বই আত্মাকে জাগিয়ে দেয়

254

একুশ আমাদের চেতনা প্রেরণার আর অধিকারের মাস। ভাষা আন্দোলনের মাস হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টি করে। ভাষা জ্ঞান নয়, জ্ঞানের মাধ্যম। জ্ঞানের বাহন হিসেবে বই এক বড় ভূমিকা পালন করে। এই মাসে জ্ঞান চর্চার প্রসারে দেশের নানা স্থানে বইমেলার আয়োজন হয়। সবচেয়ে বেশি বই বিক্রি হয় এ মাসে। অনেকে বই কেনেন, পড়েন কিন্তু আত্মস্থ করতে পারে না। ধারণ করতে পারে না। কারণ তারা শখের জন্য বই পড়েন। মনন, মন আত্মা, মনুষ্যত্ব ও নিজের শক্তিকে জাগিয়ে তোলার জন্য বই পড়ে না। শখের জন্য বই পড়ার তেমন উপকার নেই।
বই আত্মাকে জাগিয়ে তোলে। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, দেহের মৃত্যুর চেয়ে আত্মার মৃত্যু অনেক বড়, তা আমরা বুঝি না। দেহের মৃত্যুর রেজিস্ট্রারি রাখা হয়, আত্মার হয়তো আমরা আত্মার অপমৃত্যুতে ভীত হওয়া দূরে যাক, উৎফুল্ল হয়ে উঠি।
কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদের কাছে এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন, কেমন আছেন ? তিনি জানালেন, বেঁচে আছি। এমন উত্তর কেন জানতে চাইলে, তিনি বললেন, অনেক মৃত্যু মানুষ জীবিত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি অথচ তাদের আত্মা মরে গেছে। তাই বলছি, বেঁচে আছি’।
আরেক কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘মানুষের মৃত্যুতে আমি দুঃখ পাইনা, মনুষ্যত্বের মৃত্যুতে দুঃখ পাই।’ আজ অনেক মানুষ প্রাণে বেঁচে থাকলেও তাদের কাছে মনুষ্যত্বের লেশমাত্র নেই। তারা মানুষ নয় পশু। কথায় বলা হয়, ‘মানুষ জন্মে শিশু, শিক্ষায় যিশু না হলে পশু। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘গুনতে আমরা বৃদ্ধি পাচ্ছি গরু ছাগলের মত’। মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্য সুশিক্ষা দরকার, সুশিক্ষার জন্য প্রয়োজন সুপাঠ্য বই।
একটি তরুলতা সহজে তরুলতা, এক পশু সহজেই পশু কিন্তু একটি মানুষ সহজেই মানুষ নয়, মানুষকে মানুষ হতে দ্বিতীয় জন্ম হতে হয়। বই পাঠের মধ্যদিয়েই একটা মানুষের দ্বিতীয় জন্ম হয়ে যায়।
জন কীর্টস বলেছেন, ‘মানুষের মনের মধ্যে হাজার চোখ আছে, আমার একটি একটি বই পড়ে একটি একটি অন্তরের চোখ খুলে যায়।’
দর্শন মানে দেখা, দেখলে দার্শনিক হয় না। কোপালের চোখ দিয়ে দেখার নাম দর্শন নয়, অন্তরের চোখ দিয়ে দেখলে দার্শনিক হয়। মুসলিম সেরা দার্শনিক আল্লামা ইমাম গায়যালী (রাঃ) লিখেছেন, ‘মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের একটি গুরুত্বপূ র্ণ ইন্দ্রিয়ের নাম ‘চোখ’। চোখের ও কয়েকটি দোষ আছে। যেমন চোখ দূরে দেখে না, এক ইঞ্চি পরিমাণ চোখের কাছে কিছু বস্তু নিয়ে আসলে তাও দেখে না, চোখ কোন বস্তুর বাইরে দেখে, ভিতরে দেখে না, চোখ অনেক কিছু দেখে কিছু চোখ-চোখকে নিজে দেখে না। চোখ যা দেখে তা সত্য দেখে না। চোখে কাছে মনে হয় সূর্য আঁকার থালার সমান, কিন্তু অন্তরের চোখ বলে, পৃথিবী হতে সূর্য্যরে আঁকার তের লক্ষ গুণ বড়। তাই তিনি বলেছেন, সব কিছু অন্তরের চোখ দিয়ে দেখতে। অন্তরের চোখ দিয়ে যারা দেখেন তারাই দার্শনিক। অন্তরের পরিষ্ফুটিত হয় বই পড়ার মাধ্যমে। তাই আল রাজি বই পড়তে পড়তে সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে কিন্তু মনের দৃষ্টি বিকশিত হওয়ায় তিনি অন্যকে দিয়ে বই পড়ে শুনতেন এবং লেখাতেন। ইবনে কাসির পড়তে পড়তে অন্ধ হয়ে যায়, যতই অন্ধ হয় ততই তাঁর অন্তরের চোখ খুলে যায়। পৃথিবী নামক গ্রহটির মধ্যে মহাকালের সেরা ধনীর নাম ‘মানসা মুসা; সম্পদের চেয়েও যে, গ্রন্থের মূল্য অনেক বেশি তাঁর কাছে এই শিক্ষা আমরা পাই। তাঁর সম্পদের পরিমাণ কোন গবেষক ঐতিহাসিকবিদ করতে পারেননি। তখন কার সবচেয়ে বড় সোনার খনির মালিক ছিলেন তিনি। মানসা মুসা হজ্ব করতে যাওয়ার সময় সাথে নিলেন ৬০ হাজার মানুষ, এদের মধ্যে ১২ হাজার চাকর। আর ছিল ১০০টি উট। সকল চাকররা বহন করে সোনার বার। প্রতিটি উট বহন করে ১৪০ কেজি সোনার বার। সব মিলে ১ লক্ষ ৫০ হাজার হাজার ফাউন্ড সোনার বার বহন করে সাথে নিয়ে যায়। তাদের বহন করা সব সোনার বার পথে পথে দান করে হজ্ব হতে ফেরার সময় আবর সাম্রাজ্য হতে উট বোঝাই করে নিয়ে আসে প্রচুর জ্ঞানের গ্রন্থরাজি। যে বইগুলোর মধ্যে ছিল চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, ভুগোল, ইতিহাস, গণিত, আইনসহ নানা জ্ঞানে সমাহার, শুধু তাই নয়, তিনি আরব সাম্রাজ্যের সেরা গ্রন্থ প্রণেতাদের নিয়ে আসেন তাঁর রাজ্য পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে। সম্পদ ত্যাগ করে মহাসম্পদ জ্ঞান বিজ্ঞান দ্বারা নিজ দেশকে সমৃদ্ধ করে এই মহাকালের ধনী মানসা মুসা হতে শিক্ষা অর্জন করে তাহের পৃথিবী আরো সুন্দর হবে।
মহাত্ম গান্ধী যেখানে গোসল করতেন সেখানে প্রতিদিন একটি করে গীতার শ্লোক লিখে রাখতেন। গোসল করার সময় গানের সূরে মুখস্থ করতেন। নেপোলিয়ান যুদ্ধক্ষেত্রে লাইব্রেরি রাখতেন এবং পড়তেন। যুদ্ধের ময়দানেও মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর পবিত্র কোরআনের আয়াত নাজিল হয়। তিনি সেসব আয়াত আত্মস্থ করতেন, ভাবতেন। জ্ঞানের এত বেশি গুরুত্ব যে তা যুদ্ধক্ষেত্রেও সাধনা করতে হয়।
বই পড়তে পড়তে বইয়ের রাজায় পরিণত হয় জাবির ইবনে হাইয়ান। সাধনার ফলে তিনি দুই হাজারেরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ বই রচনা করেন। এসব গ্রন্থের মধ্যে শুধু চিকিৎসা শাস্ত্রের রয়েছে পাঁচ শত বই। বিজ্ঞানের অনেক গ্রন্থ তিনি রচনা করেন, তার মধ্যে একটি বই দুই হাজার পৃষ্ঠার রয়েছে। রসায়ন শাস্ত্রের ওপর প্রচুর গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। তাঁকে বলা হয় রসায়ন শাস্ত্রের জন্মদাতা। ইমাম বোখারী (রা.) হাদিস গ্রন্থ রচনা করতে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তিনি একটি হাদিস সংগ্রহ করতে তিন শত মাইল হেঁটেছেন। এভাবে গ্রন্থ রচনার নেশা সাধনা করতে করতে তিনি বিখ্যাত হন।
লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক