বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে

234

সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনটা মনে হয় ইদানীং আমাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যা না তা করতে গেলে যে অনেক সময় হাসির পাত্র হয়ে যেতে পারি তা মনে হয় আমরা ভুলে যাই। মনে পড়ে গেল বক্স অফিস কাঁপানো ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘কুচ কুচ হোতা হে’ ছবির কাহিনী। অঞ্জলি খুব সাধারণ একটি ভারতীয় মেয়ে সালোয়ার-কামিজ পরে কলেজ যায়, খেলাধুলাও করে ঐ একই ড্রেসে। তবে কলেজের স্মার্টবয় রাহুলের প্রতি মনে মনে অঞ্জলি অতি দুর্বল ফলে তার চোখে নিজেকে তুলে ধরতে অঞ্জলির নানান কসরত। কিন্তু কোনভাবেই সে রাহুলের মন জয় করতে পারেনা, একদিন কলেজে এলো শর্টস আর মিনি পরিহিতা প্রিন্সিপ্যালের অতি আধুনিকা তরুণী কন্যা টিনা। যেমন সুন্দরী তেমন গ্ল্যামার উপরন্তু সে অক্সফোর্ড ফেরত, দেশের টানে চলে এসেছে দেশের কলেজে পড়বে বলে, আর প্রথম দর্শনে সে রাহুলের হৃদয় কেড়ে নিল। টিনা সবসময় শর্টস, টপস, মিনি, মিডি- এসব পরেই থাকে রাহুলকে টিনার প্রতি বেশি মনোযোগী দেখে অঞ্জলিও একদিন কলেজে টিনার মতো টপস, মিনি পরে এলো। ফলে সকলে দেখে তাকে হাসতে লাগলো, অঞ্জলি তাতে বড় লজ্জা পেল লজ্জায় সে কেঁদে ফেলল। শেষে রাহুল এসে তাকে সান্ত¦না দিল; তুমি যেমন আছ তাতেই তুমি অনেক সুন্দর, কেন শুধু শুধু ওসব পরতে গেলে, আর কখনো অমন করো না এমনিতেই তোমাকে অনেক সুন্দর লাগে। রাহুলের কথায় অঞ্জলি শান্ত হলো আর কখনো অমন পোশাক পরেনি। বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়েÑ আসলে যার যেখানে অবস্থান তাকে সেখানে মানায়। অবস্থান পরিবর্তন হলেই আর কদর থাকে না কারণ পরিবর্তিত অবস্থানটি সে নিজেও ধরে রাখতে পারেনা। এমন কি দেবতারা চাইলেও না, এ পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প ‘ইচ্ছাপূরণ’ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
সুবলচন্দ্রের ছেলে সুশীলচন্দ্র, তবে নামের সাথে কামের কোন মিল নাই। সুবল ছিলেন বড়ই দুর্বল আর সুশীল ছিল বড়ই গতিশীল, দুরন্ত, দুর্দান্ত ও অশান্ত। স্কুলে যায় না, পড়াশুনা করে না, মানুষের জিনিসপাতি নষ্ট করে, ছেলেকে নিয়ে তাই সুবল বড়ই দুশ্চিন্তায় আছে। একদিন ছেলের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ সুবল ছেলেকে ঘরে বেঁধে রাখল। কেঁদে কেঁদে সুশীল ভাবছে; ইস্ আজ আমি যদি বাবার মতো বড় হতাম তাহলে ইচ্ছা মতো চলতে পারতাম কেউ কোন বাধা দিতে পারতনা, কিছু বলতে পারতনা। ওদিকে সুবল বসে বসে ভাবছে; আহা ছেলেটি আমার নিজের ভালো বুচ্ছেনা আজ যদি আমি ছেলেবেলা ফিরে পেতাম তাহলে অনেক লিখাপড়া করতাম একটুও সময় নষ্ট করতাম না। বাপ-ছেলে যখন এ চিন্তা করছিল ঠিক তখন ইচ্ছাটা করুন সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন ফলে তাদের মনের কথা তিনি জানতে পারলেন। ঘরে এসে তিনি তাদের বললেন; তোমাদের ইচ্ছা পূরণ করছি কাল সকালে তোমরা যে যা হতে চাও তা হয়ে যাবে। সকালে দেখা গেল সুবল বালক হয়ে গেছে, সুশীল বুড়া হয়ে গেছে, ইচ্ছা পূরণ হয়েছে দেখে দুজনেই ভারি খুশী এখন মন যা চায় তাই করতে পারবে ডাক দেওয়ার কেউ নাই। কিন্তু কয়েকদিন যেতেই ধরা খেয়ে বসল দুজন, দেখাগেল সুশীল যা ইচ্ছা তা করতে পারছেনা, তার খেলতে ইচ্ছা করছে, লাফাতে ইচ্ছা করছে, ঝাঁপাতে ইচ্ছা করছে, দৌড়াতে ইচ্ছা করছে পারছে না, বুড়া শরীর সায় দিচ্ছে না। ওদিকে সুবল যা চিন্তা করে ছিল তার কিছুই তার করতে ইচ্ছা করছেনা। পড়ালিখা করতে ইচ্ছা করছেনা, স্কুলে যেতে ইচ্ছা করছেনা, শুধু খেলাধুলা করতে ইচ্ছা করে, তামাক খেতে ইচ্ছা করে, তাস-পাশা খেলতে ইচ্ছা করে। পুরনো অভ্যাসবশতঃ বড়দের গায়ে হাত তুলে বসে, মাস্টারকে নির্দেশ দিয়ে বসে ফলে পিটুনি খেতে হয়।
দুজন পড়ল এক উদ্ভট ঝামেলায়, কোনভাবেই নতুন পরিস্থিতির সাথে তারা নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারছিলনা তাই আবার তারা আগের অবস্থায় ফিরে আসতে চাইল। ইচ্ছাঠাকরুন তাদের সে অভিলাষ পূরণ করলেন তারা পুনরায় তাদের পূর্বাবস্থায় ফিরে এলো। নদীর এ কূল কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস ও কূলেতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস। তার মানে কি? মানে পরিষ্কার শান্তি কোথাও নাই, সুবলের শান্তি নাই, সুশীলের শান্তি নাই, অঞ্জলির শান্তি নাই মোটকথা কারো মনে শান্তি নাই। তবে দেখা যায় যার যত বেশি শান্তি তার তত কম, এ জগতে হায় সে’ই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি। সত্য বলতে কি কবিগুরু একটি জিনিস, যা বলেছেন তা’ই বাস্তব অবশ্য তাঁর কথাগুলো মনে হয় যেন প্রকৃতি হতে উঠে এসেছে। কিন্তু এখন বেশি মনেপড়ছে জালালুদ্দিন রুমীর উক্তিটি; কাল আমি ছিলাম চালাক তাই দুনিয়াকে বদলে দিতে চেয়ে ছিলাম, আজ হলাম আমি বিজ্ঞ তাই নিজেকে বদলে ফেলতে চাইছি। মাশাল্লাহ্ কেমন কথা, তবে মনে রাখতে হবে নিজেকে বদলেফেলা মানে নিজের ভেতরটাকে বদলানোর কথা বলেছেন উপরকে নয়। এখন সমস্যা হচ্ছে আমরা শুনতে পাই আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর আসামিকে জেলে দেওয়া হয় শুধরানোর জন্যে। অর্থাৎ সঠিক অর্থে তা জেলখানা নয় সংশোধনাগার, মূলত দেখা যায় অন্য চিত্র, চোর হয়ে ঢুকে ডাকাত কিংবা সন্ত্রাসী হয়ে বের হয়। মতলব সে কাল ছিল চালাক তাই চুরি করত, আজ হয়েছে বিজ্ঞ তাই ডাকাতি করবে, হায় খোদা! এই যদি হয় অবস্থা মৌলানা রুমী যদি বেঁচে থাকতেন তিনি তো তাহলে লজ্জাতে মুখ লুকাতেন। কারণ তিনি বলতে চেয়েছেন কি আর আমরা বুঝছি কি, সংশোধনাগারে সংশোধিত না হয়ে সবে সংলব্ধ হয়ে উঠছে। ফলে যার যা করার কথা তা সে করছেনা এবং যা না করার কথা তা করছে সে জন্যে শুরু হচ্ছে অস্থিরতা কেউ আর অল্পতে তুষ্ট হতে পারছেনা। সবার শুধু চাই শুধুই চাই এবং তার জন্যে অত্যন্ত সস্তা হাতিয়ার রাজনীতিকে ব্যবহার করছে, না না ব্যবহার নয় অপব্যবহার করছে। মনে হয় সল্পতে সন্তুষ্টির বেলায় কাবুলি পাঠানরাই বেশি এগিয়ে, তারা নাকি অল্পতে খুশী।
সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন কাবুলিরা বড় আড্ডাবাজ জাতি। গাড়িতে সৈয়দ সাহেবের সাথে এক সর্দারজীর পরিচয় ঘটে, কথা প্রসঙ্গে তিনি সর্দারজীকে জিজ্ঞেস করেন; শিলওয়ার বানাতে কয়গজ কাপড় লাগে? সর্দারজী; দিল্লীতে সাড়ে তিন, জলন্ধরে সাড়ে চার, লাহোর সাড়ে পাঁচ, লালামুসায় সাড়ে ছয়, রাওয়ালপিন্ডি সাড়ে সাত, তারপর পেশাওয়ারে এক লাফে সাড়ে দশ, খাস পাঠানমুল্লুক কোহাট খাইবারে পুরো থান। চোখ কপালে তুলে সাহেব; বিশ গজ! সর্দার; হ্যাঁ। সৈয়দ সাহেব; খামখা কতগুলো বাজে খর্চা। সর্দার; ‘আপনি কি মনে করেন পাঠান প্রতি ঈদে নতুন শিলওয়ার তৈরি করে? মোটেই না, ছোকরা পাঠান বিয়ের দিন শ্বশুরের কাছ থেকে বিশগজী একটি শিলওয়ার পায়। বিস্তর কাপড় থাকায় এক জায়গায় চাপ পড়ে না, ফলে বহুদিন টিকে। ছিঁড়তে আরম্ভ করলে পাঠান গোড়ার দিকে সেলাই করে, পরে তালি লাগাতে শুরু করে, সে যে কোন রঙের কাপড় দিয়েই হোক, পাঠানের তাতে বাছবিচার নাই। বাকী জীবন ঐ শিলওয়ার পরেই কাটায় এবং মরার সময় ছেলেকে দিয়ে যায়। ছেলেও বিয়ের সময় শ্বশুরের থেকে নতুন শিলওয়ার একটি পায় বটে কিন্তু ততদিন বাপেরটায় কাজ সারে।’ এবার তাহলে বুঝুন সন্তুষ্টি কাকে বলে। তবে আমরা তেমন তুষ্টির কথা বলছি না কারণ ওটা বেশি কার্পণ্যর খাতায় চলে যায়। কাবুলিরা নাকি বড় কৃপণ হয় সেই সাথে বড্ড অপরিষ্কারও, তাদের গায়ের থেকে নাকি বিশ্রী ভোঁটকা গন্ধ বের হয়। এই বাক্য শোনে কেউ একজন বলেন, ‘কে বলল তোমায় ইহুদি আফগানের চেয়ে পরিষ্কার? ইহুদির গায়ের গন্ধে বোকা পাঁঠা পর্যন্ত লাফদিয়ে দরমা ফুটো করে প্রাণ বাঁচায়’Ñ মুজতবা আলী। পৃথিবীতে অনেক জাতি আছে প্রচুর নোংরা তারা, নানা অখাদ্য, কুখাদ্য সব খায়, যেমন চীনারা সাপ, ব্যাঙ, তেলাপোকা সব খায় কিছুই বাদ রাখেনা। আফ্রিকা ও আমাজানে অনেক উপজাতি আছে যারা নরমাংস খায়, তারাও মানুষ, তাই বলে কিন্তু তারা উদাহরণ হতে পারেনা।
আফগান আর ইহুদির গায়ে গন্ধ, সমস্যা নাই তা তাদের মানায় কারণ কাবুলে বৃষ্টি হয় তিন ফোঁটা আর বেথেলেহেমে আড়াই ফোঁটা। তাদের কোন মিঠা পানির নদ-নদী নাই, মৌসুমী বায়ুও নাই। ফলে পরিষ্কারের জন্য অত জল তারা পাবে কোথায়? অপরদিকে আমাদের রয়েছে বিশাল বিশাল নদ-নদী, তাতে রয়েছে মিঠা পানির প্রচুর সমাহার। রয়েছে মৌসুমী বায়ুর বিপুল সম্ভার ও প্রবল মুসলধারে বৃষ্টি তাই আমাদের জলের কোন অভাব নাই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আমাদের নিত্য অনুশীলনের অংশ। আমাদের জন্যে প্রতিদিন গোসল না করা হচ্ছে কৃপণতা আর তাদের জন্য মিতব্যয়িতা, যে দেশ সে আচার মেনে চলা দরকার। এবার আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব ঈশপের একটি গল্প বলি: ‘একটি গাধার মনে দুষ্টু বুদ্ধি গজালো, সে কোত্থেকে একটি সিংহের ছাল যোগাড় করলো। ছালটি গায়ে দিয়ে সে বনের পশুদের ভয় দেখাচ্ছিল। তাকে দেখে সবাই ভয়ে পালাচ্ছিল, হঠাৎ এক দমকা বাতাসে তার ছদ্মবেশটি খুলে গেলো। তাতেই তার স্বরূপ সবাই জেনে ফেলল এবং সকলে মিলে গাধাটাকে মেরে ফেলল।’ গল্পটির শেষে নীতিবাক্যে বলা হয়েছে, চিরকাল কেউ কাউকে ঠকাতে পারেনা। আমরা মাঝেমধ্যে দেখি সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্যে কেউ হঠাৎ একদিন রাস্তা ঝাড় দিলেন, কেউ হেঁটে অফিসে গেলেন, কেউ বসে ভিক্ষুকের সাথে ভাত খেলেন। তারপর সে ছবি ফেসবুকে ছেড়ে দিলেন, ফল হলো কেউ একজন অতি যত্ন সহকারে বিরিয়ানী পাকাল, খাওয়ার সময় তাতে একবিন্দু বিষ্ঠা পড়ল।
আসলে আমি যা তা থেকেই জনহিতকর হাজারো কাজ করার স্কোপ রয়েছে, তার জন্য রাস্তা ঝাড়ু দেয়ার দরকার নাই, বাইকে চড়ার দরকার নাই। খামখা পাবলিকের নজর কাড়তে নিজেকে ক্রাউন থেকে ক্লাউন বানিয়ে ফেলার কোন অর্থই হয় না। যার যেখানে ঠাঁই তাকে সেখানে মানায়, তাই বলা হয়, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’

লেখক : কলামিস্ট