বঙ্গোপসাগর উত্তাল

40

চলতি মৌসুমে পৌষের শুরুতেই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘ফেথাই’-এর বাউন্সার মোকাবেলা করেই মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহ নিয়ে হাজির হতে হয়েছে শীত ঋতুকে। ২৩ দিনের ব্যবধানে এবার দক্ষিণ চীন সাগরে সৃষ্ট শক্তিশালী গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় ‘পাবুক’-এর চোখরাঙানির মুখে শীতের দাপট। দক্ষিণ থাইল্যান্ডের উপকূলীয় অঞ্চলে ধ্বংসলীলা চালানোর পর আন্দামান সাগরে আপাত অবস্থানরত ‘পাবুক’ আজ রবিবার অনেকটা দুর্বল অবস্থায় মুখ ঘোরাবে মিয়ানমারের দিকে। আর তাতেই চোখরাঙানি টের পেতে শুরু করবে শীত। যার প্রভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় বিরাজমান শৈত্যপ্রবাহ খানিকটা প্রশমিত হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রে দায়িত্বরত আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক গতকাল শনিবার বিকালে জানান, থাইল্যান্ড উপসাগরে অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘পাবুক’ পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে আন্দামান সাগর ও তৎসংগ্ন এলাকায় (নয় দশমিক তিন ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯৭ দশমিক ছয় ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) অবস্থান করছে। এটি শনিবার বিকাল তিনটায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার পাঁচশ’ ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার চারশ’ ৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার সাতশ’ ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ছয়শ’ ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী অঞ্চলে সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসমূহকে দুই নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি এসে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। সেই সাথে তাদেরকে গভীর সাগরে বিচরণ না করতে বলা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, এবারের ঘুর্ণিঝড়ের ‘পাবুক’ নামটি দিয়েছে লাওস। সে দেশের ভাষায় যান মানে হল ‘মিষ্টি জলের বড় মাছ’। গত শুক্রবার রাতেই পাবুক দক্ষিণ থাইল্যান্ডের উপকূলে আছড়ে পড়ে। যাতে একজনের প্রাণহানি এবং অন্তত ৩০ হাজার লোক গৃহহীন হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে।
এদিকে, এবারের শীত মৌসুমে দেশজুড়ে বিরাজমান আবহাওয়া পরিস্থিতিতে নাটকীয়তা পরিলক্ষিত হয়েছে। সদ্য বিদায়ী ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের মাঝামাঝি থেকে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকাজুড়ে মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। পঞ্চগড়, রংপুর ও রাজশাহীসহ কোথাও কোথাও তা তীব্র আকার ধারণ করে। পৌষের প্রথম পক্ষে শুরু হওয়া শৈত্যপ্রবাহ দ্বিতীয় পক্ষেও অব্যাহত রয়েছে। শৈত্যপ্রবাহ কবলিত অঞ্চলের প্রভাবে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতেও বেড়েছে শীতের তীব্রতা। গত বছরের শেষদিন মানে ৩১ ডিসেম্বর সকালে শৈত্যপ্রবাহকবলিত উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় সর্বনি¤œ পাঁচ দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বিদায়ী বছরে সেটাই ছিল মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। কিন্তু, নতুন বছরের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ গত দুই জানুয়ারি সেখানে মৌসুমের এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এদিন সকালে সেখানে তাপমাত্রা ছিল চার দশমিক নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর গতকাল বৃহস্পতিবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা তেঁতুলিয়ায় রেকর্ড করা হলেও সংখ্যায় তা ছিল পাঁচ দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস।
পক্ষান্তরে দেশের পূর্বাঞ্চলের আবহাওয়ায় বিরাজ করছে উল্টো পরিস্থিতি। চলতি শীত মৌসুমে পৌষের শুরু থেকে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে চট্টগ্রামেই। এ অঞ্চলের মধ্যে সন্দ্বীপ ও সীতাকুন্ড বিদায়ী ডিসেম্বরের একেবারে শেষদিকে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে এলেও দু’দিন পর আবার তা লাফিয়ে দুই থেকে চার ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে যায়। এমনকি গতকাল শনিবারও দেশের সর্বোচ্চ ২৮ দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী কক্সবাজার জেলার টেকনাফে। আর ভারত সীমান্তবর্তী যশোরে সর্বনিম্ন সাত দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
এছাড়া, চট্টগ্রাম অঞ্চলের সবকটি জেলায় আবহাওয়া পরিস্থিতিতে থিতু অবস্থা বিরাজ করলেও উপকূলীয় এলাকা সীতাকুন্ডে তাপমাত্রার পারদ ফের নিম্নমুখী হয়েছে। আগের সপ্তাহে সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে আসার পর গত কয়েকদিন ১১ ডিগ্রির ওপরেই ছিল সেখানকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। গতকাল শনিবার তা পুনরায় সাড়ে নয় ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে।
দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দিতে আবহাওয়া অধিদপ্তরের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি গত পয়লা জানুয়ারি নিয়মিত বৈঠক শেষে আভাস দিয়েছে, কিছুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বয়ে যাওয়া মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহের বিদায়ের পর চলতি জানুয়ারি মাসেই আরও অন্তত দুটি শৈত্যপ্রবাহ তীব্র রূপ নিতে পারে।
গত ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করা পৌষ মাস বিদায় নেবে জানুয়ারির মাঝামাঝিতে। তারপর শুরু মাঘের। এ সময় দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চার ডিগ্রি পর্যন্ত নিচে নামার আভাস রয়েছে। আবহাওয়াবিদরা সর্বনিম্ন চার থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ, ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি এবং আট থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে গণ্য করেন।
অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টার জন্য প্রকাশিত আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের কোথাও কোথাও হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে। টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সীতাকন্ড, মৌলভীবাজার, রাজশাহী, পাবনা, নঁওগা, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, রপঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ভোলা ও বরিশাল অঞ্চলসমূহের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্য প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা কিছু কিছু এলাকা থেকে প্রশমিত হতে পারে। সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।