বঙ্গবন্ধুকে জানা বড় বেশি প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের

177

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলংকময় দিন। এই দিনটিতে জাতি অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়। পরবর্তীতে অন্ধকারের মধ্যেই অনেক বছর অতিবাহিত করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নোবেল জয়ী তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির নেতা ইউলি ব্রানডিট বলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙ্গালিদের আর বিশ^াস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোন জঘন্যকাজ করতে পারে । সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ^াসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, বাঙ্গালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশে^র মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতি চরিত্রই তুলে ধরেছেন। দ্য টাইমস অব লন্ডন এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় বলা হয় সবকিছু সত্তে¡ও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাÐকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে’।
১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনার ইঙ্গিত ছিল মাস পাঁচেক আগেই। অবমুক্ত করা মার্কিন দলিল গেঁটে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের ২৩ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে তৈরি পাঁচটি কূটনৈতিক তার বার্তার শিরোনামেই ‘‘বাংলাদেশ, অভ্যুত্থানের গুজব’ কথাটি ছিল। কিন্তু ২০ মার্চে মিসরের আসওয়ানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে পাঠানো তারবার্তাটি নানা কারণে ব্যতিক্রম। সেটির শিরোনামে ‘সম্ভাব্য অভ্যুত্থান’ বলা হয়েছে। তবে এসব তার বার্তার বিবরণ অবমুক্ত করার আগেই মুছে দেওয়া হয়েছে। তাই ভিতরে কী লেখা ছিল, তা কখনো জানা যাবে কি না, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বিশ^াসঘাতকতা বেঈমানী এবং কৃতঘœতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাঙালির রক্তের সাথে মিশে আছে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আ¤্রকানণে মীরজাফর ও তার সহযোগীদের যুগের পর যুগ ঘৃণা করে আসছে ও করবে। পলাশীর আ¤্রকানণে যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল সেই স্বাধীনতার সূর্য আবার ১৯৭১ সালে লাভ করেছি। কিন্তু বিশ^াসঘাতকরা এর বিরোধিতা করে এবং মেনে নিতে পারে নাই বলেই ১৯৭৫ এর হত্যাকাÐ ঘটায়। ইতিহাসে জানা যায়, নেতাজি সুভাষ বসু, শেখ মুজিবুর রহমান ও নেলসন ম্যান্ডেলা তিনজনই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, দেখিয়েছিলেন। এক অদৃশ্য সূতায় একে অপরের সঙ্গে বাধাঁ। তাঁরা তিনজনই পরাধীন জাতির মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা। শুধু নিজ নিজ দেশ বা জাতির নয়, পৃথিবীর যেখানেই নিপীড়িত মানুষ স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন, এই তিন নেতা তাদের জন্য আশার প্রতীক। এই তিন মহান ব্যক্তি আতœত্যাগের মাধ্যমে মুক্তি অর্জন করতে সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছেন। এই সর্বোচ্চ ত্যাগের মাধ্যমে আমাদের এই মহান অর্জনকে ধরে রাখতে শারীরিক ও মানসিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তবেই প্রকৃত মুক্তি আসবে। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ১৯৭১ সালে সবাই বঙ্গবন্ধুর কাজ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল। আগামী দিনেও তাঁর কর্মময় জীবন ও আদর্শ থেকে মানুষ প্রেরণা লাভ করবে। আজকের দিনে বঙ্গবন্ধুকে জানার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের বঙ্গবন্ধুকে জানা খুব বেশি প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু এমনই এক মানুষ ছিলেন, যার আত্মত্যাগের মাধ্যমে, বাংলাদেশ অর্জন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই অর্থাৎ ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি অধ্যায় অতিক্রম করেছে। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের উপর একেবারে নির্ভরশীল দুইটি গ্রন্থ যথা ‘‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা’’ এর নির্ভরশীল তথ্য উপাত্ত সঠিক ইতিহাস জানতে সাহায্য করবে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দুই দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুলকে অতিক্রম করে তিনি এ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৭৩ সালের ৩০ মে তার লিখিত ডায়েরি পাঠের মাধ্যমে। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘ একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতি নিয়ে আমি ভাবি’’। এতে বাঙ্গালি হিসেবে যা কিছু বাঙ্গালিদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। ঐ নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, যে ভালবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে যে জীবনাদর্শন দিয়ে গেছেন ও আদর্শ রেখেছেন তা অমলিন। অমর হয়ে আছে তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উৎকর্ষতায়। আমাদের এককেন্দ্রিক নয়, সামস্টিক চিন্তা মাথায় রাখতে হবে। সকলের জন্য কাজ করা এবং সকলকে সুখের অংশীদার করা প্রকৃত মানুষের কর্তব্য। একবিংশ শতাব্দীর তরুণ প্রজন্ম আগামী শতকের কান্ডারী। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সামগ্রীক উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক মহানায়ক থেকে ইতিহাসের মহানায়ক। কালের প্রতিহিংসা, হানাহানি ও দলীয় কোন্দল বাদ দিয়ে মানবিক মূল্যবোধ ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে হবে। মহানায়ক থেকে কালোত্তীর্ণ মহান নেতা। রাজনৈতিক সামাজিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় তিনি বাঙ্গালির বিবেক থেকে বিশ^ বিবেকে পরিণত হয়েছে। ইতিহাসের অংশ থেকে ইতিহাস প্রণেতা। অতঃপর সমগ্র ইতিহাস। ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে সৃষ্টি করে নাই বঙ্গবন্ধু নিজেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তাই তিনিঅমর হয়ে থাকবেন।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ লুৎফর রহমান ও সায়রা খাতুনের তৃতীয় সন্তান সেই ছোট খোকা কালের আবর্তে এবং ইতিহাসের পাতায় ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান বাঙালির অহংকার, সেই সূর্যসন্তান, স্বাধীনতার স্থাপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শৈশবের সেই ধুলোবালি মাখা সুন্দর দিনগুলোতেই তিনি চারপাশের নানা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন। সেই শৈশব থেকেই তিনি জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও পীড়নকে মেনে নিতে পারেননি। তাইতো সমাজের অন্যায়ের প্রতিবাদ সবার নজর কাড়ে। সেই শৈশবেই আশে-পাশের দুখি মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসতেন। গরিব ছাত্রদের জন্যে বাড়ী বাড়ি ঘুরে চাল সংগ্রহ, এক শীতে তারই সমবয়সী ১৩ বছরের এক কিশোরকে নিজের কাপড় দান করে, ১৩ বছর বয়সে স্বদেশী- আন্দোলনের এক সমাবেশে পুলিশি লাঠিচার্জের বিরুদ্ধে পুলিশ ফাঁড়িতে শত শত ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, ১৯৩৯ সালে অভিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হককে স্কুলের ছাদ সংস্কারের জোরালো দাবি সকলের নজরে পড়ে। কিশোর ছাত্র খোকার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সৎ-সাহস এবং স্পষ্টবাদিতায় মুগ্ধ হয়েছিল শেরে এ বাংলা এ.কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। জাতীয় শিশু দিবস উদযাপনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম ও আদর্শ সম্পর্কে জানতে পারবে এবং দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে আগামীতে জাতি গঠনে নিজেকে তৈরি করতে সক্ষম হবে। সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরির লক্ষ্যে, শিশুর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের সকলে আরো সচেতন হতে হবে। তাইতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘‘আসুন শিশুদের কল্যাণে আমরা আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করি,’’ বর্তমানের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ।
শিশুর মত সরল বঙ্গবন্ধরু সরলতার সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনীতে কর্মরত কিছু বিপদগামী, সশস্ত্র লোক, ৩২ নং ধানমন্ডির তার চিরচেনা বাড়িতে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আজ ধানমন্ডি ৩২নং শুধু শোকাবহ স্মৃতি নয়, সকল ত্যাগ ও অর্জনের স্মৃতি। সম্প্রতি আওয়ামী-লীগের কর্মীবাহিনীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কর্মীবাহিনীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। দেশ ও দলের প্রতি কতটুকু তারা অনুগত তা ভাবার বিষয়। সম্প্রতি নব্য আওয়ামী-লীগের কর্মী-বাহিনী সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও দলের অন্যান্য নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তিরা অভিমত প্রকাশ করেছেন। দেশকে ভালবাসে, দলকে ভালবাসে এবং মুজিবের আদর্শে আদর্শিত হতে আহŸান করেন। ত্যাগের শিক্ষা, দেশ গড়ার শিক্ষা ও মানুষের প্রতি মহানুভবতার শিক্ষা অর্জন এখন বড় বিষয়। স্বাধীনতার প্রায় ৪৮ বছর চলছে। এখনো ইতিহাস নিয়ে দ্বিধা বিভক্ত মতামত প্রকাশ করে চলছে অনেকেই। কিন্তু ইতিহাস আপন গতিতে চলে। তাই ইতিহাসকে যতই অন্যখাতে প্রবাহিত করা হয় এবং বিকৃত তথ্য দিয়ে বিপদে ফেলতে চায়- ততই ইতিহাসের পাতাগুলো অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠছে। আমরা যারা এখনো পঞ্চাশ (৫০) পেরোয়নি আমাদেরকেও এ ধরনের মিথ্যা তথ্যগুলো দ্বিধা-দ্ব›েদ্ব ফেলে। আর প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মিথ্যা ও বিবৃত ইতিহাসের শিক্ষা দেওয়ার যে প্রচেষ্টা চলছে নতুন প্রজন্মই তার উত্তর দিবে। তাই নতুন প্রজন্মকে নিয়ে একটি সুন্দর দেশ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের সঠিক ইতিহাস জানা দরকার। এক্ষেত্রে, বঙ্গবন্ধুর আতœজীবনী বইটি একটি বড় উদাহারণ। জেলখানায় থেকে তিনি নিজ হাতে নিজের ও দেশের প্রতিটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া আমাদের দেশে অনেক গান, কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস আছে। এগুলোর পটভূমি ও ঘটনা প্রবাহ বাংলাদেশের অতীত ও বর্তমান নিয়ে রচিত। নতুন প্রজন্মকে এই সমস্ত বই পড়তে আগ্রহী করে তুলতে হবে। ফলে তারাই তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি নির্ভেজাল ইতিহাস উপহার দিতে পারবে। সঠিক ইতিহাস জাতিকে সঠিক নির্দেশনা দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগাবে। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং নিজেকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে সঠিক ইতিহাস জানার ও চর্চা করার কোন বিকল্প নেই।

লেখক : প্রাবন্ধিক