বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে খালেদা জিয়া

46

দুর্নীতি মামলায় কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য কারাগার থেকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে খালেদা জিয়াকে নিয়ে কালো রঙের একটি গাড়ি গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে শাহবাগে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে পৌঁছায়। পরে ওই গাড়ি থেকে নামিয়ে গোলাপী শাড়ি ও স্কার্ফ পরিহিত খালেদাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নেওয়া হয় কেবিন বøকের ছয় তলায়। সেখানে তাকে রাখা হয়েছে ৬২১ নম্বর কেবিনে। পাশের ৬২২ নম্বর কেবিনটিও তার জন্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
কড়া নিরাপত্তার মধ্যে একই গাড়িতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে আসেন তার গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম। গাড়ির দরজা খোলার সময় দেখা যায় অসুস্থ খালেদা জিয়া হেলান দিয়ে আছেন ফাতেমার পাশে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে মাহবুবুল হক এবং অতিরিক্ত পরিচালক ডা. নাজমুল করিম এ সময় উপস্থিত ছিলেন সেখানে।
বিএনপি নেত্রীর ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিসপত্র সকালেই কারাগারের একটি ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয় হাসপাতালে। একটি খাট, দু’টি সুটকেইস, চেয়ার, প্লাস্টিকের ওয়ারড্রোব, ছোট একটি ফ্রিজ দেখা যায় এসব মালপত্রের মধ্যে। সকাল ১০টা থেকেই কেবিন বøকের কাছে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন করা হয়। খবর বিডিনিউজের
দলীয় প্রধানকে হাসপাতালে নেওয়ার খবরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস-চেয়ারম্যান এ জেড এম জাহিদ হোসেন, স্থায়ী কমিটির নেতা মির্জা আব্বাস, মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাস, সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব আবদুস সাত্তার দুপুরের আগেই বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে এসে কেবিন বøকের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন।
কেবিন বøকের ২০০ গজ দূরে পুলিশি নিরাপত্তার বাইরে মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক হেলেন জেরিন খানের নেতৃত্বে একদল নেতা-কর্মীকে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে স্লোগান দিতে দেখা যায় এ সময়।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কারণে কারা কর্তৃপক্ষ গতকাল সোমবার তাকে আদালতে হাজির না করায় তার বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি পিছিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য ১০ এপ্রিল নতুন তারিখ ঠিক করে দিয়েছেন বলে খালেদার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার জানিয়েছেন।
মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী খালেদা জিয়াকে গত বছরের ৭ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়েছিল। সে সময় প্রায় এক মাস চিকিৎসা শেষে আবার তাকে কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
৭৪ বছর বয়সী খালেদা জিয়া আর্থ্রাইটিসসহ বয়সজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। বিভিন্ন মামলার শুনানিতে আদালতে হাজির করার সময় তাকে হুইল চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়। গতবছর হাসপাতাল থেকে কারাগারে নেওয়ার সময়ও তাকে হুইল চেয়ারে দেখা গিয়েছিল। মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী মার্চের শুরুতেও খালেদা জিয়াকে একবার বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে স্থানান্তরের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ পরে জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসন রাজি না হওয়ায় তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নেওয়া যায়নি। পরে বিএনপি নেতাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের ওপর খালেদা জিয়ার আস্থা নেই, তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চান।
গতকাল সোমবার খালেদাকে সেই বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে স্থানান্তরের পর মির্জা ফখরুল আবারও তাকে একটি ‘বিশেষায়িত’ হাসপাতালে নেওয়ার দাবি জানান। কেবিন বøকের বাইরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত এবং আমরা সেজন্যই বার বার বলছি তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অবশ্যই বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো হোক। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে তার ট্রিটমেন্টটা কিভাবে হবে’। বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমরা আশা করব আজকে সরকার চেষ্টা করবেন এখানে যেন সর্বোচ্চ চিকিৎসা তাকে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তার চিকিৎসার জন্য ভালো একটি পরিবেশ যেন তৈরি করা হয়। আমরা আগেও বলেছি, এখানে তাকে যেন এমনভাবে রাখা না হয় যাতে তিনি আবারও মনে করেন যে বন্দি অবস্থায় তার চিকিৎসা হচ্ছে। এ কথাটাই আমরা বার বার বলেছি, তাকে একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে নেওয়া হোক’।
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট ও জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছরের দন্ড নিয়ে ২০১৮ সালের ফেব্রæয়ারি থেকে কারাগারে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। যেখানে তাকে রাখা হয়েছে, নাজিমউদ্দিন রোডের সেই পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারের ‘স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে’ তার স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি হয়েছে বলে অভিযোগ করে আসছেন বিএনপি নেতারা।
স¤প্রতি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকান্ডে হতাহতের ঘটনার পর ওই এলাকার কয়েকশ গজ দূরে কেন্দ্রীয় কারাগারে খালেদা জিয়া নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে খালেদা জিয়াকে অন্য কারাগারে স্থানান্তরের পরিকল্পনার খবর এলে রিজভী সে বিষয়টিকেও ‘সরকারের চক্রান্ত’ হিসেবে বর্ণনা করেন। এরপর গত ২৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল নিজেই জানান, নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারকে জাদুঘরের পরিণত করা হচ্ছে, ফলে খালেদা জিয়াকে বেশিদিন সেখানে রাখা যাবে না। সেইজন্য আমরা পাশেই কেরানীগঞ্জে অত্যাধুনিক যে কারাগার আমরা করেছি, সেই কারাগারে আমাদের সব কিছুই সুসম্পন্ন হয়েছে। সেইখানে আমরা নেবার চিন্তা-ভাবনা করছি’।
খালেদা জিয়া সুস্থ, তবে হাঁটা-চলা করতে পারছেন না : বিএসএমএমইউ’র পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবিএম মাহবুবুল আলম বলেছেন, আমরা খালেদা জিয়াকে দেখেছি। তার সঙ্গে কথা বলে তাকে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয়েছে। তিনি আমাদের সঙ্গে বসে থেকে কথা বলেছেন। চিকিৎসকদের মতে তিনি বলেন, ‘তবে তার (খালেদা জিয়া) পায়ে ও জয়েন্টে ব্যথা আছে। তার ডায়াবেটিস স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, শরীর দুর্বল। তার ঘুম কম হয়, খাবারের রুচি কমে গেছে। তিনি একা হাঁটা-চলা করতে পারছেন না, হাঁটার সময় আরেকজনের সাহায্য নিচ্ছেন’।
গতকাল সোমবার খালেদা জিয়াকে দেখার পর তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা জানান।
খালেদা জিয়া সুস্থ আছেন, পরিচালকের এমন বক্তব্যে সাংবাদিকরা জানতে চান, তাহলে তো খালেদা জিয়াকে ছেড়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু তাকে তো ভর্তি করা হয়েছে। জবাবে ব্রিগেডিয়ার আলম বলেন, ‘খালেদা জিয়া যদি মনে করেন তিনি চলে যাবেন, কমফোর্ট ফিল করছেন না, তাহলে তিনি চলে যেতে পারেন। তিনি যদি থাকেন (হাসপাতালে) তাহলে প্রতিদিন একজন চিকিৎসক তাকে ভিজিট করবেন। উনি এখন ৬২১ নম্বর কেবিনে আছেন। আর তার সঙ্গে যারা রয়েছেন, তাদেরকে ৬২২ নম্বর কেবিনে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে’।
বিএসএমএমইউ’তে তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা হবে কিনা- এমন প্রশ্নে পরিচালক বলেন, ‘উনার এখন যে সমস্যা, তা কোনও জটিল সমস্যা না। বিএসএমএমইউ’তে চিকিৎসা সম্ভব না- এমন কিছু আমরা পাইনি। আমাদের বিশেষায়িত হাসপাতাল। খালেদা জিয়ার যা সমস্যা রয়েছে, তার চিকিৎসা করা এখানে সম্ভব’।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসক বদলানো হবে কিনা- সাংবাদিকদের এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আজকে আমরা তাকে যেভাবে দেখেছি, তাতে বর্তমান চিকিৎসক বোর্ডের প্রতি তার আস্থা রয়েছে। যখন মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তাকে দেখতে যান, তখন উনি বসে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং আমাদের কাছে মনে হয়েছে, বোর্ডের ব্যাপারে তিনি সন্তুষ্ট। আজকে তাকে চিকিৎসকরা ওষুধ দিয়েছেন। এখন তাকে এই ওষুধগুলো মেনে খেতে হবে’। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবিএম মাহবুবুল আলম বলেন, ‘গত ২৮ মার্চ খালেদা জিয়ার জন্য একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। এই বোর্ডের প্রধান হলেন ডা. জিলন মিঞা। বোর্ডের সদস্যরা হলেন- ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, ডা. তানজিমা পারভিন, ডা. বদরুন্নেসা আহমেদ, ডা. চৌধুরী ইকবাল মাহামুদ। এছাড়া ডা. শামিম আহমেদ এবং ডা. মামুন মেডিকেল বোর্ডকে সহযোগিতা করছেন’।
ডা. মামুন কি খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডা. মামুন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক না। তবে তাকে খালেদা জিয়া পছন্দ করেন’।