার আলোচনার বিষয় কিছুটা ভিন্ন। তার প্রথম ৫টি আলোচনা বিদেশে এবং শেষ গবেষণাটি এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকায় পঠিত ও প্রকাশিত। প্রত্যেক প্রবন্ধ শেষে প্রকাশ তথ্য দেওয়া হয়েছে। ভাষাতত্তে¡ মনিরুজ্জামানের অবদান তাঁর থিসিস এবং ‘ঊপভাষা’ বিষয়ক গ্রন্থটির ন্যায় এখানেও সমান পরিস্ফূট। গ্রন্থটি গবেষকদের কাছে মূল্যবান বলেই বিবেচিত হবে আশা করি।
বহুভাষী ঋদ্ধ লেখক, কবি, নাট্যকার,ভাষাবিদ, সংগঠক ও সম্পাদক প্রফেসর ড. উদয় নারায়ণ সিংহ এর এ মন্তব্যধর্মী মূল্যায়ন ভাষা প্রেমী পাঠকদের এ বই পাঠে প্রাণিত করবে। বাংলাদেশে জন্ম নেয়া এ ক্ষণাজন্মা বহুমাত্রিক মনীষার ভাষা নিয়ে নিরন্তর ভাব ও ভাবনার রেখালেখ্য গুলো পথ দেখাবে আগামীর পথ চলার। ভাষা প্রেমী জাতি হিসেবে আমরা সেদিনই গৌরবান্বিত হবো যখন আমরা এসব মনীষার মানস সম্পদগুলো নিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে শিখবো। নয়তো আমাদের ভাষা প্রেম, একুশের নানা উদযাপন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ঘোষণা নিয়ে আমাদের আদিখ্যেতা সব কিছু বুদবুদের মত মিশে যাবে কালের করাতে। জয় হোক, বাঙলা ভাষার, জয় হোক এমন মনীষার।

বই:
ভাষা ও সাহিত্য সাধনা (ভাষা খন্ড) মনিরুজ্জামান
প্রকাশক:বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর পাবলিশিং লিমিটেড (বিপিএল)
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি -২০১৮
মূল্য: ৯৫০ টাকা