বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিনির্মাণ

341

ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি আজ। ১৯৭২ সালের আজকের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক জঘন্য নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায়। বাঙালি ই. পি. আর ও পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিরোধ আসতে পারে ভেবে তাদেরকে নির্মূল করার জন্য আক্রমণ চালায়। সেনানিবাস, সীমান্ত ফাঁড়ি ও পুলিশ লাইনগুলোতে পাকিস্তানি সেনারা সরাসরি হামলা চালিয়ে অস্ত্রাগারগুলো দখল করে নেয়। বাঙালি নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ ও শিশুদের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে অবর্ণনীয় নির্যাতন, অত্যাচার, নিপীড়ন চালিয়েছিল হিটলারের পর থেকে এ পর্যন্ত এমন পৈশাচিক দৃষ্টান্ত আর এ বিশে^ দেখা যায়নি। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আটক হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২:২০ মিনিটে ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রেরিত বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত স্বাধীনতার এ ঘোষণাটির বাংলা অনুবাদ হচ্ছে: ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহবান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশে রমাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে সাড়া দিয়ে দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলে। দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে রাওয়ালপিণ্ডি থেকে প্রায় ১৫০ মাইল দক্ষিণে লায়াল পুরের একটি কারাগারে একতলা লাল ইটের ভবনে বিচার অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা প্রভৃতি। এটা ছিল মূলত একটি কোর্ট মার্শাল। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত ১২টি অভিযোগের মধ্যে ৬টির শাস্তিছিল মৃত্যুদণ্ড। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারাকক্ষের নিকটেই তাঁর জন্য কবর খোঁড়ে রাখে। কিন্তু বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানায়। পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক চাপে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু বিমান যোগে রাওয়ালপিণ্ডি থেকে যুক্তরাজ্যে গমন করেন। ঢাকার পথে দিল্লির পানাম বিমান বন্দরে তিনি যাত্রা বিরতি করেন। বাংলাদেশের এ মহান স্থপতিকে এ সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ লক্ষ লক্ষ জনতা বিপুল সংবর্ধনা দেয়। অবশেষে আসে ঐতিহাসিক সে মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি অপরাহ্নে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণের মাধ্যমে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রায় পাঁচলক্ষেরও অধিক জনতার উপস্থিতিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অশ্রুসিক্ত নয়নে এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। তিনি বলেন, ‘…ভাইয়েরা আমার, লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ দানের পর আজ আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতি জানাই সালাম।…আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেবে বলছিÑযদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে, পূর্ণ হবেনা। তোমরা, আমার ভাইয়েরা, গেরিলা হয়েছিলে দেশ মাতার মুক্তির জন্য। তোমরা রক্ত দিয়েছ। তোমাদের রক্ত বৃথা যাবেনা।…ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। বাঙালিরা একবার মরতে জানে। তাই বলেছি, ক্ষমা চাইনা। তাদের বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। কিন্তু আজ আমাদের সামনে অসংখ্য সমস্যা আছে, যার আশু সমাধান প্রয়োজন। বিধ্বস্ত বাংলাকে নতুন করে গড়ে তুলুন।…ওরা আমার লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, এমন গ্রাম নাই যেখানে আগুন দেয় নাই, যেখানে মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করে নাই।…এত বেসামরিক লোককে হত্যা করার নজির আর নাই। প্রথম মহা যুদ্ধ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও এত বেসামরিক লোক মরে নাই।…বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা। …বাংলাদেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা করায় ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ, ফ্রান্স ও ব্রিটেনেসহ সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ, সংবাদপত্র এবং নেতৃবৃন্দকেও ধন্যবাদ জানান। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিনির্মাণের জন্য বঙ্গবন্ধু প্রশাসন ব্যবস্থার পুনর্গঠন, প্রায় এক কোটি মানুষের পুনর্বাসন, রাস্তা-ঘাট-ব্রিজ-কালভার্টসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন, চল্লিশ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করণ, শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, মাদ্রাসাশিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন, মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদান, বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসন, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও পুনরায় চালু করার মাধ্যমে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান, বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্প-কারখানা চালু, বিনামূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ, ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবকাঠামো পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বিশ্বমানের একটি সংবিধান বাঙালি জাতিকে উপহার দেন। এ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার ৪টি মূলনীতি যথাক্রমে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার উল্লেখ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশ শান্তিপ্রিয় ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে। ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রæতানয়’ এ নীতির আলোকে দেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত পররাষ্ট্রনীতির মূল বিষয় ছিলো : জাতীয় সার্বভৌম ও সমতার প্রতিশ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতি সমূহের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্য বাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায় সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন প্রদান করা। বঙ্গবন্ধুর সময়েই দহ গ্রাম আর আঙ্গরপোতা ছিটমহলে বাংলাদেশ তার অধিকার স্থায়ী করে নেয়। আর বিনিময়ে ভারতের নিকট বেরুবাড়িরয়ে যায়। ১৯৭৩ সালের ২৩ অক্টোবর জাপান প্রেস ক্লাবে দেওয়া এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চাই। আমরা ঘোষণা করেছি ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে একটি মুক্ত ও শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হতে হবে। আমরা আমাদের এতদঞ্চলের দেশসমূহের উন্নয়নের জন্যই শান্তি চাই। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য আমরা অর্থ ব্যয় করবনা। অস্ত্র প্রতিযোগিতা বরং বন্ধ করা দরকার।’১৯৭২ সালের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (ILO),আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল(IMF)),বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), ইউনেস্কো, কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (FAO)-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্য হলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আরো কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ হয়। জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভের পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ প্রদান করেন। ১৯৭২ সালে ৯৮টি দেশ এবং বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে মোট ১২৭টি দেশের স্বীকৃতি অর্জন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম প্রধান সাফল্য। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে এতো অল্পসময়ের মধ্যে অন্য কোনো রাষ্ট্রনায়ক এতগুলো দেশের স্বীকৃতি অর্জনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেননি। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর প্রতিনিধিদের মধ্যে যুগ্নোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বোমেদিয়ান, সেনেগালের প্রেসিডেন্ট লিওপোল্ড সেনগর, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাঙালির বঙ্গবন্ধু এভাবেই বিশ্ববন্ধুতে পরিণত হন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার জন্য বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিওকুরি’ পদকে ভ‚ষিত করে। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু অনুসৃত নীতি সমূহ দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ভঙ্গুর অর্থনীতির পুনর্গঠন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এবং বহির্দেশের সাথে সৌহাদ্য ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন তথা যুদ্ধ বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, চবি