বঙ্গবন্ধুর খুনির ভাইকে চেনেন না মেয়র নাছির

399

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বর্তমান সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীনের মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পেছনে আলোচনায় আসে একটি ছবি। যে ছবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খানের ভাইয়ের সাথে অন্তরঙ্গভাবে দেখা যায় চসিক মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীনকে। মনোনয়ন নিয়ে যখন চারদিকে শোরগোল সেসময় এ ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন নাছিরের প্রতিপক্ষ। সে ছবিকে কাজে লাগিয়ে নাছিরকে মনোনয়ন বঞ্চিত করতে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়া হয় বলে গুঞ্জন চলছে।
তবে যে মামুনুর রশিদ হেলালকে বঙ্গবন্ধুর খুনির ভাই বলে প্রচার করা হয়েছে তাকে চিনেন না বলে দাবি করেছেন মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন। রশিদ খানের চাচাতো ভাই পরিচয় দেয়া আকরাম খান কসবা উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বলেও জানান তিনি। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রামে কর্মরত সাংবাদিকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীনের সাথে বঙ্গবন্ধুর খুনির ভাইয়ের যে ছবি ভাইরাল হয়েছে সেগুলো অক্সিজেন এলাকায় ‘খান ওয়াশ’ নামে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ছবি। এ প্রতিষ্ঠানটির মালিক আকরাম খান বঙ্গবন্ধুর খুনি সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের প্রতিবেশি। সেই অনুষ্ঠানেই বঙ্গবন্ধুর খুনি সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের ভাই মামুনুর রশিদ খান হেলাল গাড়ি বিক্রির মিশনে যান। গাড়ি ব্যবসায়ী হেলাল ইফাদ গ্রূপের পরিচালক। মূলত আ.জ.ম নাছির উদ্দীন চসিকে প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হলে গাড়ি বিক্রির সুবিধা নিতেই মামুনুর রশিদ খান হেলাল সেখানে গিয়েছিলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর খুনি রশীদ খানের ভাই মামুনুর রশিদ খান হেলাল একজন গাড়ি ব্যবসায়ী। গাড়ি ব্যবসা নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার সাথে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, সিটি মেয়রসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খানের সাথে ঘনিষ্ট ছবিও আছে হেলালের। এমনকি বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ চুক্তিতে বিআরটিসি বাসের উদ্বোধনে ভিড়িও কনফারেন্স অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন হেলাল। হেলালের সাথে আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের ছবি এ প্রতিবেদকের কাছেও আছে।
বঙ্গবন্ধুর খুনির ভাইয়ের সাথে একটি ছবিকে ঘিরে রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা হলেও এতদিন বিষয়টি নিয়ে নিশ্চুপ ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় সেই ছবির বিষয়ে মুখ খুলেন তিনি।
সভায় বক্তব্যকালে মেয়র নাছির বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ’৯৪ সালে গঠিত শাহজাহান-খলিল কমিটির ১নং সহ-সভাপতি ছিলেন আকরাম খান। তিনি এখন তার গ্রামের বাড়িতে একটি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে থানা আওয়ামী লীগের মেম্বারও তিনি। বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি। আমার চরম দুঃসময়ে এক নাগাড়ে দেড় থেকে দুইমাস একটি কক্ষে আবদ্ধ ছিলাম। সূর্যের আলোও দেখি নাই। সে বাড়িটি সবসময় তালাবদ্ধ থাকতো, সেখানে আমাকে রাখার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই আকরামের। সেই সুবাধে অক্সিজেন এলাকায় তার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উদ্বোধনের কথা বললে আমি সেখানে গিয়ে কেক কেটে চলে আসি। অথচ সেখানে শাহরিয়ার রশীদ খানের ভাই বলে যাকে বলা হচ্ছে তাকে আমি চিনিও না। জীবনে দেখিও নাই। সে যে বঙ্গবন্ধুর খুনির ভাই তা জানি না। কেন সেখানে সে এসেছিল সেটি যার আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম সেই জানবে। আমার সাথে কোন যোগাযোগ-সম্পর্ক নেই তার। এ অপরাজনীতি আমাকে বড় কষ্ট দিয়েছে।’
নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘আমি মনোনয়ন না পেয়ে কষ্ট পাইনি। কষ্ট পেয়েছি একটি বিষয়ে সেটি হলো, আমি যে সংগঠনের জন্য জীবন-যৌবন উৎসর্গ করেছি সেখানে বঙ্গবন্ধুর খুনির সাথে আমাকে জড়ানো হলো। অথচ প্রথম যখন বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল ফারুক রশীদ চট্টগ্রামে এসে সার্কিট হাউজের সামনের মাঠে জনসভা আয়োজন করে আমি আ.জ.ম নাছির উদ্দীন সেটি পন্ডের পরিকল্পনা করি। তৎকালীন নগর ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকসহ আরো অনেককে সাথে নিয়ে বসে পরিকল্পনা করে আমি ফারুক রশীদের সেই অনুষ্ঠান পন্ড করেছিলাম। শহরের যেখানে যেখানে ফ্রিডম পার্টির সংবাদ পাওয়া গেছে সেখানেই তাদেরকে দাঁড়াতে দিইনি। শহর শিবিরমুক্ত করার পেছনে প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমি কাজ করেছি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আমি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছি। গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামী যেখানেই সমাবেশ করেছেন সেখানেই আমার ফাঁসির দাবিতে প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেছেন। প্রতিনিয়ত আমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া আমার নাম উল্লেখ করে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।’
মেয়র বলেন, যেখানে আমি বঙ্গবন্ধুর খুনির বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখেছি, আমি আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি বুকে ধারণ করেছি, আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে এবাদত হিসেবে নিয়েছি, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজনীতি করেছি সেখানে ছোট্ট একটি মেয়র পদ আমার কাছে বড় নয়, রাজনীতি আমার কাছে বড়। কেউ যদি আমাকে বলতো তুমি সরে যাও, আমি নিজ ইচ্ছায় ছেড়ে দিতাম। আমি গতবারও নিয়মানুযায়ী মনোনয়ন চেয়েছিলাম। কোন লবিং করি নাই। কারো যদি এটার দরকার হয় তাহলে এগুলো করার দরকার ছিল না। এগুলো করে তো দলের ক্ষতি করা হলো। আরেকজন আ.জ.ম নাছির উদ্দীন তৈরি করা সাধনার বিষয়। আমরা দুঃসময়ের পরীক্ষিত কর্মী। আমি যদি কোন কারণে কষ্ট পাই তাহলে এই জায়গায় কষ্ট পেয়েছি। এখানে একশ’তে একশ ভাগ আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা হয়েছে।
এদিকে যে শিল্প প্রতিষ্ঠানে তোলা ছবি নিয়ে শোরগোল সৃষ্টি হয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক আকরাম খান পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলাম। কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির নেতা ছিলাম। উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। আমি একটি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। আমার নেতা হিসেবে নাছির ভাইয়ের দুঃসময়ে উনাকে আমার এখানে এনে রেখেছিলাম। নাছির ভাইয়ের সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর খুনির যে পরিবার সেই পরিবারের সাথে আমার ছোট কাল থেকেই সংগ্রাম। শাহরিয়ার রশিদের ফাঁসি হলে উনার পন্থী লোকজনের সভা ভেঙ্গে দিয়েছিলাম। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমি বঙ্গবন্ধুর খুনির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছিলাম।’
ব্যবসায়ী আকরাম খান বলেন, ‘নাছির ভাইয়ের সাথে ছবিতে আরেকজন যে ব্যক্তি আছেন উনি শাহরিয়ার রশিদের ভাই। আমি যখন অনুষ্ঠানের আয়োজন করি সে খবর পেয়ে আমার প্রতিষ্ঠানে যায়। সে ইফাদ গ্রæপের পরিচালক হিসেবে বিআরটিসির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। নাছির ভাইয়ের নির্বাচনী কাজে এসে একজন মালিক পুরানো একটি প্ল্যান্ট বিক্রি করবে শুনে সেটি আমি কিনেছিলাম। পরে এটি উদ্বোধন করতেই আমি নাছির ভাইকে আমন্ত্রণ করি। এটির উদ্বোধনে গিয়ে ইফাদ গ্রূপের বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে গাড়ি বিক্রি করার প্রস্তাব দিতে সেখানে যায় হেলাল। যাতে মেয়র একটু তার বিষয়টি দেখে। পরে সে আরো অনেক বার আমার কাছে আসলেও তাকে নিয়ে মেয়রের কাছে যাইনি। তাকে নাছির ভাইকে চেনার প্রশ্নই আসে না। নাছিরাবাদ এলাকায় ইফাদ গ্রæপের একটি অফিস থাকায় মেয়র আসার প্রচারে নিজের ধান্ধায় সে আমার প্রতিষ্ঠানে আসে। সে বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনে গাড়ি বিক্রি করেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে কোন গাড়ি বিক্রি করতে পারে নাই। আপনারা বিষয়টি তদন্ত করতে পারেন। আমার মাধ্যম হয়েই এলাকাবাসী হিসেবে সেখানে ঢুঁ মেরেছিল।’