বর্জ্য কুড়িয়ে বৈদেশিক আয়

247

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) হিসেবে বছরে প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার ১১৮ টন প্লাস্টিকবর্জ্য সংগ্রহ করে সংস্থাটি। এসব অন্যান্য বর্জ্যরে সাথে ফেলে দেওয়া হয় ময়লার ভাগাড়ে। তবে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকবর্জ্য ব্যক্তি উদ্যোগে রিসাইক্লিং করে রপ্তানি করা হচ্ছে। এতে আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। নগরীতে এ রকম প্রায় অর্ধশত ‘প্লাস্টিক রিসাইক্লিং’ কারখানা রয়েছে বলে জানা গেছে।
সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন পূর্বদেশকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি নিজেই খোঁজ নিব। যদি লাভজনক হয়, অবশ্যই আমরা এ খাতে উদ্যোগী হব।
তিনি বলেন, প্লাস্টিকবর্জ্য নিয়ে এমন ধারণা আর কেউ দেয়নি। আমাদের এখানে লাখ লাখ টন প্লাস্টিকবর্জ্য ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয়। যেহেতু ফ্লেকস তৈরির প্রক্রিয়াটা সহজ। তাই আমাদের বিদ্যমান জনবল দিয়ে নতুন কিছু করা যাবে। তাছাড়া আমরা ডোর টু ডোর বর্জ্য সংগ্রহে নতুন পরিকল্পনা নিয়েছি। যেখানে প্রতিটি বাড়িতে দুইটি ডাস্টবিন থাকবে। একটি লাল রংয়ের আরেকটি সবুজ রংয়ের। লাল ডাস্টবিনটিতে প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য ফেলা হবে। এতে সহজেই প্লাস্টিকবর্জ্য আলাদা করা যাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিটি কর্পোরেশন এ শিল্পে দু’ভাবে জড়িত হতে পারে। প্রথমত সংগৃহীত প্লাস্টিকবর্জ্য কারখানাগুলোতে সরবরাহ করা। আবার কর্পোরেশন নিজেই এমন কারখানা করে আয় বাড়াতে পারে।
বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ-সার উৎপাদন নিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সাথে সমঝোতা চুক্তি করেছে চসিক। সর্বশেষ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাথে চুক্তি করেছে সংস্থাটি। তবে এতে আশার আলো দেখাতে পারেনি সিটি কর্পোরেশন।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সিটি কর্পোরেশন যে পরিমাণ প্লাস্টিকবর্জ্য সংগ্রহ করতে পারে, তার দ্বিগুণ প্লাস্টিকবর্জ্য নদী-নালায় পতিত হয়। যার কারণে একদিকে নদী দূষণ হচ্ছে, অন্যদিকে খাল-নালা ভরাট হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। আর এর খেসারত হিসেবে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিভিন্ন সেবাসংস্থা।
তারা বলেন, প্লাস্টিকবর্জ্য রিসাইক্লিং করা না গেলে এ শহরে কোন প্রকল্পই জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান করতে পারবে না।
নগরীর দক্ষিণ বাকলিয়া শহিদ এমজে কলেজ রোডের কয়েকটি ‘প্লাস্টিক রিসাইক্লিং’ কারখানা সরেজমিনে দেখা গেছে, সিটি কর্পোরেশনের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকবর্জ্য থেকে ব্যক্তি উদ্যোগে আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। উদ্যোক্তারা নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্লাস্টিকবর্জ্য কিনে নেন। যেগুলো টোকাইসহ বিভিন্ন ব্যক্তিরা সংগ্রহ করেন। তা আবার কয়েক হাত পার হয়ে কারখানায় পৌঁছে। কারখানায় এসব বর্জ্য প্রকার ভেদে কেজিপ্রতি ৩৬ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়। এসব সংগ্রহ শেষে রং অনুযায়ী বোতল, প্রকার অনুযায়ী অন্যান্য প্লাস্টিক বর্জ্য আলাদা করা হয়। তারপর সেগুলো থেকে লেভেল ও ঢাকনা খুলে নেওয়া হয়। প্রতিটি কারখানায় কাটিং মেশিন রয়েছে। সেখানে প্লাস্টিকবর্জ্য ভেঙে ছোট ছোট অংশে পরিণত করা হয়। একে ‘ফ্লেকস’ বলা হয়। প্লাস্টিকের এ ছোট অংশগুলো পানি দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। তবে পানির সাথে সোডা বা কস্টিক সোডা মেশানো হয়। যাতে ভালভাবে পরিষ্কার হয়। এরপর এসব ‘ফ্লেকস’ রোদে শুকানো হয়। সবশেষে এসব ফ্লেকসই বিদেশে রপ্তানি হয়।
পেট ফ্লেকস বা বোতল কুচি বিদেশে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথমে উন্নতমানের কেমিক্যাল দিয়ে পরিষ্কারের পর মেশিনে গলিয়ে মন্ড করা হয়। এরপর পুনরায় নতুন প্লাস্টিক বোতল তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া পেট প্লাস্টিক মÐ থেকে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের ফাইবার বা তন্তু। যা প্যাড, পুশন,ব্লাংকেট, ভ্যানিশিং ব্ল্যাক ও গাড়ির সিটে ব্যবহৃত মখমল তৈরির কাজে ব্যবহার হয়।
শহীদ এমজে কলেজ রোডের একটি প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানা ‘ভাই ভাই প্লাস্টিকস’। এ কারখানার কর্ণধার মাওলানা আনিছ ১২ বছর ধরে এ ব্যবসা করছেন। তিনি পূর্বদেশকে প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ে সম্ভাবনা ও সমস্যার কথা জানান।
মাওলানা আনিছ বলেন, বর্তমানে সম্ভাবনাময় এ শিল্পকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে প্রায় ৫০টি ছোট বড় কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। চীনে আমাদের দেশ থেকে রিসাইক্লিং করা প্লাস্টিকের ৯০ শতাংশ রপ্তানি হয়। এছাড়া নতুন করে রপ্তানি হচ্ছে ভারত, ভিয়েতনাম এবং তুর্কি। বিদেশে রপ্তানি ছাড়া দেশে তৈরি হয়েছে প্লাস্টিক ফ্লেকস্রে বাজার। ঢাকায় আরএফএল ও চট্টগ্রামের এন মোহাম্মদ গ্রুপ বোতল ছাড়া গৃহস্থালী পণ্যের ফ্লেকস্ কিনেন। একদিকে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকবর্জ্য রিসাইক্লিং থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে।
এ শিল্পে সমস্যার কথা জানাতে গিয়ে এ উদ্যোক্তা বলেন, শহর ও গ্রাম থেকে আমাদের কারখানায় প্লাস্টিকবর্জ্য আসে। তবে মোড়ে মোড়ে পুলিশের চাঁদাবাজিতে সংগ্রহ দিন দিন কমছে। তাই যারা এসব বর্জ্য নিয়ে আসেন, তাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আমরা বাজার বুঝে ক্রয় করতে পারি। তাই এ সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
তিনি বলেন, দক্ষিণ বাকলিয়া সিটি কর্পোরেশনের কোন ডাস্টবিন নেই। ফলে আমাদের এখানে সৃষ্ট বর্জ্যগুলো কোথাও রাখতে পারি না। তাই আপাতত কলেজের পাশে খালি জায়গায় পোড়ানো হয়।
তিনি আরও বলেন, চীন এখন ‘হট ওয়াশ ফ্লেকস্’ আমদানির দিকে ঝুঁকছে। আমাদের পুঁজি কম। এখন বাজারে যদি হট ওয়াশ ফ্লেকস্রে চাহিদা বেড়ে যায়, তাহলে আমরা বিপদে পড়ে যাবো। তাই সরকার যদি আমাদেরকে সহায়তা করা হয়, তাহলে এ শিল্প অনেক দূর এগিয়ে যাবে।