ফ্রিদা কাহলোর স্বরূপের সন্ধানে

126

ফ্রিদা কাহলো এমন একজন আত্মজৈবনিক শিল্পী যিনি বিক্ষত ও বিভৎসতা অনুভবের মধ্য দিয়ে ক্লান্তিতে নুয়ে-পড়া জীবনকে অতিক্রান্ত করেছেন। তাঁর জীবন যেমন বহুভাবে বিক্ষিপ্ত, তেমনি তীব্রভাবে বিধ্বস্তও। যাঁরা ফ্রিদা কাহলো সম্পর্কে অবগত আছেন তারা জানেন, এই যে বিক্ষত-বিক্ষিপ্ত-বিধ্বস্ত জীবন-সেটির মূল উৎস তাঁর শারীরিক দুরাবস্থা ও অসামর্থতা। এটা সত্য, শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে ফ্রিদা কাহলোকে এসব দহন ও দুঃখ ভীষণভাবে সহযোগিতা করেছিলো। তিনি যেহেতু আত্মজৈবনিক শিল্পী, তাই তাঁর চিত্রকর্মের আলোচনা করার পূর্বে তাঁর জীবন সম্পর্কে ধারণা রাখা প্রয়োজন। কেননা, ফ্রিদা কাহলো সারাজীবন রঙ-তুলির মাধ্যমে নিজের অবস্থাকেই উপস্থাপন করেছেন।
ফ্রিদা কাহলোর জন্ম মেক্সিকো সিটিতে, ১৯০৭ সালের ৬ জুলাই। ফ্রিদা তাঁর জন্মের পর মৃত্যু অবধি খুব কমসময়ই সুন্দরের সাথে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। ১৯১৩ সাল, রবীন্দ্রনাথ যে বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন, তখন ফ্রিদার বয়স মাত্র ছয়। এ বয়সেই পোলিওতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। এ রোগে চিকন হয়ে গেলো তাঁর ডান পা। এমনকি বাঁকা হয়ে গেলো পায়ের পাতাও। শৈশব থেকে এই পা-খানি লোকচক্ষুর আড়াল করার জন্যে ফ্রিদা প্রথমে ট্রাউজার, পরে মেক্সিকান পোশাকে নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন। গেঘময়ে ফ্রিদা জানতেন না যে,
স্রষ্টা তাঁর জন্যে ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ কিছু জমা রেখেছিলেন। এই ‘ভয়াবহ’ অবস্থা এমনি যে-যার জন্যে তাঁকে আমৃত্যু জ্বলে-পুড়ে ছাই হতে হয়েছে। ১৯২৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, তখন ফ্রিদার বয়স আঠারো। দিনটি বৃষ্টিতে মাখামাখি। ফ্রিদা মেক্সিকান সিটি থেকে কোরোকান যাচ্ছিলেন। হঠাৎই বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রলির সাথে তীব্র ধাক্কা খেলো। বিশিষ্ট চিত্রসমালোচক অমিতাভ মৈত্র এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘একটা মোটা লোহার পাত ফ্রিদার শিড়দাঁড়া চূর্ণ করে, তলপেট জননঅঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে এসেছে রক্ত ক্লেদ মাংস মাখামাখি হয়ে। পরে দেখা গেল এছাড়া ফ্রিদার কাঁধ, পাঁজরের দুটো হাড় ভেঙেছে। এগারো টুকরো হয়ে গেছে ডান পায়ের হাড়, পায়ের পাতা ভেঙে দুমড়ে গেছে।’ এ দুর্ঘটনাটিই ফ্রিদার জীবনের আলো কেড়ে নিলো এবং তাঁর যাপনকে এক ঝলকে পতিত করলো ঘোর অমাবস্যায়। দুর্ঘটনার কারণে পরবর্তীতে ফ্রিদার শরীরে ৩২ বার অপারেশন করতে হয়। বলা হয়ে থাকে, মেক্সিকান এ শিল্পী তাঁর জীবনের তিনভাগের একভাগ হাসপাতালে কাটিয়েছেন। ফ্রিদা কাহলো ম্যুরালশিল্পী দিয়েগো রিভেরার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। ১৯২৯ সালের ২১ আগস্ট ২২ বছর বয়সে ফ্রিদা ৪২ বছর বয়সী রিভেরাকে বিয়ে করেন। ফ্রিদা রিভেরার মধ্য দিয়ে তাঁর অপূর্ণ জীবনের পূর্ণতা খুঁজে পেয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তাও টেকসই হয়নি। গবেষকগণ মনে করেন, তাদের সম্পর্কের তিক্ততার পেছনে ‘হঠকারিতা’ ও ‘বিবিধ সম্পর্ক’ই দায়ী। ফ্রিদা কাহলো আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের মারাত্মক দুর্ঘটনা দুটি। একটি বাসের দুর্ঘটনা, অন্যটি দিয়েগো।’
ফিদ্রার কাহলোর বাবা গুইলেরমো কাহলো ছিলেন একজন ফটোগ্রাফার। যখন ফ্রিদা বাস দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত, কোনো কিছুতে মন বসছে না তাঁর, গেঘময়ে গুইলেরমো মেয়ের হাতে রঙ-তুলি তুলে দেন। যদিও কোনো লক্ষ্য ছাড়াই ফ্রিদা রঙ-তুলি হাতে নিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি চিত্রকলাকেই প্রবলভাবে আকড়ে ধরে ছিলেন। ১৯২৬ সালে তাঁর আঁকা প্রথম চিত্রকর্মটি ক্যানভাসে বন্দী হয়। চিত্রটির শিরোনাম ছিলো ‘Self Portrait in a Velvet Dress’। ফ্রিদা কাহলো সারাজীবন ১শ’ ৪৩টি ছবি এঁকেছেন। এ ছবিগুলোর মধ্যে ৫০টি ছবি রয়েছে, যে ছবিগুলোতে নিজেকে নিজে এঁকেছেন ফ্রিদা কাহলো। ফ্রিদা কাহলোকে আত্মজৈবনিক শিল্পী বলা হয়, কারণ, তাঁর ছবি শৈল্পিকরূপে তাঁকে ও তাঁর জীবনকে নানাভাবে ক্যানভাসে উপস্থাপন করেছে। স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তি জীবনের তীব্র দহন, ভাঙন, অসুস্থতা ফ্রিদার দেহ থেকে তাঁর ক্যানভাস পর্যন্ত সঞ্চারিত হয়েছিলো। ফলে তাঁর আঁকা ছবিগুলো হয়ে উঠেছে স্বরবিদ্ধ, নির্মম জখমভরা এবং ভীষণভাবে রক্তাক্ত। এর বাইরের কিছু কিছু ছবি আছে, যে ছবিগুলো কিছুটা আলো ও কিছুটা আঁধার মিশ্রিত।
ফ্রিদার প্রতিকৃতির প্রায় প্রতিটি মুখই নির্মোহ ও নির্মল। যদিও কোনো ছবিতে ফ্রিদা হরিণরূপী তীরবিদ্ধ, কোনো ছবিতে দেহ ভেদ করে অসংখ্য প্রত্যাশার শেকড় ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে, কোনো কোনো ছবিতে তাঁর প্রতিটি অঙ্গই বিক্ষিপ্ত তবু এসব তীর, শেকড়, বিক্ষপ্ততার বেদনা তাঁর মুখমন্ডলকে স্পর্শ করেনি। তাঁর মুখ দেখে মনেই হবে না তাঁর শরীরভরা ক্ষত ও বিষণ্ণতার নহর। এ প্রসঙ্গে আমরা ফ্রিদা কাহলোর Henry Ford Hospital (The Flying Bed), The wounded deer, Roots, The Broken Column, The Two Fridas ইত্যাদির ছবিগুলোর কথা উল্লেখ করতে পারি।
ফ্রিদার যে ছবিগুলো কেবলই তার প্রতিকৃতি, সে ছবিগুলো আরো অনেক বেশি নির্মোহ এবং অস্পর্শনীয়। ফ্রিদা কাহলোর অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি Self-Portrait with Thorn Necklace and Hummingbird. এটি ১৯৪০ সালে আঁকা। প্রতিকৃতিতে চোখ রাখলে চোখে পড়ে ফ্রিদার গলায় গুল্মের নেকলেস ঝুলছে। সে নেকলেসে কালো রঙের একটি মৃত হামিংবার্ড ঝুলে আছে। গুল্মের নেকলেস পরার কারণে ফ্রিদার গলা কিছুটা রক্তাক্ত। প্রতিকৃতির পেছনে ডানপাশে একটি কালো বিড়াল উঁকি দিচ্ছে এবং বামপাশে একটি বানর বসে আছে। তার পেছনে অনেকগুলো পাতা রয়েছে। যার মধ্যে অধিকাংশ পাতা সবুজ, একটি সম্পূর্ণ হলুদ পাতা, কিছু পাতা হলুদ বর্ণ ধারণের অপেক্ষায় আছে। ফ্রিদার মাথার ওপর দুটি প্রজাপতি এবং তার ওপরে দুটি ফড়িং উড়ছে। ফ্রিদার পরণে সাদা পোশাক এবং যথারীতি তাঁর মুখ নির্মোহ। এই প্রতিকৃতিতে ফ্রিদা অনেকগুলো প্রতীকের ব্যবহার করেছেন। বিশেষত, নেকলেসে ঝুলে থাকা মৃত, কালো হামিংবার্ডটি ফ্রিদার জীবনের অন্তর্যাতনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বর্ণিল হামিংবার্ডটি ডানা মেলে আকাশে ওড়ার কথা, অথচ পাখিটি আজ প্রঠুহীন। ফ্রিদার জীবনও একই রকমের। অনেক অনেক স্বপ্ন নিয়েও ফ্রিদা বন্দী, সেও অন্ধকারের রঙ গায়ে মেখে পৃথিবীতে ঝুলে আছে।Self-Portrait with Thorn Necklace and Hummingbird প্রতিকৃতিটির কথা এজন্যে বলা, এই ছবিটির যে ভাব, বক্তব্য, প্রতীকের ব্যবহার তার ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি ফ্রিদার অধিকাংশ ছবিগুলোর মধ্যেই ছড়িয়ে আছে।
ফ্রিদা মেক্সিকান এবং তিনি তাঁর দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতি আস্থাবান ছিলেন। লেখক ও সমালোচক ইমরে কাজিটসি মনে করেন, ফিদ্রা কাহলো রূঢ় বাস্তবকে স্বপ্নের মিশেলে খ্রিস্টীয় প্রতীকের মাধ্যমে চিত্রকলায় প্রকাশ করেছেন। বানর, হামিংবার্ড, বিড়াল, প্রজাপতি এগুলো মেক্সিকান প্রতীক। অন্যদিকে গুল্মের নেকলেসটি খ্রিস্টীয় মিথের প্রতীক। ইমরে কাজিটসি আরো একটি বিষয় তুলে ধরেছেন। ফ্রিদার বিখ্যাত চিত্রকর্ম দ্য লিটল ডিয়ার-এ তিনি ইতালিয়ান প্রখ্যাত শিল্পী আন্দ্রে মন্তেগনা’র (১৪৩১-১৫০৬) আঁকা ‘সেইন্ট সেবাস্টিন’ চিত্রকর্মটির অনুরণন খুঁজে পেয়েছেন। এই ছবিটিও খ্রিস্টীয় মিথকে সামনে নিয়ে আসে। খ্রিস্টীয় মিথ ও মেক্সিকান ঐতিহ্য এবং ফ্রিদার সমুদয় বেদনা, খানিক প্রশান্তি ও আকাক্সক্ষার মিশেলে যে ফ্রিদার চিত্রকর্মগুলো তৈরি হয়েছে তাঁর ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
ফ্রিদা কাহলোর ছবিতে নগ্নতার ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। তবে তাঁর এই নগ্নতা যৌনতার প্রতীক নয়। তাঁর নগ্নতাও যথারীতি পীড়াকে দীপ্যমান করেছে। অন্যদিকে ফ্রিদা তাঁর জীবনসঙ্গী দিয়েগো রিভেরাকে নিয়েও ক্যানভাস রাঙিয়েছেন। পূর্বে বলেছি, বাস দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ফ্রিদা মাংসপিন্ডে পরিণত হয়েছিলেন। সন্তানের আকাক্সক্ষা ফ্রিদাকে সারাজীবন কুরে কুরে খেয়েছে। তাঁর এ অক্ষমতার দীর্ঘশ্বাস শিল্পের মর্যাদা লাভ করতে সমর্থ হয়েছে। ফ্রিদার কিছু সংখ্যক ছবিতে সন্তানের জন্যে কাতরতা ও মাতৃত্বের আকাক্সক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
ফ্রিদা কাহলো নিজের জীবন ও যাপনকে কেন আঁকতেন এ প্রশ্ন সহজভাবেই সামনে আসে। এর ব্যাখ্যা হতে পারে এরকম ফ্রিদার জীবনের সবচেয়ে বড় একটি বিষয় ‘বাস দুর্ঘটনা’। অন্যদিকে রিভেরা-বিচ্ছেদও কম বড় ঘটনা নয়। ফ্রিদার জীবনের এরচেয়ে বড় কোনো ঘটনা আসেনি, যে ঘটনা তাঁকে এবং তাঁর শিল্পকে অতিমাত্রায় প্রভাবিত করতে পারে এবং চলমান সময় থেকে তিনি নিস্তার লাভ করতে পারেন। ফলে ফ্রিদা তাঁর জীবনের বড় ঘটনা প্রবাহটিকেই বারবার এঁকেছিলেন। ফ্রিদা নিজেই একবার বলেছিলেন, ‘আমি প্রায় সময়ই একাকিত্বের মধ্যে নিমজ্জিত থাকি। আমি কেবল আমার ছবি আঁকি, কারণ, ব্যক্তি আমিই হচ্ছে এমন একটি বিষয়, যাকে আমি সবচেয়ে ভালোভাবে জানি।’ ফ্রিদা মনে করেন, যদিও তাঁর ছবিগুলো বেদনার প্রকাশবাহক, তবু চিত্রকলাই তাঁর জীবনকে পূর্ণতা দিয়েছে। ফ্রিদার আত্মবিশ্বাস যে যথাযথ, তা আর নতুন করে বলা সময়ক্ষেপণ মাত্র। জীবনের দুঃখ ও নিরাশা, দহন ও পীড়ন যে জীবনকে অর্থবহ ও প্রসারিত করতে পারে এটি ভাবা খুব কষ্টসাধ্য। কিন্তু একজন ফ্রিদা কাহলো এই ভাবনার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য উদাহরণ হয়ে রইলেন। তাঁর সৃষ্টি তাঁকে শিল্পের রাজদরবারে অমর করে রেখেছে। একজন শিল্পীর জন্যে এমন প্রাপ্তি সর্বোচ্চ আনন্দের ও জীবনের জন্যে সর্বোচ্চ সার্থকতার।