বরিস জনসন : সাংবাদিকতা থেকে ডাউনিং স্ট্রিটে

28

দেড় যুগের সাংবাদিকতা আর রাজনৈতিক জীবনের নানা উত্থান-পতন পেরিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে চলেছেন বরিস জনসন। ঘনিষ্ঠ মিত্রদের ‘বিশ্বাসঘাতকতায়’ মাত্র কয়েক বছর আগেও যার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের শেষ দেখা যাচ্ছিল, যার উল্টোপাল্টা মন্তব্য অনেকবারই করজারভেটিভ নেতৃত্বকে বিব্রত করেছে, অবশেষে সেই জনসনই যাচ্ছেন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে। মঙ্গলবার ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি তাদের নতুন প্রধান হিসেবে ৫৫ বছর বয়সী সাবেক এ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করে। ব্রেক্সিট নিয়ে বেহাল দশায় জুনে টেরিজা মে ক্ষমতাসীন টোরি দলের নেতৃত্ব ও প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর কয়েক সপ্তাহের নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষে ‘কট্টর ব্রেক্সিটপন্থি’ জনসন ওই পদগুলোতে স্থলাভিষিক্ত হলেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে জনসনের প্রতিদ্ব›িদ্বতা ছিল বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্টের সঙ্গে। তবে দলের নিবন্ধিত কর্মী-সমর্থকরা শেষ পর্যন্ত লন্ডনের সাবেক মেয়রকেই বেছে নিয়েছেন।
রাজনীতিতে আসার আগে স্ট্যানলি বিশ্ব ব্যাংক ও ইউরোপিয়ান কমিশনে কর্মরত ছিলেন। জনসনের নানা স্যার জেমস ফসেট ইউরোপিয়ান মানবাধিকার কমিশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সাল থেকেই জনসন ম্যাগাজিন ‘দ্য স্পেকটেটরে’ রাজনৈতিক কলাম লেখা শুরু করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ম্যগাজিনটির সম্পাদক হন; এ দায়িত্বে তিনি ছিলেন ২০০৫ পর্যন্ত। টেলিগ্রাফে থাকার সময়ই ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে কনজারভেটিভ প্রার্থী হিসেবে হাউস অব কমন্স নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন জনসন। সেবার লেবার পার্টির মার্টিন জোন্সের কাছে পরাজিত হন। ১৯৯৮ থেকে জনসনকে বিবিসি’র ‘হ্যাভ আই গট নিউজ ফর ইউ’সহ টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জনসনকে দেখা যেত; বিব্রতভাব এবং মাঝে মাঝেই উল্টোপাল্টা মন্তব্যের কারণে তিনি টক শো’র জনপ্রিয় মুখে পরিণত হন। ২০০১ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে হেনলি অন টেমস আসনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে বিজয়ী হন এ কনজারভেটিভ সদস্য। টেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেওকুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল শহরের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য এর কোনোটাই ২০০৫ এর নির্বাচনে তার ফের জয়ী হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
দুই বছর লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে অপরাধ দূর ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রতিশ্রæতি দিয়ে বাজিমাত করেন জনসন। সেবার লেবারের কেন লিভিংস্টোনকে সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে তিনি যুক্তরাজ্যের রাজধানীতে রক্ষণশীলদের অভাবিত জয় এনে দিয়েছিলেন। ২০১২ সালের নির্বাচনে ফের লিভিংস্টোনকে হারিয়ে দলকে দিয়েছিলেন স্বস্তি; মধ্যবর্তী নির্বাচনে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসে ৮০০-র বেশি আসন হারিয়ে কনজারভেটিভ পার্টি তখন হাঁসফাঁস করছিল। ২০০৭ সালের মেয়র নির্বাচনে দাঁড়িয়ে সংসদ সদস্যপদ ছেড়ে দেওয়ার আট বছর পর ২০১৫ সালে পশ্চিম লন্ডনের উক্সব্রিজ অ্যান্ড সাউথ রুই¯িøপ আসনে জয়ী হয়ে ফের পার্লামেন্টে ঢোকেন জনসন। ১৯৯০ এর পর সেবারই কনজারভেটিভ পার্টি যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতাগ্রহণ করে।
লন্ডনের পরের মেয়র নির্বাচনে আর দাঁড়াননি জনসন; তার বদলে থাকা কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থীকে হারিয়ে শহরটির মেয়র পদে নির্বাচিত হন সাদিক খান। মেয়রের দায়িত্ব ছাড়ার আগেই জনসন হয়ে ওঠেন যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে থাকা অন্যতম প্রভাবশালী প্রচারক।
ইউরোপকে এক করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেষ্টাকে নেপোলিওন ওয়ান ও অ্যাডলফ হিটলারের চেষ্টার সঙ্গে তুলনা করে বেশ সমালোচিতও হন তিনি। ২০১৬-র ২৩ জুনের গণভোটে যুক্তরাজ্যের ৫২ শতাংশ ভোটার ‘ব্রেক্সিটের’ পক্ষে মত দিলে, ডেভিড ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেন। অনেকেই তখন জনসনকেই নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখলেও তৎকালীন বিচারমন্ত্রী মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠদের অনেকেই লন্ডনের সাবেক এ মেয়রের পাশ থেকে সমর্থন তুলে নেন। জনসন সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারবেন না এবং ব্রেক্সিট সম্পন্নে কাজ করতে পারবেন না মন্তব্য করে গোভ নিজেই নিজের নাম প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। ঘনিষ্ঠ আরও কয়েকজন প্রভাবশালী সাংসদ গোভকে সমর্থন দিলে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেন জনসন।
পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ এবং রাজনীতিতে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা ক্যামেরন, জনসন ও গোভের ‘একে অপরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার’ চিত্রকে সেসময় শেকসপিয়ারের কাহিনীর সঙ্গে তুলনা দিয়েছিল ব্রিটিশ গণমাধ্যম। টেরিজা মে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি জনসনকে তার মন্ত্রিসভার পররাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্ব দেন। ২০১৭ সালের জুনে অনুষ্ঠিত আগাম নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর মে-র সংখ্যালঘু সরকারের মন্ত্রিসভায়ও জনসনের পদ বহাল থাকে। পরের বছর ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে পাশ কাটিয়ে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের যৌথ বিমান হামলায় বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করলেও জনসন মে-কে অকুণ্ঠ সমর্থন দেন। সিরিয়ার সাধারণ মানুষের ওপর সরকার রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে এমন অভিযোগে দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সমর্থিত বাহিনীর ওপর ওই বিমান হামলা হয়েছিল।
২০১৮ সালের মার্চে যুক্তরাজ্যে পক্ষত্যাগী এক রুশ গুপ্তচর ও তার মেয়ের ওপর হামলার ঘটনায় ব্রিটিশ সামরিক পরীক্ষাগার ব্যবহৃত নার্ভ এজেন্ট ‘নোভিচক’ রাশিয়া থেকে এসেছিল এমন জানিয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন জনসন। যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরীক্ষাগার হামলায় ব্যবহৃত নার্ভ এজেন্টটি সোভিয়েত আমলের ‘নোভিচক’ হিসেবে চিহ্নিত করলেও, এটি যে রাশিয়া থেকেই এসেছিল এমন কিছু নিশ্চিত করেনি। জনসন সামরিক পরীক্ষাগারের বক্তব্যকে ভুলভাবে হাজির করে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছিলেন বলে বিরোধীরা সেসময় অভিযোগও করেছিল। ওই ঘটনায় পরে লন্ডন কয়েক ডজন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কারও করে। ব্রেক্সিট কার্যকরের পন্থা নিয়ে মে-র সঙ্গে লন্ডনের সাবেক এ মেয়রের সুস্পষ্ট দূরত্বের বিষয়টিও দিন দিন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গতবছরের জুলাইয়ে ব্রেক্সিটের খুঁটিনাটি নিয়ে মে তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে অবকাশযাপন কেন্দ্র চেকারে বসলে সেখানেই প্রধানমন্ত্রীর নমনীয় অবস্থানের সঙ্গে অন্যদের বিরোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। ৮ জুলাই মে-র মন্ত্রিসভার ব্রেক্সিট বিষয়ক মন্ত্রী ডেভিড ডেভিস পদত্যাগ করলে পরদিন একই পথ ধরেন জনসনও। পদত্যাগপত্রে ব্রেক্সিট নিয়ে মে-র পদক্ষেপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মধ্যস্থতার পন্থারও তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। জেরেমি হান্ট পরে জনসনের স্থলাভিষিক্ত হন।