বঙ্গবন্ধুর ছয়-দফাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র

34

কাজি রশিদ উদ্দিন

আমরা যদি পাকিস্তান আমল তথা ১৯৬০-এর দশকের কথাই বলি তখন আমরা বলতাম ২২টি পরিবারের হাতে দেশের সব সম্পদ পুঞ্জীভূত। তারাই সব শিল্প কারখানা ও ব্যাংক বীমার মালিক। আরো লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল এসব পরিবারের একটিও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশে ছিল না। তখন এই গুটিকয় পরিবারের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে হতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য এতটাই প্রকট রূপ নেয় যে, সুইডিশ অর্থনীতিবিদ গুনান মিরডাল তার এশিয়ান ড্রামা বইতে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে উন্নয়ন বৈষম্যের ফরে যে টানাপড়েন সৃষ্টি হচ্ছে তা সমাজ সহ্য করতে পারবে না। তোমার চোখের সামনে তোমার টাকা নিয়ে আরেক ভাই বড়লোক হচ্ছে, অথচ তুমি খেতে পারছো না। আরেক ভাই বরলোক হচ্ছে, অথচ তুমি খেতে পারছোনা। তখন তুমি তো বসে থাকবে না, যখন দেখবে তুমি অসচ্ছল অবস্থায় আছ আর তোমার সম্পদ নিয়ে তোমার আর এক ভাই গাড়ি-বাড়ি করছে, মার্সিডিজ চালাচ্ছে। তখন তুমি কি তা সহ্য করতে পারো? বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান যখন ছয় দফা ঘোষণা করেন, তখন এর অন্তনিহিত তাৎপর্য বুঝতেও আমাদের কোনো বেগ পেতে হয়নি। পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান তখন বলেছিলেন, “আমি অস্ত্রের ভাষায় (খধহমঁধমব ড়ভ ডবধঢ়ড়হ) ছয় দফার জবাব দিব। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করাই ছিল ছয় দফার মূল লক্ষ্য। শেষ পর্যন্ত ছয় দফায় আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়ায় এবং তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণকে ভোটের মাধ্যমে এর পক্ষে গণরায় দেয়।
পাকিস্তানের ২২ পরিবারের একটিও পূর্ব পাকিস্তানে ছিল না। তখন কোনো শিল্প-কারখানা এমন কি একটি ব্যাংকও বাঙালির মালিকানায় ছিলনা। ৫০ এর দশকে টাকার রাস্তায় হাতগোনা কিছু মোটরযান চলাচল করত। অতঃপর আমরা স্বাধীন হলাম। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর হতে চলল। আজ বাংলাদেশে নতুন এক শ্রেণির ধনিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব দেখা যায়, ঠিক পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবারের মতোই। এই গোষ্ঠীগুলো আজ আবারও দেশকে অকার্যকর করার উপক্রম করেছে।
ব্যাংক ঋণ দেয়। আজকে আমরা দেখছি আমাদের ব্যাংকগুলোর ওভারডিউ লায়াবিলিটি ৪০%-৫০% আমাদের দেশে যে ধনিক গ্রæপগুলোর একটি অংশের মধ্যে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার প্রবণতা প্রকট। দেখা যাচ্ছে যারা এক কোটি বা দুই কোটি টাকার জন্য ধরনা দিত তারা এখন শত কোটি, হাজার কোটি টাকার মালিক। এদের উত্থান অবিশ্বাস্য। আজকে মনে হয় আমাদের দেশের আর্থিক দৈন্যদশার কারণ এরাই। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যারা ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতা তারা তুলনামূলক কম খেলাপি। অন্যদিকে যারা বড় অংকের ঋণ নেয় তাদের মধ্যেই ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেশি। ঋণ খেলাপিদের বিষয়ে আমাদের অর্থমন্ত্রীও সংসদে বলেছেন, এদের কেউ কিন্তু সাধারণ কোনো খেটে খাওয়া মানুষ নয়। এরা সবাই সমাজের অভিজাত শ্রেণির মানুষ হিসেবে পরিচিত, ঋণ গ্রহণের জন্য নানা কৌশলের আশ্রয় নেয় তারা, এরা ঋণ খেলাপি হয়ে নিজেরা সম্পদ কুক্ষিগত করছে। আবার এদের অনেকেই ব্যাংকের মালিক। আসলে এ শ্রেণির ধনিক গোষ্ঠী যখন ভূমিদস্যু হয়ে পরিবেশ বিপন্ন করে। যখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করার বদলে অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করে সেখানে বিত্তবৈভব গড়ে তোলে, যখন শাসন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। যখন রাজনৈতিক সদিচ্ছায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বা ক্ষমতা অর্জন করে তারা দেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়।
এমন ধনিক গোষ্ঠীর কারণেই পাকিস্তান আমালে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছিল। যেটা আজকেও দেখছি। বাংলাদেশে ধনী মানুষের প্রবৃদ্ধি প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রায় সবই অবৈধ পন্থায়। এটা ব্রিটিশ সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ একের তথ্য। এটাও ঠিক যে, উন্নয়নের জন্য উদ্যোক্তা চাই। উন্নয়নের জন্য শ্রমিক, শ্রম ও পুঁজি থাকলেই চলবেনা উদ্যেক্তা থাকতে হবে। কিন্তু উদ্যোক্তাদের তো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে এই উদ্যোক্তা গোষ্ঠী যে অর্থ শোষক গোষ্ঠীতে পরিণত হতে পারে। এর উদাহরণ আজকে বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি। সে কারণেই কথিত একটি গ্রæপের মালিকানার শরিক লোকজনের হাতে একটি ব্যাংকের এমডি অপদস্ত হওয়ার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ঋণের জন্য তাকে নাকি প্রাণ নাশের হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। এই খবর প্রকাশের পরপর অভিযুক্তদের দেশ থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় পালিয়ে যাওয়ার খবরও আমরা দেখেছি। একটি ব্যাংকের এমডি যখন ভয়ভীতির শিকার হন তখন সেই ব্যাংক আর কাজ করতে পারেনা। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। সময় এসেে শক্ত হাতে সাহসী পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে পাচার করা টাকা এবং কালো টাকা অর্থনীতির মূলধারায় ফিরিয়ে আনার। খেলাপি ঋণ আদায়ে জিরো টলারেন্স নীতির মাধ্যমে আইন করে এদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা সামাজিকভাবে হেয় করা পোসপোর্ট জব্দ। গাড়ি বাড়ি কিনতে না দেয়া, প্লেনে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি); অর্থঋণ আদালতের মামলাগুলোর দ্রæত বিচার সম্পন্ন এবং প্রয়োজনে বড় বড় ঋণ খেলাপির বিচারের জন্য বিশেষ আদালত ও ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। আমাদের দেশে ক্যাসিনো সংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়েছে কারা? হাজারো হাজার কোটি াকা দেশের বাইরে পাচার করা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এর সঙ্গে কারা জড়িত? এরা কখনো কখনো রাজনীতিকের ছদ্মবেশ ধারণ করে অথবা অন্য কোনো উপায়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে দুর্নাম করার অপচেষ্টা চালায়। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সরকার কিছু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা এখন নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। সব কিছু নিয়ে আমাদের নতুনভাবে চিন্তা ভাবনা করা দরকার। এখন সময় এসেছে দল মত নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার দেশে এখনো অনেক ভালো মানুষ রয়েছেন। যারা ক্ষমতাসীনদের নিঃস্বার্থভাবে গঠনমূলক সুপরামর্শ দিতে পারেন।
এই করোনা মহামারী আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সময় আমাদের সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা যদি প্রত্যেকে তার প্রতিবেশী দরিদ্র লোকজনের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন, তাহলে সমাজে সৌহার্দ্যরে সুবাতাস বইবে। গরিবের সহায়তায় সরকারি অর্থ আর্তসাতের খবর শুনি। আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয় কোন পর্যায়ে চলে গেছে।
পরিস্থিতির উত্তরণে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার ওপর জোর দেয়া উচিত। আমি মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। এমন একটি জাতীয় সেøাগান বের করা উচিত ধনিকরা যদি অন্তর থেকে বুঝতে পারে যে, দেশের খেটে খাওয়া মানুষের কাছে তার দায়বদ্ধতা আছে তাহলে খেলাপি, সংস্কৃতির অবসান হতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট