ফটিক

154

মোয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি কানে যেতেই আলী ডাক দিয়ে উঠেÑ এই ফটিক উঠ। তাড়াতাড়ি উঠ। ট্রেন আওয়নের সময় ওইছে। ফটিক পাশ ফিরে শোয়। আড়মোড়া ভাঙ্গে।
ফটিকের পুরো নাম ফারুক আহাম্মদ। মা আদর করে ডাকতেন ‘ফটিক’। সদ্য শিশুকাল পেরিয়ে কৈশরে পা দিয়েছে। মা-বাবা বেঁচে নেই। ফটিক পৃথিবীতে আসার একমাস আগে এক সড়ক দূর্ঘটনায় ওর বাবা মারা যায়। সে শুধু জানে তার মা ছিল। ফটিকের বয়স পাঁচ বৎসর হতে না হতে তার মাও ফাঁকি গিয়ে চলে যায় আপন গন্তব্যে। এখন সে একাই বেঁচে আছে। আপনজন বলতে তেমন কেউ নেই। অনাদর আর অবহেলায় এইটুকু বড় হয়েছে। ক্ষুধার জ্বালায় মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে যখন এক মুঠো ভাতও জোটে না, তখন সে পাড়ি জমায় শহরের দিকে।
শহরের কোলাহল আর হরেক রকম গাড়ি দেখে ফটিকের ভালই লাগে। এর আগে সে কখনো এতো গাড়ি দেখেনি। মনে মনে ভাবে চারদিকে এত্তো মানুষ, কেউ না কেউ খাওন দেবোই।’ স্টেশন থেকে বের হয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় সে লালদিঘীর পাড়ে এসে পৌঁছে। বেশ ক্লান্ত। আর পা চলে না। তাই শুয়ে পড়ে লালদিঘীর সবুজ চত্বরে। অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পর আর ইচ্ছা করছে না শুয়ে থাকতে। গতকাল থেকে এ পর্যন্ত কোন দানা-পানি পড়েনি তার পেটে। তাছাড়া অনেকটা পথ হাঁটতে ক্ষুধার জ্বালা তীব্র আকার ধারণ করেছে। তাই বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারলো না। কষ্ট হলেও নিজের প্রয়োজনে কোনরূপে উঠে আবার হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে আন্দরকিল্লা মোড়ে এক হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। হোটেলের ভেতর অনেক লোক পানাহারে ব্যস্ত। কেউ পোলাও বিরানী, কেউ মিষ্টি, সন্দেশ, কেউ হালুয়া পরটা ইত্যাদি খাচ্ছে। হোটেলের মধ্যে হরেক রকম মজার মজাার খাবার দেখে ফটিকের চোখ জুড়িয়ে যায়। যা সে জীবনেও খায়নি। ফটিককে ফ্যাল ফ্যাল করে থাকিয়ে থাকতে দেখে হোটেল ম্যানেজার এক ধমক দিয়ে বলে ‘এই পোয়া, এড়ে কি ছর, ন গেলি এত্তুন।’
হোটেল ম্যানেজারের কথা শুনে ফটিক ভয় মিশ্রিত কণ্ঠে বলেÑআমার বড্ড ক্ষিধা লাগছে। কিছু খাওন ……..।
ফটিকের কথা শেষ না হতেই হোটেলের এক কর্মচারী এসে তাকে এক ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় রাস্তায়। এরপর আরো দু-এক জায়গায় ধর্ণা দেয়া খাবারের জন্য। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এ শহরে কোথাও মিলেনি ফটিকের জন্য একমুঠো অন্ন।
একসময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। পাখিরা উড়া বন্ধ করে। নগরের রাজপথে জ্বলে উঠে সোডিয়াম বাতি। ফটিক ফিরে আসে ষ্টেশনে, আবার গ্রামে চলে যাবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ছুটির দিন থাকায় আজ রাতে চট্টগ্রাম থেকে কোন ট্রেন ছাড়বে না। তাই ফটিকের আর যাওয়া হলো না। সে ষ্টেশনের প্লাটফর্মে হাঁটতে থাকে। ইতিমধ্যে প্লাটফর্মের ছাউনীতে শোবার জন্য হুড়োহুড়ি আরম্ভ হয়ে গেছে। সবার সাথে হুড়োহুড়িতে না গিয়ে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে পড়লো ফটিক। চিৎ হয়ে উপর দিকে চেয়ে দেখে আকাশটা আজ তারায় তারায় ছেয়ে আছে। নীল একটা চুমকি আটা জামার মত মনে হচ্ছে আকাশটাকে। চমৎকার দখিনা হাওয়া বইছে। ঐ রকম রাতগুলোতে কেন জানি ফটিকের মনটা হু হু করে ওঠে, আঁখি দুটো অশ্রæতে ভরে ওঠে। ‘আমি একা, একেবারে একা, আমার তো কেউ নেই।’ এমন একটা দুঃখ ফটিকের মনের ভেতর উথাল পাথাল করতে থাকে। মার কথা মনে আসে তার। কত ছোট বেলায় মাকে দেখেছে সে, চেহারাটাও এখন মনে নেইÑ বাবাকেতো দেখেইনি। অনেকদিন পর প্রাণ খুলে কাঁদতে থাকে সে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
খুব ভোরে ট্রেনের হুইসেলের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো ফটিকের। ট্রেন ইষ্টিশনে আসার সাথে সাথে ধাক্কাধাক্কি, হুড়োহুড়ি আরম্ভ হয়ে গেছে। কার আগে কে যাবে যাত্রীদের মধ্যে যেন এই প্রতিযোগিতা। ফটিকের সমবয়সি অনেক ছেলে যাত্রীদের কাছ থেকে ব্যাগ, সুইটকেস ইত্যাদি মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে। তাই দেখে ফটিকের মাথায় বুদ্ধি খেলে যায় মনে মনে ভাবে সেও কুলি কাজ করবে। কিন্তু বিধি বাম, ফটিক যেই না গিয়ে একজন মহিলা যাত্রীকে বলল Ñ‘আপা আপনার ব্যাগটা আমি নিই, অমনি চার-পাঁচজন লাল জামা পড়া কুলি এসে তার পিঠে লাগিয়ে দিল দু-চারটি কিল, ঘুষি আর লাথি। ফটিক চিৎ হয়ে পড়ে গেল ইস্টিশনের প্ল্যাটফর্মে। একজন বলে উঠল- ‘হারামজাদা আমাদের ভাত মারতে আইছে, নিয়ে চল দাদার কাছে।’
জব্বর আলী হচ্ছেন কুলিদের সর্দার। সম্মান করে সবাই তাকে দাদা বলে ডাকে। কুলিদের ভাল, মন্দ, বিচার, আচার সবকিছু জব্বর আলীই দেখাশুনা করে। ফটিককে তারা ধরে নিয়ে গেল জব্বর আলীর কাছে। জব্বর আলী তখনমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। ফটিককে ধরে নিয়ে আসতে দেখে জব্বর আলী জিজ্ঞাসা করে- ‘কি রে কি হইছে, তোরা ছেলেটাকে ধরে নিয়ে আইছস্ কেন্?
‘দাদা এই হারামীর বাচ্চা আইছে আমাগো ভাত মারতে। কুলি কাম করবো।’ কুলিরা জবাব দেয়। ফটিক ভয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। কাঁদস কেন? নতুন আইসজ বুঝি? দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে জব্বর আলী। ফটিক কোন কথা না বলে মাথা নেড়ে জবাব দেয়।
তোর বাপ-মা কোথায়?
মারা গেছে। ফুপিয়ে কেঁদে জবাব দেয় ফটিক।
বাবা মা বেঁচে নেই কথাটা শুনে জব্বর আলীর বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে উঠে। বুকের কাছে জমে থাকা অনেক দিনের পুরানো দুঃখগুলো যেন ছুঁই ছুঁই করে জেগে উঠলো আবার। তখন সে ফটিককে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললÑ কাঁদিসনে, তোর মত আমিও অনেক ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছি। এখন থেকে তুই আমার কাছে থাকবি। আমি তোকে খুউব আদর করবো। তোর আর কোন দুঃখ থাকবে না। সেদিন থেকেই জব্বর আলীর সাথে রয়েছে ফটিক।
ভোর হতেই ট্রেনের হুইসেল বাজল। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কর্ণফুলী মেল ট্রেন চট্টগ্রাম ইস্টিশনে এসেছে। কি দারুন ক্লান্তিতে যেন আর চলতে চায় না। ধীরে চলছে। অনেকটা খুড়খুড়ে বুড়োর মত। এক সময় ট্রেন থামল। রাত জাগা যাত্রীরা ধাক্কা ধাক্কি করে নামছে। যাত্রীরাও যেন ট্রেনের মত ক্লান্ত।
ফটিক হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠে ট্রেনের দিকে ছুটে যায়। ততক্ষণে অনেকেই যাত্রীদের কাছ থেকে ব্যাগ, টুইটকেস ইত্যাদি মাথায় নিয়ে নেয়।