ফিরে দেখা ২০১৮ : অন্যরকম নির্বাচনের বছর

75

‘মানুষ হারায় গল্প বেঁচে থাকে/একলা আকাশ সব তারাদের ডাকে
খসে পড়া তারাগুলো কোন গল্পে নাই!/মহাকালের কাছে আজও গল্প চাই
কেমন করে হারায় মানুষ বলবো তাই!’
প্রিয় তুনাবী,
কেমন আছো?
আমার জীবন থেকে তুমি হারিয়ে গেলেও তোমার গল্প বেঁচে আছে। আমার কোনও গল্প তোমার কাছে নেই তুনাবী, কারণ আমি খসে পড়া তারা! খসে পড়া তারাদের মতো পরাজিতদের গল্প কেউ শুনতে চায় না। বিজয়ীর হাত ধরে হাঁটে পৃথিবীর সব সুখ-হাসি। (তুনাবী তোমার জন্য পরাজিত হতে ভালোবাসি!) বিজয়ী যদি ট্রাম্পের মতো উন্মাদ হয় তাহলেও ক্ষতি নেই। বিজয়টাই আসল। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে একচেটিয়া জয় পেয়েছে মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ নিজেরাই পেয়েছে ২৫৯ আসন আর বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট পেয়েছে ৭টি আসন। জানি না বিএনপি তথা জোটের ভাগ্যবান সাতজন কিভাবে জিতেছে। হেরে যাওয়া এই আমার যেমন কোনও গল্প নেই তেমনি তোমার হৃদয়ে আমার জন্য কোনও কোটা কী এখন আর অবশিষ্ট আছে তুনাবী?
এই কোটা নিয়ে কিনা হয়ে গেলো দেশে এ বছর। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছিল। তুনাবী, তোমার বাবা যেমন কখনই আমাকে ভালো চোখে দেখেননি ঠিক তেমনি কোটা আন্দোলনকেও আওয়ামী লীগ সরকার ভালো চোখে দেখেনি। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়ে কোটা বাতিল করেছেন। তবু যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত তাদের অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এম আবদুস সোবাহান ‘বাম ঘরানা ও শিবিরের’ কারসাজি যাকে সংক্ষেপে তিনি ‘বাঁশি’ উপাধি দিয়েছিলেন। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের কার্যক্রমকে জঙ্গিদের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ২০ জন ছাত্রীকে মাঝরাতে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল,ছাত্রদের হাতুড়িপেটা করা হয়েছিল। তোমাকে না পেয়ে আমার হৃদয়টা যেমন হাতুড়িপেটা হয়ে গেছে তেমনি হাতুড়িপেটাই ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে জড়িত কারো কারো একমাত্র প্রাপ্তি।
তুনাবী, হাতুড়িপেটা হলেও হয়তো জাহাঙ্গীর আলম এমন কষ্ট পেতেন না। গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলমের দুঃখটা আমরা কেউ হয়তো স্পর্শ করতে পারবো না। দুই পরিবহনের বাসের রেস আর রেষারেষিতে বাসের চাকার নিচে জীবন দিয়েছিল জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে দিয়া খানম মীম (ঘটনাটা ২৯ জুলাই ২০১৮’র)। জানি না মেয়ের মৃত্যুর পর বাসের চালক হওয়ার কারণে কোনও গøানি জাহাঙ্গীর আলমকে এখনও কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে কিনা। জানি না এমন হৃদয় বিদারক ঘটনার পর টেলিভিশনে নৌ-পরিবহন মন্ত্রীর হাসিটা জাহাঙ্গীর সাহেবের এখনও মনে আছে কিনা। মন্ত্রী শাজাহান খান যদিও এমন হাসির পর ক্ষমা চেয়েছেন। ত্রিশ বছর ধরে যিনি দূরপাল্লার বাস চালান (নিহত মীমের বাবা) সেই জাহাঙ্গীর আলম সাহেব বলেছেন, মালিকদের আত্মীয়-স্বজন আর নেশাখোরদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে স্টিয়ারিংয়ের ভার। দিয়া খানম মীমের মতো ভাগ্যহীন আরেকজনের নাম আবদুল করীম ওরফে রাজীব ওরফে রাজু। ছেলেটা বাবাকে হারিয়েছিল আগেই। খালাত ভাইয়ের বাসায় থেকে পড়ালেখা করতো ছেলেটা। একই দিনে দিয়া খানম মীমের মতো বাসের চাকার নিচে শেষ হয়ে গিয়েছিল রাজুর দুঃখের জীবন।
প্রিয় তুনাবী, রাজু আর মীমের মতো দুই বাসের প্রতিযোগিতার মাঝে পরে হাত হারিয়েছিল রাজীব। বহু চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো যায়নি। এই তালিকায় আরও আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাহরিয়ার সৌরভ, মাসুদ রানা,পায়েল আর গৃহকর্মী রোজিনার নাম। রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরেনি, রাস্তায় নেমে ঘরে ফিরতে না পারার দুঃখ যাদের জীবনে নাম লিখছে সেই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মন্ত্রীর হাসি তবু কমেনি এখনও।
প্রিয় তুনাবী, তুমি কী এখনও শব্দ করে হাসো? সিনেমা দেখতে গিয়ে চোখের জল ফেলো? এখনও কি ছবি তুলতে ভালোবাসো? তুনাবী মন খারাপ হয়ে গেলে তুমি দুটো গান বেশি শুনতে। একটা ‘সেই তুমি কেন এতো অচেনা হলে’ আর অন্যটা ‘ফেরারী এ মনটা আমার’। এমন অনেক কালজয়ী গানের স্রষ্টা আইয়ুব বাচ্চু মারা গেছেন এবছরের অক্টোবরে। হাসতে দেখ গাইতে দেখ, দেখে না কেউ হাসি শেষের নীরবতা এই গানের মতো হাসি শেষের নীরবতা নিয়ে তিনি উড়াল দিয়েছেন আকাশে। শেষ ঠিকানার কথাও বলে গিয়েছিলেন গানে গানে। ‘ঠিকানা শুধু এক সমাধি সাড়ে তিনহাত মাটি!’ আইয়ুব বাচ্চুর মতো তোমার প্রিয় ক্যামেরার কবি আনোয়ার হোসেন সাহেব মারা গেছেন এ বছর। মারা গেছেন অভিনেতা ও পরিচালক সাইদুল আনাম টুটুল। মারা গেছেন তোমার প্রিয় ছবি গোলাপী এখন ট্রেনের পরিচালক আমজাদ হোসেন। এদেশের কালজয়ী ছবি জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’র চিত্রনাট্য লিখেছিলেন আমজাদ হোসেন। আর কখনও তিনি লিখবেন না হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ, কেউ কোনোদিন আমারে তো কথা দিলো না, জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো কিংবা এই দুনিয়া এখনতো আর সেই দুনিয়া নাই-এর মতো কালজয়ী গান।
তুনাবী, এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই এর মতো এই বাংলাদেশ এখন কিন্তু সেই বাংলাদেশ নেই।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ইনডেমনিটি আইন করা হয়েছিল যেন এই হত্যার বিচার না হয়। সেই হত্যার বিচার হয়েছে,অনেকের দন্ড কার্যকর হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে অনেকের বিচার হয়েছে, অনেকের রায় কার্যকর হয়েছে, কারো কারো বিচার এখনও চলছে। এই ধারাবাহিকতায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় হয়েছে। খালেদা জিয়া তনয় তারেক রহমানের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে। এতিমখানার অর্থ আত্মসাৎ মামলার রায় হয়েছে,খালেদা জিয়া পুরনো জেলখানার একমাত্র বন্দী হিসেবে জেল খাটছেন। ক্ষমতায় থেকে কোনও দুর্নীতি বা অবিচার করলে যে কারও পরিণতি কি এখন থেকে এমনই হবে?
তুনাবী, আমার পরিণতি কী হবে শেষ বয়সে? কোনও এক বৃদ্ধাশ্রমে নীরবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে? অপেক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সাধনা থাকলে মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে পারে, দারুণভাবে ফিরে আসতে পারে জীবনে। আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক মাহাথির মোহাম্মদ বৃদ্ধ বয়সে ফিরে এসেছেন, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন। মানুষ অনেক কিছু পারে। কল্পনার বাইরে থাকা কিছু জিনিস ঘটে যায় সবাইকে চমকে দিয়ে। তুনাবী, আমি জানি তুমি কখনও ফিরে আসবে না, আমাকে চমকে দেবে না। তবে শেখ হাসিনা চমক দেখিয়েছেন। যে হেফাজতে ইসলাম রাজধানী ঢাকাকে অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল, যারা শত শত মানুষ হত্যার অভিযোগ তুলেছিল আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে, সেই হেফাজতে ইসলামী ঘটা করে সংবর্ধনা দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে, প্রধানমন্ত্রীকে উপাধি দেওয়া হয়েছিল ‘কওমি জননী’ হিসেবে। শেখ হাসিনার সরকার কওমি সার্টিফিকেটের স্বীকৃতি দিয়েছেন।
রাজনীতি প্রেম আর যুদ্ধে নাকি সবই সম্ভব, শেষ কথা বলে কিছু নেই। আর তাই তুমি আসবে না জেনেও আজো তোমার জন্য প্রতীক্ষায় থাকি তুনাবী!
এই প্রতীক্ষার শেষ কোথায় আমি জানি না। শুধু জানি ফয়সাল আর কখনও ফিরে আসবে না। জানতে চাইবে না এই বইমেলায় কয়টা বই বের হবে? তুনাবী, ফয়সলকে তুমি কখনও দেখনি। শরীয়তপুর থেকে ঢাকায় এসেছিল ছেলেটা সাংবাদিকতা করতে। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে সাংবাদিকতা নিয়ে লেখাপড়া শেষ করে এসেছিল বৈশাখী টেলিভিশনে। অসম্ভব বিনয়ী ও সুদর্শন এই ছেলেটা ক্যামেরার পেছনেই কাজ করতো। হারিয়ে যাওয়ার আগে শেষ স্মৃতিটা রেখে গিয়েছিল বৈশাখীতেই। ৭১’ সালের কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর আজও যারা বেঁচে আছেন তাদের কয়েকজনকে খুঁজে বের করেছিল সে। যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হাতে বুলেটবিদ্ধ হয়েছিলেন, ফয়সাল তার হাত ছুঁয়ে যেন বলতে গিয়েছিল রক্ত দিয়ে কিনেছি স্বাধীনতা, কারও দয়ায় পাওয়া নয়। যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা পায়ে বুলেটবিদ্ধ হওয়ার কারণে বাকিটা জীবন কাটিয়েছেন হুইলচেয়ারে,ফয়সাল যেন তাকে বলতে গিয়েছিল মানুষ কখনও সখনও টিকটিকি হলে ভালো হতো। লেজ চলে গেলে টিকটিকির লেজ গজায়। মানুষের যদি পা গজাতো! কাউকে কিছু না বলে ফয়সাল যাচ্ছিল নেপাল। এবছরের মার্চে ইউএস বাংলার একটি বিমান নেপালের এয়ারপোর্টে বিধ্বস্ত হলে পঞ্চাশ জন মারা যান যার ভেতর ফয়সালও ছিল। তুনাবী বলতে পারো দূর আকাশের কোনও নীরব গাঁয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে আহমেদ ফয়সালকে?
তুনাবী, তুমিহীনা আরও একটা বছর চলে গেলো। এমন কোনও ডাস্টার নেই যা দিয়ে এত বছরের স্মৃতিগুলো জীবনের ব্ল্যাকবোর্ড থেকে মুছে ফেলতে পারি। তবে তোমার রেখে যাওয়া সেই বাংলাদেশ এখন আর নেই। এখানে এখনও অনেক কিছু সম্ভব। ড. কামাল হোসেন যেভাবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করতে পারেন আমিও তোমার বাবা মায়ের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করতে পারবো। তোমার বাবা কোনও উচ্চবাচ্য করলে আমি কামাল হোসেনের মতো বলে দিতে পারবো- ‘খামোশ’! বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন মাশরাফি বিন মর্তুজার মতো তুনাবী তোমাকে নামাতে পারবো রাজনীতিতে। তুনাবী শেষমেশ সবাইকে পেছনে ফেলে,সবাইকে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় রেখে শেখ হাসিনা যেভাবে দলকে নির্বাচনে জিতিয়ে এনেছেন আমি তোমাকে সেভাবে জিতিয়ে আনতে পারবো নির্বাচনে। জামায়াতের সব প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। বিশ্বাস করো তুনাবী এবার ঐক্যফ্রন্টের যে সাতজন জিতেছে প্রয়োজনে তাদেরকেও ফেল করিয়ে ছাড়বো।
তুনাবী, তুমি কি একবার ফিরে আসবে বাংলাদেশে? একবার এসে বলবে- ভুলে যাবো তাই মনে রাখার এত আয়োজন!
ইতি
তোমারই চালচুলোহীন
মুনাদ
লেখক : রম্যলেখক