বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ অন্ধকারে আলোকবর্তিকা

165

মানুষের জীবনে কিছু কিছু দিন আছে যা স্মরণীয় ও বরণীয়। একইভাবে জাতীয় জীবনেও এমন কিছু ঘটনা, মুহূর্ত বা দিন আছে যা কখনো ভুলবার মতো নয়। কারণ এর সাথে জড়িয়ে থাকে একটা জাতির দীর্ঘদিন ধরে বুকের ভেতর লালিত স্বপ্ন পূরণ বা সূর্যোদয়ের ইতিহাস। তেমনই একটা দিন ৭ই মার্চ। ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের এ দিনে বাঙালি জাতির কান্ডারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির উদ্দেশ্যে যে দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ দিয়েছিলেন, ইতিহাসে এ ভাষণকে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বা একাত্তরের বজ্রকন্ঠ বলা হয়। স্থান, কাল, পাত্র বিবেচনায় ঐ ভাষণ ছিল এ সময়ের জন্য অনিবার্য এবং অপরিসীম গুরুত্ববহ। এ ভাষণের মাধ্যমে তিনি একটা অস্থির সময়ে দোদুল্যমান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বানের পাশাপাশি, বৈরি সময়ে করণীয় কী তা সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কী ছিল তাঁর এ ভাষণে, কেনই বা তাঁর এ ভাষণকে একাত্তরে ব্রজকন্ঠ বা সূর্যোদয়ের দিকনির্দেশনা বলা হয়? এসব জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজার আগে আমাদের জানা প্রয়োজন, কোন বিশেষ প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু এ ভাষণ দিয়েছিলেন। সে প্রেক্ষাপটের কথা তিনি তাঁর ভাষণেই অকপটে তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয় লাভ করেও আমরা গদীতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক আইন জারি করে আইয়ুব খান দশ বচর আমাদের গোলাম করে রাখলো। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেয়া হলো এবং এরপর এই অপরাধে আমার বহু ভাইকে হত্যা করা হলো। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া খান এলেন। তিনি বললেন, তিনি জনগণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিবেন, শাসনতন্ত্র দিবেন। আমরা মেনে নিলাম।’
ইয়াহিয়া খান জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে না দিলেও ঠিকই নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৭০ সালে সারা পাকিস্তানে দু’টি ভিন্ন তারিখে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় পরিষদের আজ ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। এ দুটো নির্বাচনেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ লাভ করে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১৫টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় ২৯৮টি আসনে। এ ভূমিধস বিজয়ের পর সঙ্গত কারণেই ক্ষমতার মসনদে বসার কথা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের।
কিন্তু ফল হলো উল্টো। জেনারেল ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলে অভিহিত করলেও ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে খাক হতে লাগলেন। ফলে তিনি তার জেনারেলদের নিয়ে গোপনে ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের জাল বোনা শুরু করলেন। কারণ, পশ্চিমাদের ধারণা, বাংলাদেশ সোনার বাংলা। এ সোনা যদি একবার হাত ছাড়া হয় যায় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানকে অনাগত দিনগুলোতে শ্রীহীন মরুভূমি হয়েই থাকতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের শ্রমে আর ঘামে গড়ে উঠেছিল পশ্চিমাদের প্রাসাদ সৌধ। সৌন্দর্য আর উন্নয়নের যে ধারা সূচিত হয়েছিল তার সবই সম্ভব হয়েছিল এদেশের টাকায় এদেশকে শোষণ করে। ফলে সম্পদ আর প্রাচুর্য্যরে আধার দেশটির কর্তৃত্ব যদি সে দেশের মানুষের হাতে, বিশেষত বঙ্গবন্ধুর মতো একজন সিংহ পুরুষের হাতে চলে যায় তাহলে নির্ঘাত পশ্চিমাদের কপালে দুঃখ বৈ আর কিছুই থাকে না। আর তাই যে করে হোক বাঙালিদের রুখতে হবে। ছলে-বলে-কৌশলে যে উপায়েই হোক বাঙালি জাতিকে পদানত রাখতে হবে। পদানত রাখার সে কাজই শুরু করেছিল। নির্বাচনে বিজয়ী দলকে বিজয়ের মুকুট পরানোর পরিবর্তে দাবিয়ে রাখার অশুভ তৎপরতা চললো নিরন্তর। এমন কি বিজয়ী দলের নেতাকে দু-দু’বার হত্যার অপপ্রয়াস চালানো হলো। একবার ঢাকায়, আরেকবার চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও সে যাত্রায় নিহত হয়েছিলেন তাঁর দু’জন সফর-সঙ্গী খুলনার মমতাজ উদ্দিন আর পাবনার আহমদ রফিক। এদিকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের পরিবর্তে শুরু হলো আলোচনার প্রহসন। সে প্রহসনের অংশ হিসেবে নির্বাচনের ২৩ দিন পর ১৯৭১ সালের ১১ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোও এলেন শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা করতে। ইতিমধ্যে ১৫ ফেব্রæয়ারি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে ডাকা হলেও তা ৩ মার্চ পুনঃ নির্ধারণ করা হয়। বারবার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকে আবার পেছানো তা যে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার তালবাহানা ছাড়া আর কিছুই নয়, তা বাংলাদেশের মানুষের বুঝতে খুব একটা দেরি হলো না, শুরু হলো পুরো দেশ জুড়ে হরতাল, ধর্মঘট, মিছিল, শ্লোগান। অবশেষে ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ইতিপূর্বে আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এতে পশ্চিমাদের আসল চেহারা ফুটে উঠে। এ ঘোষণায় মহাবিক্ষোভে ফেটে পড়ে অগ্নিময় বাংলাদেশ। সে আগুনের লেলিহান শিখা নিয়ে এগিয়ে আসে ৭ই মার্চ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনই এক সন্ধিক্ষণে জাতির উদ্দেশ্যে ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন যখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। তাদের পেছনে ফিরে তাকাবার আর কোন পথ খোলা ছিল না। বাঙালির শ্বাস নেয়ার সব ক’টি জানালা পাকিস্তানিরা বন্ধ করে দিয়েছিল। এ ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালির তাপিত প্রাণে প্রাণ সঞ্চার করে গর্জে উঠে বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সে মুক্তির দিকনির্দেশনাও তিনি দিয়েছিলেন তাঁর ভাষণ্ েএকজন সেনাপতি কোন আক্রমণের শুরুতে তাঁর সৈনিকদের যেভাবে প্রস্তুতিমূলক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এ মহান নেতাও বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের সামনে কঠিন সময়। আমাদের পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ। তার মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নেয়ার পালা। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।
আর ক’টা দিন পেরোলেই যে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে এবং আমাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে তা তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েই ক্ষান্ত হননি। পরম আত্মপ্রত্যয়ের সাথে উচ্চকিত হন এই বলে, ‘বাংলার মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবে না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।’ বঙ্গবন্ধুর সেই ভবিষ্যত বাণী ফলতে খুব বেশি সময় লাগেনি। মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা লাভ করি স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ। পৃথিবীর ইতিহাসে জাতীয় নেতাদের দেওয়া যে ক’টি ভাষণ এখনো চিন্তাশীল মানুষের মুখে মুখে ফেরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে বিমুগ্ধ করে তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ একটি। এ ভাষণটির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আমাদের দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার সোনার হরিণ উপহার দিয়েছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ জাতির যে কোন দুর্দিনে, দুর্বিপাকে আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক