ফটিকছড়িতে অযত্ন-অবহেলায় চা-বাগানের শিশু শ্রমিকরা

376

চারিদিকে সবুজের সমারোহ। ভ্যালিতে সারিবদ্ধ চা-গাছ। বাগানের বুকচিরে দাড়িয়ে আছে তিন শিশু শ্রমিক অঞ্জলী কুর্মী, শেলী নাথ ও কাজলী দাশ। পিঠে পাতার ঝুঁড়ি। কোমল হাতে পাতা তুলছিল এরা। বয়স বার-চৌদ্দ। বিদ্যালয়ে যায় কি-না জানতে চাইলে আবেগঝরা কন্ঠে ফটিকছড়ি উপজেলার পঞ্চবটি চা-বাগানের অঞ্জলী বলে, ‘পেটে ভাত নাই, গায়ে কাপড় নাই, বাবা-মার সাথে ভোর-সকালে উঠেই কাজে লেগে যাই। সারাদিন পাতা তুলি, মজুরি নিয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরি। বিদ্যালয়ে যাব কি করে? আজ কাজ না করলে কাল খাব কি?’ প্রশ্ন করলে শেলী বলে, ‘সারাদিন খাঁটুনি শেষে সত্তর টাকা মজুরি পাই। সে সাথে মায়ের মজুরি যোগকরে কোনভাবে সংসার চলে। বাপ ছাড়া এভাবেই কাটে দিন।’ দেখতে অনেকটা রোগাক্রান্ত কাজলী বলে, অসুখ-বিসুখ হইলে কাইজ-কাম করতে পারিনা। আবার অসুখ সারাতে চিকিৎসাও পাইনা। যে মেডিকেল আছে, তাও আমাগো থেকে অনেক দুর। এভাবে দিন যায়।’’ জানাযায়, উপজেলায় সতেরটি চা-বাগান রয়েছে। এখানকার উৎপাদিত চা দেশের এক দশমাংশ চাহিদা পূরণ করে। কিন্তু বাগানে শিশু এবং শিশু শ্রমিকদের যে দুরাবস্থা বিদ্যমান, এতে তারা পুষ্টিহীনতা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার অবনতির ফলে মৌলিক চাহিদা হতে বঞ্চিত। অন্যদিকে, অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারণে বহুলাংশে বেড়েছে বাল্যবিবাহ। উপজেলার বারমাসিয়া চা-বাগানের শ্রমিক দুলাল মলি­ক বলেন, ‘পরিবারে স্ত্রী-সন্তানসহ পাঁচজন। মাসে মজুরি মেলে চার হাজার টাকা। সংসার চালাতে সন্তানদের পাতা তোলার কাজে নিয়ে যাই। দৈন্যতার কারণে মৌলিক চাহিদার কোনটিই পূরণ করা সম্ভব হয়না।’ উদালিয়া চা-বাগানের কর্মচারী প্রদীপ দেওয়ান বলেন, এসব চা-বাগানে অশিক্ষার কারণে দিন দিন বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি বাগানের শ্রমিক নীলা বালা (১৬) এবং সীমা নাথ (১৭) সহ আরো কয়েকজনের বাল্য বিবাহ সম্পন্ন হয়। প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্র জানায়, বাগান সংশ্লিষ্ট এলাকায় ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ৪৩ জন শিক্ষকের তত্ববধানে ৩৩৬৯ জন শিক্ষার্থী সেখানে ভর্তি রয়েছে। ১৬৫ শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে বিদ্যালয়ে যায়না। পাশাপাশি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) প্রায় ২২টি বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করলেও এক তৃতীয়াংশ চা-শিশু শ্রমিক রয়েছে শিক্ষার বাইরে।
নেপচুন চা-বাগানের ব্যবস্থাপক কাজী ইরফানুল হক বলেন, প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক পরিবারের তিন শতাধিক শিশু রয়েছে। বাগান কর্তৃপক্ষের সহায়তায় এসব শিশুদের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত, বাল্যবিবাহ রোধসহ বিভিন্ন দুরাবস্থা দূরীকরণে কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট রয়েছে। শিশুশ্রম, স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ কিছু অভিযোগ সম্পর্কে ব্যক্তি মালিকানাধীন চা-বাগানের কয়েকজন ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মালিকরা যেভাবে চান, আমরা সেভাবেই চালাই।’ ব্রাক পরিচালিত কৈয়াছড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নুর হোসেন বলেন, বাগানের অভ্যন্তরে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিতি ও শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তার মতে, এখানকার শিশুরা সার্বিক দিক দিয়ে অবহেলিত।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুল কবির জানান, এসব এলাকার লোকজন তুলনামুলক কমশিক্ষিত ও অনগ্রসর। এখানে শিক্ষার ভিত রচনায় সরকার বদ্ধপরিকর। শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ রোধ এবং শিক্ষার সুষ্টু পরিবেশ সৃষ্টিতে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. ইলিয়াছ দৌধুরী বলেন, বাগানের অধিকাংশ শ্রমিক ও শিশুরা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে বসবাস করে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অজ্ঞতার কারণে নানারোগে আক্রান্ত হলেও পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা নিতে পারেনা তাঁরা। হালদাভ্যালী চা-বাগানের ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বাগানের অভ্যন্তরে শ্রমিক-শিশুদের জন্য ব্যক্তিগত তহবিলে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় জমি কিনে দিতে। যেহেতু বাগানটি ইজারাকৃত, সেহেতু বাগানের বাইরে বিদ্যালয় নির্মিত হলে এসব শিশুদের শিক্ষায় কোন সুফল আনবেনা। চা-সংসদের সাবেক চেয়ারম্যান ও পঞ্চবটি চা-বাগানের মালিক নাছির উদ্দিন বাহাদুর বলেন, চা-শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য সরকার ২০০০ সালে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকার বাজেট প্রণয়ন করেছিলেন। এটি নানা কারণে আলোর মুখ দেখছেনা। এটি হলে শিক্ষায় অগ্রগতি আসবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সায়েদুল আরেফিন বলেন, শ্রমিক-শিশুদের শিক্ষার দায়িত্ব হচ্ছে চা-বাগান মালিকদের। তারা নামমাত্র বিদ্যালয় চালু করে এক-দুইজন শিক্ষক দিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যায়।