বর্ষণের বিরতিতে পরিস্থিতির উন্নতি

27

টানা প্রায় দশদিন ভারী বর্ষণের মধ্য দিয়ে বিস্তীর্ণ জনপদে বান ডেকে আনার পর হয়তো খানিকটা ক্লান্তি পেয়ে বসেছিল বৃষ্টি-দেবতাকে। আষাঢ়ের বিদায়ের দিনে গতকাল সোমবার তাই চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে বিরতিই নিয়েছে চলতি বর্ষা মৌসুমের প্রথম ভারী বর্ষণধারা। তাতেই আকাশে মেঘের আড়াল সরিয়ে দেখা মিলল রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের। সূর্যের দিনমান এই হাসি যেন পরম আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিয়েছে বানভাসী মানুষের জীবনে। বর্ষণ-বিরতিতে বানের পানি ধীরে ধীরে নামতে থাকায় বৃহত্তর চট্টগ্রামের স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতিও উন্নতির দিকে পথচলা শুরু করেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, ভারী বর্ষণকবলিত বিগত দশদিনে শুধু চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে হাজার মিলিমিটার ছাড়িয়ে যাওয়া বৃষ্টিপাতের সাথে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে নগরীতে জলাবদ্ধতার পাশাপাশি কমবেশি ১৪ উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যায়। একইভাবে কক্সবাজারের চকরিয়াসহ তিন পার্বত্য জেলায়ও লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। বানের পানির নিচে ডুবে যায় সড়ক-মহাসড়ক থেকে শুরু করে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি। নদীর ভাঙনকবলিত এলাকার শতাধিক বাড়িঘর ¯্রােতে ভেসে গেছে। সাঙ্গু, মাতামুহুরী, হালদা, ইছামতি, ডাবুয়া, সর্তা, ও শঙ্খ নদীর পানি এখনও প্রবাহিত হচ্ছে বিপদসীমার ওপর দিয়ে। বন্যাদুর্গত এলাকার বাসিন্দাদের দুর্দশা চরমে পৌঁছে। ভূমিধসে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম বিভাগে থিতু থাকার পর গত রবিবার থেকেই ভারী বর্ষণধারা বাঁক বদলে উত্তরবঙ্গে নিজের দাপট দেখাতে শুরু করে। ওইদিন রংপুর বিভাগের ডিমলায় দেশের সর্বোচ্চ একশ’ ৯৫ মিলিমিটারের পাশাপাশি নিকটবর্তী তেঁতুলিয়ায় একশ’ ৪৯ ও সৈয়দপুরে একশ’ সাত মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। তার আগে সপ্তাহজুড়ে চট্টগ্রাম বিভাগেই সীতাকুন্ড, টেকনাফ, কুতুবদিয়া এলাকাতেই দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। এর মধ্যে কুতুবদিয়ায় মৌসুমের সর্বোচ্চ দুইশ ৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতও রয়েছে। গড়ে প্রায় প্রতিদিন বিভাগের অন্তত দুটি এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দুইশ’ মিলিমিটারের ঘর ছাড়িয়ে যায়। রবিবার থেকে পরিমাণের দিক থেকে তুলনামূলকভাবে কমে এলেও চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি অঞ্চলে যথারীতি ভারী বর্ষণ অব্যাহত ছিল। ওইদিন কুমিল্লায় বিভাগের সর্বোচ্চ একশ’ ৩৩, চট্টগ্রাম সদরে ৭৮, স›দ্বীপে ৫৭, সীতাকুন্ডে ৯৯, রাঙামাটিতে ৩৩, নোয়াখালীতে ৫০, ফেণীতে ৫১, কক্সবাজারে ৯২ এবং কুতুবদিয়ায় ৯৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। তবে, গতকাল সোমবার পুরো বিভাগের মাত্র তিনটি এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দুই অংকের কোটা পূরণ করতে সমর্থ হয়েছে। পরিমাণে ২১-২২ মিলিমিটারের ওই বৃষ্টিপাতকে হালকা মাত্রার হিসেবে বিবেচনা করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। চট্টগ্রাম বিভাগের বাইরে দেশের মধ্যাঞ্চল হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিভাগের নিকলিতেই সোমবার দিনের সর্বোচ্চ একশ’ ২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট ও রাজশাহী বিভাগে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে।
এদিকে, রেকর্ড ছাড়ানো ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাশাপাশি দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। সার্বিকভাবে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির ধারা অব্যাহত থাকলেও দেশে ‘ভয়াবহ বন্যা’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বিগত ১৯৮৮ কিংবা ১৯৯৮ এর মতো বড় বন্যার আশঙ্কা নেই বলে মনে করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, সাধারণত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার পানি একযোগে বাড়লেই দেশে বড় বন্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়। আপাতত তিন অববাহিকায় একইসঙ্গে পানি বাড়ার কোনও আলামত দেখছেন না সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, বাংলাদেশের উজানে ভারতীয় অংশে আর দেশের অভ্যন্তরে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ যাত্রায় বন্যার ব্যাপ্তিকাল এক সপ্তাহ পর্যন্ত হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ছ’টার পর থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টার জন্য প্রচারিত পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মৌসুমী অক্ষের বর্ধিতাংশ পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল অতিক্রম করে হিমালয়ের পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ওপর সক্রিয় এবং বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করছে। এর প্রভাবে রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়, রাজশাহী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। একইসঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি এবং পরবর্তী দু’দিনের আবহাওয়ার অবস্থায় বৃষ্টিপাতের প্রবণতা হ্রাস পেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।