বর্ষবরণ ঘিরে নগরীতে কঠোর নিরাপত্তাবলয়

88

পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে থাকবে নগরী ও জেলা। এ সময় প্রায় ৮ হাজার র‌্যাব ও পুলিশ সদস্য মাঠে দায়িত্ব পালন করবেন। তিনজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে থাকবে ভ্রাম্যমাণ আদালত। অনুষ্ঠানস্থলে বসানো হবে আর্চওয়ে। বর্ষবরণ উদ্যাপনে সিএমপি ১১টি নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সন্ধ্যা ৬টার আগে অনুষ্ঠান শেষ করা। এছাড়া ট্রাফিক বিভাগ যান চলাচলে রুট নির্ধারণ করে দিয়েছে।
আগামীকাল রবিবার বর্ষবরণ উপলক্ষে চলছে ব্যাপক আয়োজন। ডিসি হিল, সিআরবি শিরিষতলা, শিল্পকলা একাডেমি, চারুকলা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন স্থানে নানা আয়োজনে বর্ষবরণ করা হবে। নির্বিঘ্নে যাতে অনুষ্ঠান করা যায়, সেজন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে নগর ও জেলা পুলিশ। এদিন নগরে প্রায় ৫ হাজার এবং জেলায় তিন হাজার পুলিশ মোতায়েন থাকবে। পাশাপাশি র‌্যাব সদস্যরাও মাঠে থাকবে। গোয়েন্দা পুলিশও নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করবে।
সিএমপি সূত্রে জানা যায়, এদিন ভোর থেকেই নগরে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। অনুষ্ঠানস্থল ও আশেপাশে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে। আর্চওয়ের মাধ্যমে আগতদের তল্লাশি করা হবে। মোড়ে মোড়ে পুলিশ মোতায়েন থাকবে। নগরজুড়ে থাকবে ৪০টিরও বেশি চেকপোস্ট। যানবাহন ও পথচারী তল্লাশি কার্যক্রম চালানো হবে।
সিএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান বলেন, বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের নিরাপত্তায় কোন ধরনের ঘাটতি নেই। সবাই যাতে নির্বিঘেœ অনুষ্ঠানাদি করতে পারেন এবং এতে সবাই অংশ গ্রহণ করতে পারেন, সেজন্য সকল ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকবে। র‌্যাব সদস্যরাও নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলবেন। এদিন চার শতাধিক র‌্যাব সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। অনুষ্ঠানস্থলের আশেপাশে র‌্যাব সদস্য মোতায়েন থাকবেন।
এদিকে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনকে ঘিরে ১১টি নির্দেশনা দিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। এসব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সকল ধরনের অনুষ্ঠান শেষ করা। এছাড়া মুখোশ ব্যবহার না করা, বাজি বা পটকা বহন ও ফোটানো থেকে বিরত থাকা, ভুভুজেলা বা বাঁশি ইত্যাদি বাজানো থেকে বিরত থাকা, বড় ব্যাগ-পোটলা-ব্যাক প্যাক বহন করা হতে বিরত থাকা, ডিসি হিল ও সিআরবি এলাকায় দর্শকদের নির্ধারিত প্রবেশ ও বাহির পথ ব্যবহার করা।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, নববর্ষের অনুষ্ঠান নির্বিঘœ করতে নগরে দায়িত্ব পালন করবেন জেলা প্রশাসনের ৩ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। পতেঙ্গা সৈকত, সিআরবি এবং ডিসি হিল এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন তারা।
সূত্র জানায়, নগরের পতেঙ্গা সৈকতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাহমিলুর রহমান, সিআরবিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসএম শান্তনু চৌধুরী এবং ডিসি হিলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. তৌহিদুল ইসলাম দায়িত্ব পালন করবেন। নববর্ষের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন তারা।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্র্রেট মোহাম্মদ মাশহুদুল কবীর জানান, বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। এদিন নগরবাসীকে নববর্ষের অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে উপভোগের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে চাই আমরা। এজন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে জেলা প্রশাসনের ৩ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, নগরে পতেঙ্গা সৈকত, সিআরবি এবং ডিসি হিলে বর্ষবরণের বড় অনুষ্ঠান হয়। এসব অনুষ্ঠানে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।
সূত্র জানায়, পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণের উৎসবের কারণে নগরীর কয়েকটি সড়কে যান চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রবিবার সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অনুষ্ঠানস্থল ডিসি হিল, সিআরবি শিরীষ তলা ও পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকার আশেপাশে যান চলাচল বন্ধ থাকবে।
ডিসি হিলে পহেলা বৈশাখ আয়োজনের কারণে ওই দিন সকাল সাড়ে ৫টা থেকে লাভলেইন মোড়, চেরাগী পাহাড় ও এনায়েত বাজার মোড় থেকে ডিসি হিল পর্যন্ত সড়কে কোন ধরনের যানবাহন চলতে পারবে না।
সিআরবি শিরীষ তলার অনুষ্ঠানের কারণে কাঠের বাংলো, আটমাসিং মোড়, হোটেল রেডিসন ব্লুর সামনের মোড় ও নেভাল মোড় থেকে সিআরবিগামী রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। এছাড়া পতেঙ্গা সি-বিচ কেন্দ্রিক নিরাপত্তার আওতায় থাকছে বাটার ফ্লাই মোড় হতে নেভাল একাডেমির গেট হয়ে ওয়েস্ট পয়েন্ট মোড় পর্যন্ত, কাটগড় মোড় এবং ওয়েস্ট পয়েন্ট মোড় হতে সি-বিচ অভিমুখের সড়ক, ৪১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের সামনে থেকে সি-বিচ অভিমুখে এবং বাইপাস রোড সি-বিচ থেকে ফৌজদারহাট অভিমুখে প্রয়োজনীয় স্থানে রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করা হবে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ নির্দেশনা কার্যকর থাকবে।
জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বৈশাখী উৎসব উদ্যাপনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জেলায় তিন হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে। জেলার ১৬ থানায় তারা দায়িত্ব পালন করবেন। সেই সঙ্গে যেসব এলাকায় মেলার আয়োজন থাকবে, সেখানে নিরাপত্তা জোরদার করা হবে।
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন মাহমুদ সোহেল জানিয়েছেন, রবিবার বাংলা নববর্ষ ১৪২৬ বরণ উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন থানা এলাকায় বৈশাখী মেলা, বাঙালি সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উপজেলায় নববর্ষ উপলক্ষে বৈশাখী মেলা আয়োজন করা হয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৬ থানায় চার স্তরে তিন হাজার পুলিশ ফোর্স মোতায়েন থাকবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেলার স্থানসহ গুরুত্বপূর্ণ মেলায় সিসি ক্যামেরা থাকবে। এছাড়া সড়ক ও মহাসড়কে প্রয়োজনীয় স্থানে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা জোরদার করা হয়েছে। মেলা উপলক্ষে কন্ট্রোল রুম ও ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন, সন্দেহভাজন স্থান সুইপিং ও স্ক্যানিং করা হবে। এছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে মোবাইল টিম মাঠে থাকবে।

বন্দীরাও মাতবেন
বর্ষবরণ উৎসবে
তুষার দেব
তাদের বেশিরভাগই নানা অপরাধে জড়ানোর মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ঠাঁই পেয়েছেন। কেউবা অপরাধের বিচার শেষে আদালতের দেয়া দন্ড ভোগ করার জন্য এখানকার বাসিন্দা হয়েছেন। তাদের মধ্যে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদসহ নানা পেশাজীবী যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন দন্ডপ্রাপ্ত ভয়ঙ্কর খুনি কিংবা পেশাদার চোর-ডাকাতও। কারাবিধি অনুযায়ী, কারাভ্যন্তরে তাদেরকে ‘হাজতি’ আর ‘কয়েদি’ হিসেবে শনাক্ত করা এবং রাখা হলেও কারা কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের সকলের প্রধানতম পরিচয় হল ‘বন্দী’। সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা কারাভ্যন্তরের একাধিক ভবনে কারারক্ষীদের সার্বক্ষণিক নজরদারি আর নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনেই দিনযাপন করতে হয় তাদেরকে। তবে, বন্দী জীবনেও বাঙালির প্রাণের উৎসব নববর্ষ বরণের বর্ণিল আনন্দ থেকে একেবারে বঞ্চিত হচ্ছেন না তারা।
পয়লা বৈশাখে নানা আনুষ্ঠানিকতায় কারাভ্যন্তরে বন্দীরা বর্ষবরণ উৎসবে মাতোয়ারা হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পয়লা বৈশাখে কারাভ্যন্তরে বন্দীরা যাতে একটি দিন আনন্দমুখর পরিবেশে কাটানোর পাশাপাশি পরস্পরের সাথে বর্ষবরণের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারাকে বিবেচনায় রেখেই নানা আয়োজন করা হচ্ছে। বিশেষ দিন হিসেবে শুরুতেই বন্দীদের মাঝে পরিবেশন করা হবে ‘পান্তা-রুই’ ও ঐতিহ্যবাহী বাংলা খাবার হিসেবে পরিচিত নানা পদের ভর্তা। দুপুরে গরু ও মুরগীর মাংস দিয়ে থাকছে মেজবানি খাবারের আয়োজন। আর রাতে মাংস- পোলাও। পুরো আয়োজনের প্রতিটি পর্বে বাঙালিয়ানার ছাপ রাখা হচ্ছে। ‘কারা শিল্পী গোষ্ঠী’ নাম ধারণ করে দিনভর গানের সুর আর তালে সবাইকে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন বন্দীদেরই কয়েকজন। এজন্য বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্র, বাদক ও সাউন্ড সিস্টেমও ভাড়া নেয়া হচ্ছে। বৈশাখী আয়োজনের শুরুটা হবে যথারীতি বাংলা নতুন বছরের প্রথমদিন সকালে। দুপুরে খাবারের বিরতি দিয়ে পুনরায় চলবে বিকাল পর্যন্ত। অনুষ্ঠানের মঞ্চ তৈরিসহ সব আয়োজনই সম্পন্ন হবে বন্দীদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। কারাভ্যন্তরে উন্মুক্ত মাঠে একত্রিত হয়ে বন্দীরা সঙ্গীতানুষ্ঠান উপভোগের সুযোগ পাবেন।
কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নাশির আহমেদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘বর্তমানে কারাগারে বন্দী ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ চলছে। এছাড়া, বার্ষিক অডিট কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। তা সত্বেও নববর্ষ বরণের একটি দিনের আনন্দ থেকে বন্দীরা যাতে একেবারে বঞ্চিত না হয় সেজন্য পয়লা বৈশাখে বিশেষ খাবার-দাবারের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে।’
কারাগার সূত্র জানিয়েছে, কারাগার প্রতিষ্ঠার পর থেকে গতবছরের শেষের দিকে এসে কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চসংখ্যক বন্দীর চাপ সামলাতে হয়েছে। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পাঁচ গুণেরও বেশি বন্দী চাপ সামলাতে হিমশিম খেয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। কারাগারের মূল ভবনে তৈরি করা কক্ষগুলোতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বারান্দা ও চৌকাতে (রান্নাঘর) পর্যন্ত বন্দীদেরকে রাখতে হয়েছে। মূলতঃ বিদায়ী বছরের শুরুতে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরুর পর থেকেই কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীর চাপ বাড়তে থাকে। তার আগে কারাগারে গড়ে প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বন্দী থাকলেও বিদায়ী বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর এসে বন্দীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপর নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক মামলায় আটকের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। এক হাজার আটশ’ ৫৩ জন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় কারাগারে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের ভোটগ্রহণের পরদিন বন্দী ছিল ১১ হাজারের প্রায় কাছাকাছি ১০ হাজার নয়শ’ জন। এতে গাদাগাদি অবস্থা সৃষ্টি হয় কারাভ্যন্তরে। এরপর চলতি বছরের শুরুতে ছুটি শেষে আদালতের কার্যক্রম চালু হলে রাজনৈতিক মামলার আসামিদের জামিন মঞ্জুরের হার তুলনামূলকভাবে বাড়তে শুরু করে। এরপর থেকে বন্দীদের আবাসনসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় উন্নতি হয়। বর্তমানে কারাগারে প্রতিদিন গড়ে কমবেশি আট হাজার বন্দী থাকছে। সকাল ও বিকালের পালা মিলিয়ে জামিনে মুক্তি মিলছে অর্ধশতাধিক বন্দীর।