বর্ণাঢ্য আয়োজনে শান্তিচুক্তির ২২ বছর পূর্তি উদযাপিত

37

পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২২ বছর পূর্ণ হলো গতকাল সোমবার। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। এ উপলক্ষে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়।
রাঙামাটি : পার্বত্য শান্তি চুক্তির বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাঙামাটিতে পৃথক কর্মসূচি পালন করেছে সরকার পক্ষ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। এসব কর্মসূচিতে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেন উভয় পক্ষ। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বলছে, চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলে জুম্ম জনগণের সঙ্গে মিথ্যাচার করছে সরকার। টানা এগারো বছর ক্ষমতায় থেকেও এ চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের। চুক্তি বাস্তবায়নে কালক্ষেপণের অভিযোগ তুলে তারা সরকারের তীব্র সমালোচনা করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তারা বলেন, জুম্ম জনগণের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। পেছনে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জুম্ম জনগণকে আবার ভাবতে বাধ্য হতে হচ্ছে। এ নিয়ে কঠোর আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
অপরদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চুক্তির বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। বাকি অংশ বাস্তবায়নাধীন। শান্তি চুক্তির ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় পাহাড়ে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়ন, শান্তি ও সম্প্রীতি সম্ভব হচ্ছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি আওয়ামী লীগ সরকারের বড় অর্জন। যা সম্ভব হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতা ও দূরদর্শিতার কারণে। আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য শান্তি চুক্তি করেছে। এ সরকারই এর অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়ন করেছে। সরকার ভূমি কমিশন আইন পাশ করেছে। চুক্তির বাকি অংশ বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতার আহবান জানান তারা।
দিবসটি উপলক্ষে গতকাল সোমবার সকালে রাঙামাটি জেলা শহরের জিমনেসিয়াম চত্ত্বরে গণসমাবেশের আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। সমিতির জেলা কমিটির সদস্য শ্যাম রতন চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গণসমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার। বক্তব্য রাখেন এমএন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের আহবায়ক বিজয় কেতন চাকমা, যুব সমিতির সাধারণ সম্পাদক অরুণ ত্রিপুরা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি জুয়েল চাকমা, হিল উইমেন্স ফোরেশনের সভানেত্রী আশিকা চাকমা প্রমুখ। সমাবেশের পর জিমনেসিয়াম চত্ত¡র হতে দলীয় কার্যালয় পর্যন্ত শোভাযাত্রা প্রদক্ষিণ করা হয়।
ঊষাতন তালুকদার বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার পার্বত্য চুক্তি করেছে। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছা না থাকায় গত ২২ বছরেও এ চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হতে পারেনি- যার ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। পার্বত্য চুক্তির পূর্ণবাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ে নতুন করে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে চুক্তিবিরোধীরা।
এদিকে দিবসটি উপলক্ষে সরকারের পক্ষে সকালে রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা করেছে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার। এ ছাড়া রাঙামাটি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইনুর রহমান, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ছাদেক আহাম্মদ, জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ, পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবির, সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য মো. কামাল উদ্দিন, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি চিংকিউ রোয়াজা ও সাধারণ সম্পাদক মো. মুছা মাতব্বর প্রমুখ বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা সভার আগে বঙ্গবন্ধু মুর‌্যাল হতে স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রাঙ্গণ পর্যন্ত এক শোভাযাত্রা প্রদক্ষিণ করা হয়। আলোচনা সভা শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া সন্ধ্যায় রাঙামাটি চিংহ্লামং মারি স্টেডিয়ামে সম্প্রীতির কনসার্ট আয়োজন করে রাঙামাটি রিজিয়ন ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ।
বান্দরবান : বান্দরবান সেনা রিজিয়নের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খন্দকার মো. শহিদুল ইমরান পিএসসি বলেছেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো অস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাসীরা ঘুরছে, চাঁদাবাজি করছে, উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। শান্তিপ্রতিষ্ঠা ও চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নে এখনো প্রতিবন্ধকতা সেই অস্ত্রধারীরা। সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজির এই সমস্যা থেকে উত্তোরণের জন্য সাধারণ মানুষকে সজাগ থাকতে হবে। গতকাল সোমবার সকালে জেলা শহরের স্থানীয় রাজার মাঠে শান্তি চুক্তির ২২তম বর্ষপূতির আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় বান্দরবান সেনা রিজিয়নের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খন্দকার মো. শাহিদুল এমরান পিএসসি, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দাউদুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকির হোসেন মজুমদার, জোন কমান্ডার লে. কর্নেল আখতার উস সামাদ রাফি পিএসসি, পার্বত্য জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সিং ইয়ং ¤্রাে, পার্বত্য জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এ টি এম কাউছার হোসেন, পৌর মেয়র মোহাম্মেদ ইসলাম বেবী, সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর, সিভিল সার্জন ডা. অংশৈপ্রæ মারমা, আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য শফিকুর রহমান, প্রেসক্লাব সভাপতি মনিরুল ইসলাম মনু, পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য লক্ষী পদ দাশসহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বান্দরবান জেলা প্রশাসন, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও সেনাবাহিনীর উদ্যোগে শান্তি চুক্তির বর্ষপূতি উপলক্ষে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হতে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে জেলা শহরের স্থানীয় রাজার মাঠে এসে সমবেত হয়। পার্বত্য এলাকার ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি সম্প্রদায় ও বাঙালিরা মিলে বর্ণিল পোষাক, ব্যানার এবং ফেস্টুন হাতে নিয়ে এতে অংশ নেয়। পরে রাজার মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এক আলোচনা সভা।
আলোচনা সভায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দাউদুল ইসলাম বলেন, এলাকায় বিদ্রোহ বা বিক্ষোভ জন্ম নেয় বঞ্চনা থেকে। একসময় পার্বত্যাঞ্চলে দারিদ্র্য ছিল। শান্তি চুক্তির পর থেকে ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে সেই বঞ্চনা দূর করার জন্য কার্যক্রম চালাচ্ছে সরকার।
পুলিশ সুপার জাকির হোসেন মজুমদার বলেন, সরকার চুক্তি করেছে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে অর্থনৈতিক বিকাশ, অবকাঠামো, যোগাযোগ, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নসহ সমস্ত ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সেই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী কাজ করে যাচ্ছেন। আর সেই শান্তি ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠায় পাহাড়ে সেনা-পুলিশ বিজিবি সহযোগিতা করে যাচ্ছে। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে আইন শৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে থাকতে হবে।
আলোচনা সভা শেষে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে দিনব্যাপী বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ বিতরণ করা হয়। চিকিৎসা শিবিরে সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চিকিৎসা সেবা ও বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণ এবং শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ করেন।
খাগড়াছড়ি : আনন্দ শোভাযাত্রা, শান্তি মেলা ও শান্তি কনসার্টসহ নানা আয়োজনে খাগড়াছড়িতে পালিত হলো পার্বত্য শান্তি চুক্তির বর্ষপূর্তি। দিবসটি উপলক্ষে জেলাজুড়ে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সকালে জেলার গুইমারাতে সেনাবাহিনীর ২৪ আর্টিলারি ব্রিগেড, গুইমারা রিজিয়নের উদ্যোগে গুইমারা মডেল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়ে উপজেলার প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে আর্মি স্টেডিয়ামে গিয়ে শেষ হয়। এসময় বেলুন ও শান্তি পায়রা উড়িয়ে বর্ষপূর্তির উদ্বোধন করেন গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শাহরিয়ার জামান। র‌্যালিতে গুইমারা ও মানিকছড়ি উপজেলার কয়েক হাজার পাহাড়ি-বাঙালি অংশগ্রহণ করেন। পরে আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিজিবি’র গুইমারা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মো. আবুদল হাই, সিন্দুকছড়ি জোন অধিনায়ক লে. কর্নেল রুবায়েত মাহমুদ হাসিব, উপজেলা নির্বাহী অফিসার তুষার আহামেদ, গুইমারা সদর ইউপি চেয়ারম্যান মেং মারমা প্রমুখ।
বক্তারা শান্তি চুক্তির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, শান্তি চুক্তির ফলে পাহাড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটিয়ে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। বর্তমান সরকার ও নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা শান্তির এ প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
বক্তারা বলেন, পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে একটি মহল অপ্রপচার চালিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। সবসময় সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তাই সবাইকে সজাগ থাকার আহবান জানান বক্তারা। অন্যদিকে জেলার রামগড়, মাটিরাঙ্গা, লক্ষী ছড়ি, দীঘিনালা, মহালছড়ি ও পানছড়িসহ পাহাড়জুড়ে নানা আয়োজনে দিবসটি পালিত হচ্ছে।