বর্ষবরণে রঙিন প্রাণের জোয়ার

74

আলপনায় রঙিন রাজপথ। মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশ কিংবা পোশাকেও রঙের ঢেউ। গালে-কপালে রং দিয়ে লেখা নববর্ষ। রংয়ের এই দোলা নিশ্চয় মনে-প্রাণেও। গত রবিবার সকাল থেকে রাত অবধি নগরীর চেহারা ছিল এমনই রঙিন। সকালের মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে শুরু করে সন্ধ্যার পর উন্মুক্ত মঞ্চে সঙ্গীত ও নৃত্যানুষ্ঠান। পয়লা বৈশাখে বাংলা নববর্ষবরণ উৎসবের প্রতিটি আয়োজনে নেমেছিল সকল শ্রেণীপেশার মানুষের ঢল। রঙিন প্রাণের উচ্ছ¡াসে মাতোয়ারা মানুষের এই ¯্রােত মিলিত হয়েছে ডিসি হিল, সিআরবির শিরীষতলা আর পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে। জীর্ণ-পুরাতনকে পেছনে ফেলে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার আনন্দ যেন সকলের চোখেমুখে। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই এসেছিলেন বর্ষবরণের প্রাণের উৎসবে। সবকিছু ছাপিয়ে বর্ষবরণের আয়োজন কার্যত বাঙালির মিলনোৎসবে রূপ নেয়।
বৈশাখের প্রথম দিন রবিবার সকাল থেকেই সারাদিন নগরীর ডিসি হিল পার্ক, সিআরবি সাত রাস্তার মোড় শিরীষতলা, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, কর্ণফুলী নদীর তীর, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতসহ বিভিন্ন এলাকায় চলে বর্ষবরণের নানা আয়োজন। বর্ণিল পোশাকে নানা বয়সী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে নগরজুড়ে রঙের ঢেউ খেলে যায়। নগরবাসী দিনভর মেতে থাকে আনন্দ আর উচ্ছ¡াসে।
সকাল দশটায় নগরের সার্সন রোডে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের করা হয় বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রা। নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। পুরো শোভাযাত্রা ছিল নানা রঙে রঙিন। শোভাযাত্রার অগ্রভাগে থাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক প্রণব মিত্র চৌধুরী বলেন, এবারের শোভাযাত্রায় বিপন্ন কর্ণফুলীকে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতীকী নারীর মুখাবয়বে কর্ণফুলীর এক কানে ছিল দুল, অন্যটি খালি। চোখে ঝরছে জল। এছাড়া বড় আকারের মাছ, নৌকা-সাম্পান, হরেক রঙের মুখোশসহ নানান প্রতিকৃতি নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেন চারুকলার সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ সর্বস্তরের মানুষ। এ আয়োজনকে ঘিরে হরেক রকম প্রতিকৃতি তৈরি করতে গত প্রায় একমাস ধরে অবিরাম কাজ করেছেন ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। পহেলা বৈশাখে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার এই আয়োজনের গোড়াপত্তন হয় বাংলা ১৪১৩ সন থেকে। চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘চট্টগ্রাম চারুশিল্পী সম্মিলন’ এই শোভাযাত্রার উদ্যোক্তা। বিগত ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভ করে বাঙালির নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা। কালের পরিক্রমায় মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় বর্ষবরণের আয়োজনে তা ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। শিল্পকলা একাডেমি থেকে জেলা প্রশাসনসহ আরও বিভিন্ন স্থানে শোভাযাত্রার আয়োজন থাকলেও চারুশিল্পী সম্মিলন-এর শোভাযাত্রাই এখানকার প্রধান মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে বিবেচিত হয়।
নগরীর ডিসি হিলে সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের আয়োজনে বর্ষবরণের উৎসবের সূচনা হয় ‘সূচি অঙ্গন বাংলাদেশ’ এর শিল্পীদের ভৈরবী রাগের ধ্রæপদ সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। এরপর একে একে দলীয় সংগীত পরিবেশন করে সংগীত ভবন, রক্তকরবী, ছন্দানন্দ, সুর সাধনা, শৈশব, সৃজামি সাংস্কৃতিক অঙ্গণের শিল্পীরা। নরেন আবৃত্তি একাডেমি, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, বোধন আবৃত্তি পরিষদের শিল্পীরা পরিবেশন করেন বৃন্দ আবৃত্তি। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে স্কুল অব ওরিয়েন্টাল ডান্স, ওডিসি এন্ড টেগোর মুভমেন্ট, গুরুকূল আর ঘুঙুর নৃত্যকলা কেন্দ্র।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্যে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, আবহমান কাল ধরে বাঙালি চিন্তা-চেতনায়-মননে যেমন অসাম্প্রদায়িক, তেমনি বাংলাদেশও অসা¤প্রদায়িক দেশ। পহেলা বৈশাখ সার্বজনীন উৎসব, বাঙালির প্রাণের উৎসব। নতুন বছরে আমি সকলের কল্যাণ কামনা করি। অন্যদের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার মাহবুবর রহমানও এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
ডিসি হিলের অনুষ্ঠানের সংগঠক প্রণব চৌধুরী বলেন, ঐতিহ্যের ধারা বজায় রেখে ৪১তম বারের মত ডিসি হিলে বর্ষবরণের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ। নতুন বছরে আমরা সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ এবং সকলের সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা করি।
সিআরবি শিরীষতলায় নববর্ষ উদযাপন পরিষদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা হয় বেহালায় সুরের মূর্ছনায়। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে আনন্দধ্বনি, সংগীত ভবন, বোধন, চারুকা নৃত্যকলা একাডেমি, গুরুকূল, রেলওয়ে কালচারাল একাডেমি, উচ্চারক আবৃত্তিকুঞ্জ, উদীচীসহ বিভিন্ন সংগঠন দলীয় সংগীত, আবৃত্তি ও নৃত্য পরিবেশন করেন। সন্ধ্যায় সম্মিলিত কণ্ঠে জাতীয় সংগীতে দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়। দুপুরে সিআরবি সাত রাস্তার মোড়ে আয়োজন করা হয় সাহাবুদ্দিনের বলী খেলার। নগরীর জামালখান মোড়ে শিশুমেলার আয়োজনে উদযাপিত হয় শিশুদের পহেলা বৈশাখ। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়।