বইয়ের মানুষ, আলোর মানুষ

62

সময়টা এমন যে বাঙালিরা নতুন বই নিয়ে আনন্দ-উল্লাস করছে। কৃষকের ঘরে যখন নতুন ধান আসে, তখন তারা যাপিত কষ্টকে বিসর্জন দিয়ে মুখে হাসি ধরে রাখে। তেমনি লেখকরা যখন তাঁর কালো কালির কলমে লেখাসমগ্র বইয়ের মলাটে আবদ্ধ দেখে, তখন যেন লেখালেখির সার্থকতাকে খুঁজে ফেরেন। এই সার্থকতার যোগান দিয়ে থাকে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে লেখকদেরকে অনুপ্রেরণা দিতে বইমেলা ফিরে আসে। আগামীতেও ফিরে আসবে। কিন্তু আর কোনো দিন এই পৃথিবীতে ফিরে আসবে না একজন বইয়ের ফেরিওয়ালা পলান সরকার। তিনি এখন ভিন্নলোকে। গেরুয়া পাঞ্জাবী পড়ে,কাঁধে ব্যাগ ঝুঁলিয়ে, হাতে দু’খানা বই নিয়ে দুপুরের রোদ-বৃষ্টি পেরিয়ে কেউ আর ডাকবে না, ‘পড়বি কে কে, আয়রে তোরা, আয়।’ বইপ্রেমী পলান সরকারের নাম মানুষের মুখে মুখে। কে তাকে চিনে না? কেউ যদি বলে, ‘বইয়ের ফেরিওয়ালা কে?’ অনায়সে সবাই বলবে, ‘পলান সরকার।’ কেউ যদি বলে, ‘আলোর ফেরিওয়ালা কে?’ তবুও অনায়াসে সবাই বলবে, ‘পলান সরকার।’ তিনি বইয়ের আলোয় সমাজকে আলোকিত করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছোট-বড় সবার দোরগোড়ায় বই পৌঁছে দিতেন। এতেই তাঁর আত্মতৃিপ্তবোধ যে মানুষ বই পড়ার অভ্যাসটাকে চিরদিন ধরে রাখুক। প্রযুক্তির আগ্রাসনে বই পড়া যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, মানুষ যেন বই পড়া বন্ধ না করে, তাঁর স্বেচ্ছাপ্রোণোদিত কাজের মাধ্যমে তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।এমন পলান সরকার একাই যেন কয়েকশত আলোকবর্তিকা। পলান সরকারের কাজের মূল্যায়ন আমাদের সুশীল সমাজ করেছেন। তাঁর চলে যাওয়ায় অসংখ্য মানুষের অন্তর শিহরিত। অশ্রু ঝরেছে শতশত মানুষের। অনেক আগেইবাংলাদেশ সরকারও তাঁকে যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন। নিজের টাকায় বই কিনে পাঠকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বই পড়ার একটি আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ২০১১ সালে তাঁকে সমাজসেবায় একুশে পদকে সম্মানিত করা হয়েছে। তিনি চিরজীবন সম্মানিত হয়ে থাকবেন। পৃথিবীতে যারা বইকে ভালবেসেছেন, তারা স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। তার ব্যতিক্রম পলান সরকার হবেন না। মৃদু মৃদু পায়ে হেঁটে চলা ‘বইয়ের মানুষ’ আমাদের সবুজ পৃথিবীর বুকে হাঁটবেন, যতদিন আমরা বইকে আমাদের অন্তরে আগলে রাখব, বই পড়ার অভ্যাসকে লালন করব। পলান সরকার ১৯২১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম ছিল হারেজ উদ্দিন। তবে পলান সরকার নামেই তাঁকে আশেপাশের সকল মানুষ চিনতো। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, জন্মের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তাঁর বাবা মারা যান। তাঁর জীবন হারিয়ে ফেলে পিতৃস্নেহ। টাকা-পয়সার টানাটানির কারণেতাঁকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই একাডেমিকপড়াশোনায় ইতি টানতে হয়। তবে তিনি দমবার পাত্র ছিলেন না। দৃঢ় মনোবল নিয়ে নিজের চেষ্টাতেই পড়ালেখা চালিয়ে যান। বই তাঁকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। প্রতিষ্ঠানের মায়া কাটিয়ে উঠলেও বইয়ের পিছু ছাড়তে নারাজ। সময়টা যদি এখন হতো, হয়তো পলান সরকার তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারতেন। হয়তো তিনি একজন আনিসুজ্জামান, আবু সাঈদ কিংবা বিশেষ কেউ হতেন। তবে ভাগ্য তাকে যেখানেই নিয়ে যাক না কেন, বই থেকে বিতাড়িত করতে পারে নাই বলে আজ পলান সরকার একজন আলোচিত, আলোকিত ও সোনার মানুষ। তাকে নিয়ে আমরা গর্বিত। পলান সরকার একজন অসম্ভব বই পাগল মানুষ ছিলেন। এমন মানুষ পৃথিবীতে সত্যই বিরল। জানা যায়, তিনি স্থানীয় একটি উচ্চবিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন। প্রতিবছর বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা প্রথম থেকে দশের মধ্যে মেধা তালিকায় স্থান পেত, তাদেরকে তিনি একটি করে বই উপহার দিতেন। এখান থেকেই তাঁর বই বিতরণের অভিযান শুরু হয়। তাঁর হাত থেকে বই প্রাপ্তির আগ্রহবোধ শিক্ষার্থীদের মাঝে বেড়ে যায়। এরপরে তিনি সবাইকে বই দিতে থাকেন। এই বই দেওয়ার রেওয়াজ দু’এক বছরের নয়, তিনি এক টানা তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে বই বিতরণের কাজ করেছেন। বইয়ের পাতার সু-ঘ্্রাণ পাইয়ে দিয়ে মানুষের মন জয় করেছেন। তার চেতনাবোধ ছিল, নিজে বেশি দূর পড়তে পারি নাই। আমার মত যেন কেউ এমন না হয়। বইয়ের অভাবে যেন অজানা না থেকে কেউ। তার সাধ্য তাকে সাহস যুগিয়েছে।
বড় অবাক করার বিষয়, এই মানুষটির ডাক্তারি পরীক্ষায় ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। তিনি মোটেও বিচলিত হন না। তিনি অভিনব উপায় বের করেন। ডায়াবেটিসের জন্য হাঁটাহাঁটি অতিব জরুরি ভেবে পায়ে হেঁটে হেঁটে বই বিলির কাজ শুরু করে দেন। এমনই ভাবে রাজশাহী অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামজুড়ে তিনি গড়ে তোলেনে বই পড়ার এক অভিনব আন্দোলন। তাঁর কথা গণমাধ্যমে উঠে আসে। বিশ^বাসীও জানে একজন সাদা মনের মানুষের কালজয়ী গল্প, যেটি কেউ কখনও বইয়ের পাতায় এখনও পড়েনি, কোনো লেখক বইতে লিখেওনি।এমন অনেক পলান সরকার তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হতে থাকেন। পলান সরকার ৯৮ বছর বয়সে পহেলা মার্চ দুপুরে আমাদেরকে রেখে অন্য জগতে চলে যান। বার্ধক্যতা তাকে বইয়ের বোঝা বইতে দিল না।যে বইয়ের বহরে তিনি মানুষকে বইয়ের প্রতি ভালবাসার প্রবল বিশ্বাস শিখিয়েছেন। পৃথিবীর প্রাক্কালে হাজারও বই রচনা করা হবে, হাজারও পাঠক বই পড়বে। লেখকদেরকে স্মরণ করবে। লেখক ছিলেন না, নেতা ছিলেন না, তবে বই পাঠ আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন পলান সরকার, এই ভেবে পৃথিবীর মানুষ তাকে স্মরণ করবে হাজার বছর বা তারও অধিক সময় অজ্ঞতা, মূর্খতা আর পাপাচার যখন আমাদেরকে জাপটে ধরবে ধ্রুপদি আকাশ ভেদ করে পলান সরকার আমাদের বিবেকদ্বারে আসবে আর চমকপ্রদভাবে বলবেন, ‘হে মানব জাতি, তোমরা বই পড়। বই তোমাদের মুক্তি দিতে পারে।’
পলান সরকারের চলে যাওয়ায় আমি ব্যক্তিগতভাবে ব্যথিত, জাতি শোকাহত। তিনি আমাদেরকে যে পথ দেখিয়েছেন, সে পথে যেন আমরা চলতে পারি, সে প্রত্যাশা থেকে তার প্রতি বিম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক