বছরে শতকোটি টাকার সিগারেট ঢুকছে চট্টগ্রামে

106

সোনার চাইতে সিগারেটে লাভ বেশি। তাই সিগারেট আনতেই বেশি আগ্রহী চোরাচালানিরা। তারা শাহ আমানত বিমানবন্দরকেই ব্যবহার করছে। চট্টগ্রামে বছরে ঢুকছে শতকোটি টাকার সিগারেট। সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। লাভবান হচ্ছে বিমানবন্দরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারিরা। গত এক সপ্তাহে জব্দ করা হয়েছে সাতটি চালান। ১৫ দিনে ১২টি চালান জব্দ হলেও ঢুকছে অহরহ। এসব সিগারেট রিয়াজউদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ আনার পর সরবরাহ করা হয় পুরো চট্টগ্রামসহ সারাদেশে।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার রাতে তিনটি চালান জব্দ করা হয়েছে। যাতে রয়েছে ১১১২ কার্টন সিগারেট। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এসব সিগারেট জব্দ করে।
আবুধাবি থেকে রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি-৪১৫ ফ্লাইটে আসা ফটিকছড়ির হাফিজ মোহাম্মদ হাসানের ব্যাগেজে পাওয়া যায় ১৭৪ কার্টন ইজি লাইট ব্র্যান্ডের সিগারেট। তার কাছ থেকে সিগারেট জব্দ করার পর অন্য যারা সিগারেট নিয়ে আসেন তারা ব্যাগেজ রেখেই দ্রুত সরে পড়েন। রাত ৯টায় আন্তর্জাতিক আগমন বেল্ট এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় ইজি লাইট ব্র্যান্ডের ১৩৬ কার্টন সিগারেট পাওয়া যায়।
এরপর রাত ৯টা ৫০ মিনিটে শারজাহ থেকে আসা এয়ার এরাবিয়ার জি ৯-৫২৩ ফ্লাইটের যাত্রীদের আন্তর্জাতিক আগমন বেল্ট এলাকায় ৮০২ কার্টন সিগারেট পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
এর আগে ১৬ ডিসেম্বর শারজাহ থেকে আসা এক যাত্রীর ব্যাগেজ থেকে ২৪৭ কার্টন ‘ইজি লাইট’ ব্রান্ডের সিগারেট জব্দ করা হয়েছে। এ চালানটিও জব্দ করে এনএসআই । ১৪ ডিসেম্বর তিন যাত্রীর কাছ থেকে ৯০৬ কার্টন বিদেশি সিগারেট উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে এয়ার এরাবিয়ার ফ্লাইটে সারজাহ থেকে আসেন একজন এবং ফ্লাই দুবাইয়ের ফ্লাইটে আসেন দুইজন। তাদের বাড়ি ফটিকছড়ি উপজেলায়।
১২ ডিসেম্বর শারজাহ থেকে আসা ফটিকছড়ির মোহাম্মদ আফছারুল ইসলামের ব্যাগেজ থেকে ২৮২ কার্টন ইজি লাইট ব্রান্ডের সিগারেট উদ্ধার করা হয়। একই দিন দুবাই থেকে আসা ফটিকছড়ির জাহেদুল আলমের লাগেজ থেকে জব্দ করা হয় ২৭১ কার্টন সিগারেট।
১১ ডিসেম্বর জেদ্দা থেকে আসা ৪ যাত্রীর কাছ থেকে ১ হাজার ৯৪ কার্টন সিগারেট উদ্ধার করা হয়। ফটিকছড়ির আরমানের কাছ থেকেই এসব সিগারেট জব্দ করা হয়।
২২ নভেম্বর জব্দ করা হয় এক কোটি ৪৩ লাখ ৮৬ হাজার টাকার বিদেশি সিগারেট। মদিনা থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি ১৩৮ ফ্লাইটে আসা ২৯ জন যাত্রীর কাছ থেকে জব্দ করা হয় এসব সিগারেট।
২৫ সেপ্টেম্বর জব্দ করা হয় ১২০০ কার্টন সিগারেট। ২৯ আগস্ট জব্দ হয় ৮১৪ কার্টন সিগারেট। এর আগে ৩ এপ্রিল জব্দ করা হয় ৭ হাজার কার্টন সিগারেট।
এ ছাড়া ২০১৮ সালের ২৯ এপ্রিল ফেল্ট (এক ধরনের ফোম) আনার ঘোষণা থাকলেও ‘৩০৩’ ও ‘মন্ড’ ব্রান্ডের ৬৫০ কার্টন সিগারেট আনা হয়েছে। যার মূল্য ১৩ কোটি টাকা। ওই বছরের ৭ মে বিভিন্ন ব্রান্ডের ৬৬ লাখ ৯৪ হাজার পিস সিগারেট পাওয়া যায়। শুল্কসহ যার আনুমানিক মূল্য ১০ কোটি ৪ লাখ টাকা।
শাহ আমানত বিমানবন্দর সিগারেট চোরাচালানের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই আসছে বিদেশি সিগারেট।
সোনা চোরাচালানিরা সিগারেটের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সোনার চাইতে সিগারেটে লাভ বেশি। যেমন, এক কোটি টাকার সোনা অনলে লাভ হয় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। আর সমপরিমাণ সিগারেট আনলে লাভ হয় ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা।
মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই, শারজাহ, আবুধাবি থেকেই আসছে বেশিরভাগ চালান। চালানে আসা অধিকাংশ সিগারেটই ইজি লাইট। এছাড়াও রয়েছে, মন্ড, স্ট্রবেরি, ভন ইন্টারন্যাশনাল, উইনস্টোন, গ্র্যান্ড-২০০০, ইজি অউরা, ব্ল্যাক, মালবোরো, উলসন ল্যান্ড এম, ত্রি জিরো ত্রি, মডার্ন, ডাবল হ্যাপিনেস ও ডানহিলসহ বিভিন্ন নামের সিগারেট।
চোরাচালানিরা সবাই বাংলাদেশি। দুবাই, শারজাহ ও আবুধাবিতে তারা অবস্থান করছে। সেখান থেকে বাহক মারফত প্রতিটি ফ্লাইটে সিগারেট পাঠায় চট্টগ্রামে। কোনটি ধরা পড়ে আবার কোনটি বের হয়ে যায়। তবে গুটিকয়েক ধরা পড়লেও বেশিরভাগ চালান অনায়াসে বের হয়ে যায়।
জানা যায়, চোরাচালানিদের মধ্যে আশিভাগই ফটিকছড়ির বাসিন্দা। আটক হওয়াদের বেশিরভাগই ফটিকছড়ির অধিবাসী।
বিমানবন্দর কাস্টমস’র উপ-কমিশনার মো. রিয়াদুল ইসলাম বলেন, অবৈধ পথে আসা সিগারেটের চালান যাতে ঢুকতে না পারে সেজন্য আমরা সচেতন। প্রতিটি সন্দেহভাজন যাত্রীকে তল্লাশি করা হয়। তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করা হয়। সর্বোপরি স্ক্যান মেশিন পার হওয়ার কোন সুযোগ নাই। তিনি বলেন, অবৈধ পথে আনা সিগারেটসহ সকল ধরনের পণ্যই ধরা পড়ছে। কাস্টমস ফাঁকি দিতে পারে না কেউ।
জানা যায়, অবৈধ পথে আসা সিগারেট খুব কম সংখ্যকই ধরা পড়ে। বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার অসাধুদের সঙ্গে চোরাচালানিদের যোগসাজশ থাকে বিদায় অনায়াসে পার হয় বিমানবন্দর।
অবৈধপথে আসা এসব বিদেশি সিগারেটের মূল ঘাঁটি নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ ও মদুনা ঘাট। এসব বাজার ছাড়াও আবাসিক এলাকায় বাসাভাড়া নিয়ে একটি সিন্ডিকেট প্রতিদিন নগরীর বিভিন্ন দোকানে মাঠকর্মীদের দিয়ে সিগারেট বাজারজাত করছে।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বিদেশি সিগারেট আমদানিতে ৩৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। দেশে প্রতি বছর প্রায় ৭ কোটি ৪০ লাখ বিদেশি চোরাই সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। সরকার সব সিগারেট থেকে আমদানি শুল্ক আদায় করতে পারলে বছরে আরো প্রায় ১৩০ কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায় হতো।
বিমানবন্দর ব্যবস্থাপক সরওয়ার ই জামান বলেন, শুধু সিগারেট নয়, কোন ধরনের অবৈধ পণ্য যাতে আসতে না পারে সেজন্য সকল সংস্থা তৎপর রয়েছে। এত সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে অবৈধ পণ্য বের হওয়া অসাধ্য ব্যাপার।
অবৈধ পথে আসা সিগারেটে চট্টগ্রামের বাজার সয়লাব। প্রতিটি দোকানেই রয়েছে এসব সিগারেট। চোরাচালানি সিন্ডিকেটের লোকেরা এসে সিগারেট দিয়ে যায় দোকানিদের।