বঙ্গবন্ধুুর ৭ই মার্চের ভাষণ : অজানা অধ্যায়-২

252

একটি ভাষণ, একটি তর্জনী, একটি নির্দেশ কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ হলে ত্রিশ লক্ষ মানুষজীবন দিতে পারে, দুই লক্ষ নারী সম্ভ্রম নষ্ট করতে পারে, এটি এক বিশ্বের বিস্ময়। এই ভাষণ শুধু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের জন্য নয়,এটি মহাকালের জন্য মনে হয়। তাই এখনো এইভাবে বাঙালিকে উজ্জীবিত করে, অনুপ্রাণিত করে। আজো যখন শুনি ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবিলা করো’ মনে হয় তিনি স্বাধীনতা বিরোধী, সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমাদেরকে এখনো অনুপ্রাণিত করছেন। কারন পাকিস্তানি আদর্শের সাথে একাত্তরের আদর্শের সংঘাত চার যুগ পরেও চলছে। যা পৃথিবীর কোথাও হয়নি ।
৭ই মার্চের ভাষণের হাত ধরে একটি জাতির রাজনৈতিক জন্ম। একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এটি আমাদের স্বাধীনতারসনদ নয়, মুক্তির সনদ। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধুু ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি একবার উচ্চারণ করেন আর একবার ‘মুক্তি’ শব্দটি উচ্চারণ করেন পাঁচ বার। (১) আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়। (২) এদেশে মানুষ অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। (৩) যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হয়। (৪) এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। (৫) এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি এই ভাষণে ‘মুক্তি’ শব্দটি পাঁচ বার বললেন। দেশের মানুষকে স্বাধীন করে ছাড়বো না বলে, বললেন মুক্ত করে ছাড়বো। আর এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’
পুরো ভাষণের এই বাক্যটির মধ্যে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি একবার উচ্চারিত, সে বাক্যটির পূর্বেও ‘মুক্তি’ শব্দটি উচ্চারণ করার রহস্য আতœস্থ করা দরকার। স্বাধীন তো ১৯৪৭ সালে একবার হয়েছিলাম, কিন্তু মুক্তি মিলেনি। এই স্বাধীনতা শুধু ্স্বাধীনতার জন্য নয় মুক্তির জন্য । তাই তিনি মুক্তির ওপর বড় বেশি জোর দিলেন । ৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জিত হয় কিন্তু মুক্তি মানে অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রাম যা এখনো চলছে এবং চলমান থাকাব। তাই একাত্তরের রণাঙ্গনে যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের নাম স্বাধীযোদ্বা না মুক্তি যোদ্ধা। জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে মুক্তি শব্দটি অপসারণ করে স্বাধীনতাশব্দটি প্রতিস্থাপন করেন ।
‘জয় বাংলা সোনার বাংলা’ মুক্তি, শব্দমালা বঙ্গবন্ধু্ ুঅত্যন্ত প্রিয় দিন। এসব শব্দমালা রবীন্দ্রনাথ নজরুলের। তিনি ছিলেন প্রচন্ড রবীন্দ্র-নজরুলের অনুরাগী ভক্ত। বঙ্গবন্ধুুর আতœজীবনী হতে আতœস্থ করতে পারি, তার কারাজিবনের প্রধান সম্বল ছিল রবীন্দ্র-নজরুল রচনা সমগ্র। কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’ কবিতাটি বঙ্গবন্ধুুর হৃদয় নাড়া দেয় বলে জানা যায়। মুক্তির কথা মাথায় ঘুরতে থাকে। মুক্তির জন্য তার জীবন উৎসর্গ করেন। তিনি আমাদের মুক্তিদাতা।


‘জয় বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান, জাতিয় শ্লোগান। এই ‘জয় বাংলা’ প্রথম উচ্চারণ করেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার এক প্রবন্ধে। নজরুলের ‘জয় বাংলা’ রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’, একটি জাতিয় শ্লোগান, অন্য জাতিয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতিয় কবি, জাতিয় সংগীত রচয়িতা, জাতির জনক তিন জনই মারা গেলেন আগস্ট মাসে। একাত্তরের রণাঙ্গনে তিন মহান ব্যক্তির তিনটি বিষয় মুক্তিযুদ্ধের উজ্জীবিত-অনুপ্রাণিত করে। জাতিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শ্লোগান ‘জয় বাংলা’ রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’ বঙ্গবন্ধুুর ৭ই মার্চের ভাষণ। নজরুলের-বঙ্গবন্ধুুর আতক্সিক্ষত ‘মুক্তি’র লক্ষ্যে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে বিশেষ ভাবে বাঙালিরা জয় করেছিলেন বলেই, আমাদের জাতিয় এক দিবসের নাম ‘বিজয় দিবস’। দুনিয়ার কোন জাতির বিজয় দিবস নেই,স্বাধীনতা ও জাতিয় দিবস আছে। যে জাতির বিজয় দিবস আছে, সে জাতির কোনদিন পরাজিত হতে পারেনা। রাজনীতির কবি তার ১৮ মিনিটের অমর কবিতা ৭ই মার্চের ভাষণে ‘আমি’ ‘আমরা’ ‘আমাকে’ শব্দ উচ্চারণ করেছেন, প্রায় ৪৪ বার, বিদ্রোহী কবি তার ‘বিদ্রোহী কবিতায় (যে কবিতা লেখার কারনে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বিদ্রোহী কবি উপাধী প্রদান করেছিলেন) ‘আমি’ শব্দটি ব্যবহার করেন ১৪৪ বার। ৭ই মার্চের ভাষণ আর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছাড়া আর কোথাও ‘আমি’ শব্দটি এত বেশি উচ্চারিত হয়েছে কিনা বলা মুশকিল। এই দু’জনের ‘আমি’ শব্দ অহংবোধের নয়, আতœশক্তি, জাতি শক্তি ও জাতিয়তাবাদের বহিঃপ্রকাশ। এই শক্তির অহংকার গৌরবেরও যেমন একুশে আমার অহংকার, আমার স্বাধীনতা আমার অহংকার। ৭ই মার্চের ভাষণের লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুু নিজের ক্ষমতা অর্জন ছিল না। বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ত্যাগ করলে পাকিরা তাকে ক্ষমতা দিতে রাজি ছিল। তিনি হতে পারেন পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্র প্রধান। ক্ষমতার পরিবর্তে বাংলার মানুষের অধিকার ও মুক্তি চাইলেন । ভাষণে তিনি উচ্চারণ করলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, বাংলার মানুষের অধিকার চাই। তাঁর কাছে প্রধানমন্ত্রিত্বের চেয়ে অধিকার বড়, স্বাধীনতার চেয়ে মুক্তি বড়। বঙ্গবন্ধুু ছিলেন,১৯৭০ সালের জাতিয় নির্বাচনের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। তিনি বাঙালির অধিকার কথা বলতে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ক্ষমতা প্রদর্শন করেনি। গণতন্ত্রে আমরা দেখতে পাই সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তি প্রয়োগ অনেক ভালো চিন্তা ও উদ্যোগ বাতিল হয়ে যায়। তাই তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তির চেয়ে কিছু আদায় করতে চাননি। ন্যায্য বিচার চেয়ে বলেছেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদি হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নিব। সুভাষ বসু বলেছিলেন,‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’। বঙ্গবন্ধুু বাঙালি জাতির রক্ত চাওয়ার আগেই অধিকারের আন্দোলনের শুরু হতে রক্ত দিতে আরম্ভ করলো। তাই তিনি ৭ ই মার্চের ভাষণে বললেন,রক্ত যখন দিয়েছি,রক্ত আরো দিব; এদশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো। সাথে সাথে তিনি ইনশাল্লআল্লাহ বলেছিলেন। (হাদিসে আছে ‘ইনশাআল্লাহ’ বললে, আল্লাহ কবুল করেন। মহান আল্লাহ পাক বঙ্গবন্ধুুকে কবুল করেছিলেন বলেই বিজয়ী হয়েছিলেন)। এই ভাষণে তিনি আরো বলেছেন,আমরা যখন রক্ত দিতে শিখেছি, কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’। সুভাষ বসুর বাঙালির চেয়ে বঙ্গবন্ধুুর বাঙালি এখানে অগ্রসর।
বঙ্গবন্ধুুর এই ভাষণ দিন হ্যামিলনের বংশী। যেবাশীর সুরে সবাইকে জাগ্রত করেছেন। তিনি সাড়ে সাত কোটি জনতাকে রক্ত দেওয়ার হুকুম দিয়ে আত্মগোপন বা পালিয়ে যাননি; নিজেও রক্ত দেওয়ার জন্য বসে ছিলেন। এমন নেতা পৃথিবীতে পাওয়া কঠিন।
মহাত্মা গান্ধী চেয়েছিলেন তখনও ভারত জিন্না চেয়েছিলেন ভারত ভাগ। ভারতের জাতির জনক যা চেয়েছিলেন তা হয়নি। জিন্নার স্বপ্নের পাকিস্তান ২৩ বছরে ভেঙে গেল। বঙ্গবন্ধুু যখন পাকিস্তান চেয়েছিল তখন পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়, যখন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন তখন স্বাধীন বাংলার জন্ম হয়। বাংলাদেশর স্বাধীনতার সময় কারো কথার দাম দিলনা, তাঁর কথাই শেষ কথা। তাঁর কথাই বাংলার আইন। তিনি ৭ই মার্চের ভাষণে যা বলেছিলেন,তা জনগণ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ১২শ মাইল দূরে কিন্তু তাঁর ভাষণে দিয়ে যাওয়া নির্দেশনায় সৃষ্টি হয় একটি জাতি রাষ্ট্রের। এই ভাষণ নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্রে পরিণত করে। শহীদ হয় ৩০ লক্ষ মানুষ।সম্মান হানি হয় ২ লক্ষ মা-বোনের।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ২১ বছর এই ভাষণটি বাজানো নিষিদ্ধ ছিল। এই ভাষণ বাজাতে গিয়ে অনেক আওয়ামীলীগ নেতাকে জীবন দিতে হয়। জেল জুলুম নির্যাতনের স্বীকার হয়। তখন আমরা বলেছিলাম এই ভাষণ আমাদের জাতিয় সম্পদ। ৪৬ বছর পর পৃথিবীর সেরা সংস্থা ইউনেস্কো ঘোষণা করলেন, এটি সমগ্র পৃথিবীর সম্পদ। ওয়ার্ল্ড হেরিটেইজ জামাত-বি.এন.পি. এই ভাষণের গুরুত্ব বুঝবে কী ভাবে! যেখানে পৃথিবীর সেরা সংস্থা ইউনেস্কোর এই ভাষণের গুরুত্ব বুঝতে ৪৬ বছর সময় লেগেছে। যারা এই ভাষণের বিরোধিতা করেছিল তারা আজ ইতিহাসে কলস্কিত।
৭ই মার্চের ভাষণ যদি পৃথিবীর সম্পদ হয়, যিনি এই ভাষণ প্রদান করেন তিনি কী বিশ্বের সম্পদ নয়? বি.এন.পি.-জামাত এই বিশ্বনেতাকে ৫০ বছর ধরে অপমান করে আসছে। যে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুু এই ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রদান করেছিলেন, যেখানে ১০ জানুয়ারি (১৯৭২)তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেছিলেন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যে স্থানে পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিলেন, যে ঐতিহাসিক ময়দানে মৃজিবইন্দারা এক সাথে জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন, এসব স্মৃতিচিহ্ন মুছে দিতে জেনারেল জিয়া অবৈধ ভাবে ক্ষমতা দখল করে এই ময়দানে শিশু পার্ক প্রতিষ্ঠা করেন।
বিশ্বের অনেক নেতা আছে যারা একটি ভাষণের জন্য মহাকালে সেরা হয়েছেন। আবার কেউ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কারণে বিশ্বে খ্যাতিমান হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুু একমাত্র নেতা যিনি শুধু সেরা ভাষণ দেননি, একটি স্বাধীন দেশের জন্মও দিয়েছেন। যে ভাষণ পৃথিবীর সম্পদ এবং স্বধীনতার জন্য গুরুত্বপুুর্ণ ভূমিকা রাখে, সে ভাষণটি এখনো কেন পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত হবে না? মনীষীরা বলেছেন, প্রকৃত নেতা সেই যে সময়ের সাথে সাথে বড় হয়। বঙ্গবন্ধুু ও তাঁর ভাষণ সময়ের সাথে সাথে নতুন ভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে-হবে। ইতিহাসের পাতা ছেড়া যায়, মুছা যায় না।

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক