ফিরে দেখা:- ২০১৯সাল ২০১৯ এর সালতামামি-মহেশখালী

79

২০১৯সালে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সবচেয়ে আলোচিত দিন ছিল ২৩ নভেম্বর। ইতিহাসের এইদিনে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ৯৬জন জলদস্যু অন্ধকার জগৎ ছেড়ে আলোর পথে আসার আশায় বুক বেঁধে তাদের কৃতকর্মের অবসান ঘটিয়ে নিজেদের ব্যবহৃত অস্ত্র ও গোলাবারুধ জমা দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপির হাতে আত্মসমর্পণ করেছিল।
২৩ নভেম্বর ওই দিনে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ব্রান্ডের ১৫৫ টি অস্ত্র, ২৭৫ টি গুলিসহ সাগর উপকূলের ১২ বাহিনীর ৯৬ সদস্য আত্মসমর্পণ করেছিল । সেখান শীর্ষস্থানীয় ১২ জন অস্ত্র তৈরির কারিগর এবং ৮৪জন জলদস্যু স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনের আশায় । ওইদিন ২৩ নভেম্বর সকাল ১১ টার সময় কক্সববাজার জেলা পুলিশের আয়োজনে ‘আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান’টি মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর আগে ৯৬ জন তালিকাভুক্ত জলদস্যু, অবৈধ অস্ত্রধারী ও অস্ত্র তৈরির কারিগরকে সেফহোম থেকে প্রিজন ভ্যানে করে অনুষ্ঠানস্থলে আনা হয়।
জীবনের ভুল স্বীকার করে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সিরাজ বাহিনীর প্রধান সিরাজদৌল্লাহ। অভিশপ্ত জীবন থেকে ফিরে মুক্ত জীবনের চিত্র তুলে ধরেন এর আগের বছর ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর আত্মসমর্পণকারী জলদস্যু নুরুল আমিন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপির বক্তব্যে বলেন, হত্যা ও নারী ধর্ষণ অপরাধের মামলাগুলো আদালতের নিয়মে চলমান থাকবে।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানেরর গেস্ট অব অনার আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, বাংলাদেশের মাটিতে কোন জঙ্গি, সন্ত্রাসী, অপরাধীর স্থান হবেনা। যে কোন সময় ৯৯৯ নাম্বারে কল করে পুলিশের অনিয়মের বিরুদ্ধেও বলতে পারবেন। সে যেই হোক অপরাধীর ছাড় নেই।
পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন- কক্সবাজার -১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম, কক্সবাজার-২ (কুতুবদিয়া-মহেশখালী) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক, কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান,জেলা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি সাংবাদিক তোফায়েল আহমদ। এছাড়া থানার ওসি ও পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যের আগ মুহূর্তে আত্মসমর্পণকারীদের কাছ থেকে অস্ত্র গুলাবারুধ জমা নিয়ে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়া হয় তাদের। আত্মসমর্পণকারী প্রত্যেককে দেয়া হয়েছে ৫০ হাজার টাকার আর্থিক অনুদান। অনুষ্ঠানের পর তাদের অস্ত্র আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
তালিকাভুক্ত জলদস্যু, অবৈধ অস্ত্রধারী ও অস্ত্র তৈরির কারিগরদের আত্মসমর্পণে মধ্যস্থতা করে সংবর্ধিত হলেন আনন্দ টিভির চট্টগ্রাম ব্যুরো অফিস ইনচার্জ ও কক্সবাজারের পেকুয়ার কৃতি সন্তান সাংবাদিক এমএম আকরাম হোসাইন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি নিজেই তাকে অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত করেন। যুগযুগ ধরে যাদের খোঁজে প্রশাসনকে অভিযানের পর অভিযান চালাতে হয়েছে তারাই স্বেচ্ছায় প্রশাসনের হাতে ধরা দিয়েছে। যেটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত। যাদের কারণে মহেশখালীর কালারমারছড়াসহ আশপাশের এলাকা অশান্ত থাকতো; গ্রæপিংয়ের কবলে পড়ে ঘটেছে অসংখ্য খুনের ঘটনা; ঝরেছে লাশ; জলদস্যুতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খেসারত হিসেবে বছরের পর বছর ফেরারি জীবন কেটেছে, এমন লোকও আত্মসমর্পণ করেছে। তারা জীবনে আর অপরাধ করবে না বলে নিজের মাতৃভূমির মাটি ছুঁয়ে শপথ করেছিল।
আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে রয়েছে মানসম্মত অস্ত্র তৈরির জন্য বিখ্যাত কারিগর জাফর আলম, মহেশখালীর কালারমারছড়ার আলোচিত জিয়া বাহিনীর প্রধান জিয়াউর রহমান জিয়া, তার বাহিনীর সদস্য মানিক, আয়াতুল্লাহ, আব্দুস শুকুর, সিরিপ মিয়া, একরাম ও বশিরসহ অন্তত ১৫ জন।
চেয়ারম্যান তারেক শরীফের অনুসারী হিসেবে পরিচিত কালা জাহাঙ্গীর বাহিনীর প্রধান জাহাঙ্গীর আলম, সদস্য আবুলু, সোনা মিয়া, জমির উদ্দীনসহ প্রায় ১৫ জন, নুনাছড়ির মাহমুদল্লাহ বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ আলী, সেকেন্ড ইন কমান্ড বদাইয়াসহ ১৫ জন, ঝাপুয়ার সিরাজ বাহিনীর প্রধান সিরাজউদ্দৌল্লাহ, নলবিলার মুজিব বাহিনীর প্রধান মজিবুর রহমান প্রকাশ শেখ মুজিব এবং কুতুবদিয়ার লেমশীখালীর কালু বাহিনীর প্রধান মোঃ কালু প্রকাশ গুরা কালুসহ তার বাহিনীর ১৫/২০ জন।
প্রায় এক যুগ আগে জিয়াউর রহমান জিয়া বাহিনী ও ছৈয়দ নূরের (নিহত) বাহিনীর মধ্যে প্রায় সময় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতো। তাদের গ্রæপিংয়ের শিকার হয়ে অন্তত ২০ জনের প্রাণ গেছে। ঘরছাড়া হয়েছে শত শত যুবক। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জিয়া বাহিনীর সদস্যদের আধিপত্য অনেকটা কমে যায়।
২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর মহেশখালীতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুধ সহ ৪৩ জলদস্যু আত্মসমর্পণ করে। সেখানে ৫ বাহিনীর ৩৭ জন এমএম আকরাম হোসাইনের মধ্যস্থতায় হয়েছে। তারা প্রতিজন ১ লক্ষ টাকা করে সরকারিভাবে আর্থিক অনুদান পেয়েছিল। এরা সাবাই কারামুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে।
তারপরও শান্তি ফিরবে কি ? দ্বীপের সাধারণ মানুষের কাছে এমনই প্রশ্ন রয়ে গেছে । কারণ ৯৬জন জলদস্যু ও অস্ত্রেরকারিগর আত্মসমর্পণের পরও দাগি সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন বাহিনির হাতে ধরা পড়ছে।