বধূ দর্শন

114


বধূ দর্শন চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটা প্রাচীনতম ঐতিহ্য। এর প্রচলন যে, কখন কার হস্তধরে প্রচলিত হয়েছে এর আদ্যন্ত ইতিহাস অজ্ঞাত। আজকালকার ইঁচড়ে পাকা তরুণদের কাছে বধূদর্শন এমন স্থানে গিয়ে অবস্থান করেছে যার বৌ সে দর্শন করবে। এতে পিতা-মাতার মতামত গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। এমন কি হোটেল রেস্তোরাঁ, পার্ক বা সিবীচে গিয়ে আপন হবু বধূর দর্শনে এবং পরস্পর একান্তে মনোম্মক্ত করে বাক্য বিনিময়টা আড়চক্ষুর চক্ষুশুল হলে ও তাতে কিছু আসে যায় না। এটা এমন যে, মিত্রতা-বিবি তো রাজি ক্যায়া করেঙ্গা কাজী? ‘বধূ দর্শনে আবেগ আছে, প্রত্যাশা আছে, আছে বিষাদ মিশ্রিত ঘটনা। কন্যা পক্ষ বরপক্ষের নির্দেশ পালনে করণীয় কার্য সমাপ্তর পর ও ইস্টনাম যপতে যপতে যপতে কন্ঠের পানি শুকিয়ে মরুময় করে অপেক্ষারত থাকে, বধূদর্শন পর্ব সফলতা মুখ দেখতে সক্ষম হবে কি না ? ঘটক পূর্ব থেকে ইঙ্গিত দিয়ে রাখে কনে যদি বরের পছন্দই হয় তবে বর হবু কনের আগুলে স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দেবে। এমনটি বাস্তবে দৃশ্যমান হলে তবে কন্যা পক্ষের মুখজুড়ে হাসির জোয়ার বিদ্যমান থাকে। আর যদি এর বিপরীত অবস্থান করে কন্যাপক্ষের মুখ কৃষ্ণপক্ষের মতো আঁধারে ঢেকে যায়। অর্থাৎ বধূ দর্শনে বরের পছন্দ-অপছন্দই অগ্রাধিকার প্রাপ্ত। তাই কনের মা-বাপ হওয়াতেই যেন মহা বিপর্যয়ের কাছে হার মানা। কন্যা জন্মদান যেন এক পাপের প্রায়শ্চিত্ততা।
এতে বর্তমানের পরিবারের গন্ডিতে ঘটমান বিষয়। একটা বর জোগাড় করতে গিয়ে কনের পক্ষকে যে কত কাঠখড় পোড়াতে হয় তা তাদের জ্ঞাত বিষয়। ষাট দশক বা এরও পূর্বে বধূদর্শনে বরের ভূমিকা গৌন। বরের জন্য বধূ দর্শন এবং নির্বাচন যথেষ্ট উপভোগ্য ছিলো। বরের মা, চাচি, মামি, দাদি এ প্রকারের মুরুব্বি মহিলারা বধূ দর্শনে এবং নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা পালন করতো।
একটা নির্ধারিত দিনক্ষণে বধূদর্শনে আয়োজন হয়। বধূ নির্বাচনের চাবিকাঠি তাদের পছন্দের ওপর নির্ভরশীল। সাদা মাটা সাজ-গোজ মিষ্টির পাতিল হস্তে একে একে ঘোড়ার গাড়ি চেপে হবু বেয়াইবাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রারম্ভ হয়। গন্তব্যে পৌঁছাতেই কনে পক্ষের পুরুষ-মহিলাগণ ঘাঁটার দুয়ারের সম্মুখ থেকে স্বাগতম জানিয়ে ঘরে নিয়ে যেতো। এর পূর্বের ঘরের মেঝেতে শীতল পাটি বিছানো থাকতো, তার ওপর হাতের কারুকাজ খচিত চাদর বা সতোরজিত। দুই দিকে নকশী করা দুটো বালিশ। যার গায়ে ময়ুরের নকশা তখায় লিখিত আছে মধুর মিলন। হাতে বানানো নকশা সম্বলিত হাত পাখা। এ সব আমাদের প্রচলিত সংস্কৃতির অংশ। বর পক্ষের মনোতুষ্টের তাগিদে কনে পক্ষের কেউ কেউ দস্তায়মান হয়ে বিচৈন(হাতপাখা) নাড়তো। নায়পাস্তার পরিবেশনের পূর্বে দস্তরখানা বিছিয়ে তৎউপরে কুঞ্চিতে করে বিভিন্ন পদের হাত বানানো নাস্তা একে একে প্লেটে করে সাজিয়ে রাখা হতো। নাস্তার মধ্যে চাঁসা পিঠা, সৈঁ পাক্কোন পিঠা, নকশী পিঠা, পুয়া পিঠা, খাজা, অর্থাৎ যা দেখলে অন্ততঃ বরপক্ষের চোখেলাগে। এরপর পরপক্ষদেরকে জোড় করে হস্তে নাস্তা তুলে দেয়া এবং লুইত করা (যত্ন করা)’র কমতি হতোনা হবু নব্য কুঠুম্ব করার জন্য, সর্বশেষে হবু বধূ সুদর্শন তালিতে করে পান পরিবেশনে আসতো। কারণ চটিপড়ে মুরুব্বিদের সমীপে আসা দৃষ্টিকটু। নতুন শাড়িতে সারা দেহ আবৃত্ত, অর্থাৎ আব্র কোন প্রকারেই নষ্ট হতে পারবে না তখন বিউটিশিয়ানদের কৃত্রিম সাজগোজের বালাই ছিলো না, দেশি প্রসাদনীর মাধ্যমে যতটুকুই আকর্ষণীয় করা যায় আর কি ? বধূ দর্শনে বরপক্ষের মহিলা দর্শনার্থীরা জাঁদরেল অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। পানের থালি রাখার পর এবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বধূদর্শনের পালা।
ত্রয়োদশবর্ষী একটা শান্তশিষ্ট বালিকা, তাকে মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা অর্থাৎ আপাদমস্তক তীক্ষè, দৃষ্টিতে নিরক্ষণ করতো বৃদ্ধা দর্শনার্থীরা, প্রথম কপাল দর্শন- কপালে দু’ধরণের অর্থাৎ চান কপালী, মালা কপালী। চান কপালীর বধূ ভাগ্যবতী বলে ধারণা প্রচলিত ছিলো। অর্থাৎ কপালের আশে পাশে চুলের পাতলা অবস্থান। দেখতে মায়াময়ী। এ ধরনের মহিলারা আসলে ভাগ্যবতী তাই রুজিরোজগার স্বামীর জয় জোয়ারে সংগঠিত হয়।
হবু বধূর চক্ষুযুগল মায়ামৃগের চক্ষুর মতো টানা চক্ষুকিনা কপালে জোড়ব্রুর উপস্থিতি আছে কিনা, চিকন ওষ্ট কিনাম মুখোছিদ্র ছোট কিনা, মাথা ঘন কালো কুন্তল (চুল) সমৃদ্ধ যা নিতম্ব পর্যন্ত বেয়ে নিছে নেমে পড়েছে কি না ? এমন ধরনের মহিলারা নাকি পদ্মিনী মহিলা, পদ্মিনীরা নাকি সুবোধ ও স্বামী ভক্তির হয়। এসব বৃদ্ধাদের দৃষ্টিতে নারী নাকি তিন প্রকৃতির হস্তিনী, মদ্দিনী, পদ্মিনী। পদ্মিনী নারী বাচবিচারে অগ্রগণ্য হবু বধূর হস্তে পরীক্ষা করতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে হাতের আঙ্গুল চিকন ও কলসী প্রকৃতির কিনা ? মেয়েকে হাসিয়ে পরখ করে দেখা হতো দাঁতের মারির মধ্যে কোন খুঁত পাওয়া যায় কিনা। গায়ের রং, কাঁচা হলুদের রংএর মতো হলে কথায় নেই। হাতে বা গুতে ভাগ্যবতী পাতলা লোমশ যুক্ত কি না?। এসব বৃদ্ধারা বধূ দর্শনার্থী হবু বধূর হাঁটাচলাতে ক্রটি আবিষ্কার করতে ও দেখা যেতো মেয়ে খোঁড়া প্রকৃতির কিনা ? পায়ের তালু খরম তালুর কিনা ? কারণ খরম পায়ের মহিলারা নাকি অলক্ষণী হয়। মেয়েকে কাছে ডেকে আলাপ জুড়িয়ে পরখ করে দেখা হতো মেয়ে বধির বা তোতলা প্রকৃতির কি না ? কন্যাদায়গ্রস্ততার জন্য অবলিলাক্রমে কনেপক্ষ এমন আপত্তিকর বিষয় বদহজমের হলেও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে ধৈর্য সহকারে হজম করে যেতো। এখনকার আনুকুল্যতা হাওয়া লাগতো তখন হবু বধূর গলায় নজরানা স্বরূপ স্বর্ণের হার গলায় স্থাপিত হতো। উভয় পক্ষের মুখে হাসির ঝলক শোভা পেতো। পরস্পরের মাঝে খোলাখুলি এবং অতিথিকে কিছুদূর পথ এগিয়ে দেওয়ার পরিস্থিতি দৃশ্যমান হতো। তবে এর কোন পরিস্থিতিতে হবু বরের সংশ্লিষ্টতা দৃশ্যমান অগ্রহণযোগ্য বিবেচ্য।
এখনকার নারী ক্ষমতায়ন ও দৃশ্যপট পরিবর্তনহেতু বধূদর্শনে মুরুব্বিদের ভূমিকা অনুপস্থিতির জন্য হবু বধূকে এতো বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়না। কেউ যদি অতীত প্রচলিত রীতি অক্ষুন্ন রাখে তবু বরের একাধিপত্য সিদ্ধান্ত সর্বজনসম্মত বলে বিবেচ্য। বধূদর্শনে বর্তমানে কতগুলো উদ্ভট শর্ত বিবাহের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃজন করেছে। গায়ের ফর্সা রং, সুশ্রী, স্বাস্থ্যবান, ইত্যাদির পাশাপাশি নির্দষ্ট মাপের উচ্চতা অর্থাৎ ৫ ফুট ৩”-৪” ইঞ্চির মধ্যে থাকা চাই। যার জন্য শ্যামলা ও খাটোদেহী মেয়েকে বাচ বিচারের পশ্চাতে রাখা হয়েছে। এ ধরণের চলমান পরিস্থিতিতে কন্যা পক্ষকে কত যে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বর পক্ষের অবাঞ্চিত দাবির কাছে নতি স্বীকার করে কন্যাদায়গ্রস্ততার বিপরীতে কন্যাকে যেন অগ্নীকুন্ডে জলাঞ্জলী দিতে ও ইতস্ততবোধ করছেনা। অসহায় কন্যার সুখের প্রত্যাশা তো পূরণ হচ্ছেনা বরং শত অত্যাচারেও প্রতিবাদহীন হয়ে জীবন কাটাতে সচেষ্ট হয়। বধূ নির্বাচন এর ক্ষেত্রে বরপক্ষের কেউ কেউ ভিন্নতর পথ অনুসরণ করে থাকেন এবং এক্ষেত্রে বরেরও সাঁই থাকে। একটা প্রবাদ বাক্যের প্রচলন আছে ‘নদীর জল ঘোলাও ভালো জাতের মেয়ে কালোও ভালো”। তাই বংশ মর্যাদাকে গুরুত্ব দিয়ে অনেক বর বা বরপক্ষ বধূ নির্বাচন করে থাকেন। কারণ সংসার গড়া যেতো একদিনের জন্য সারাজীবন যাকে নিয়ে বর ঘর বাঁধবে সেতো হাজার প্রতিকুল পরিস্থিতি হজম করার মত মন মানসিকতা বিদ্যমান থাকতে হবে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের নায়ক ভবোতোষ বলেছিলো আমি বিয়ে যদি করি তবে একটা কালো কুৎসিত মেয়েই বিয়ে করবো। সুন্দরী মেয়েরা বেশী দেমাগী হয়। আমি ধর্মের জন্য সংযমের জন্য বিয়ে করচি। বধূদর্শন কালে কনেপক্ষ তাকে নিয়ে চলচাতুরী করতে কালো কুৎসিত একটা মেয়ে উপস্থাপন করেছিলো। মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করলে ও বলতো জগদম্বা। আসলে বিয়ে সংগঠিত হয়েছিলো ত্রয়োদশবর্ষী খাসা সুন্দরী এক মেয়ের সঙ্গে। একান্তে সুদর্শনা স্ত্রীকে ভবোতোষ খুশিতে উম্মাদ হয়ে স্বীয় স্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলো ‘আচ্ছা’ তোমার মা আমার সঙ্গে এতো চাতুর্য্যতা অবলম্বন করেছিলো কেন ? আচ্ছা ঐ যে জগদম্বা নামক ঐ কালো কুৎসিত মেয়েটা কে ? গত ২৯/৭/১৯ রিক্সা ড্রাইভারকে বলি এই ভাই এনায়েত বাজার ডাইবেটিক হাসপাতাল যাবে? ও যাবে বলে সম্মতি জ্ঞাপন করলো। হঠাৎ করে আমাকে নিয়ে কামাল গেট অভিমুখে ছুটলো। আমি বললাম এই, কোথায় নিয়ে ছুটছো। তোমাকে না বলছি এনায়েত বাজার যাবো, মাথা ঠিক আছে ? ও বললো স্যার মাথা বৌয়ের জ্বালায় ঠিক থাকবে কি করে। আমি বললাম তাতো আমি প্রারম্ভে চিন্তা করেছিলাম। হাসপাতালে গিয়ে কাউন্টারে বইটা জমা দিলাম, কাউন্টারে বসা ভদ্রলোক ১০০ টাকা জমা নিয়ে রক্তে সুগারের পরীক্ষার জায়গায় লিখলো ব্লাড গ্রুপ নির্ণয়-চিন্তা করলাম এ বেচারাও বউয়ের নির্যাতনের শিকার। সুতরাং বধূ নির্বাচনে একটু হেরফের হলো জীবন বিপর্যস্ত হবার সম্ভাবনা। তারপরও লিখতে গিয়ে এক আধটু বক্তব্য অপ্রিয় সত্য তৎজন্য অনুতপ্ত।

লেখক : কলামিস্ট