পড়ন্তবেলায়

102

নিতাইপুর গ্রামের তিন সন্তানের বাবা কলিম শহরে একটি সরকারি অফিসে দপ্তরী পদে চাকরি করে। সে দিন আনে দিন খায়। যা বেতন পায় তা দিয়ে কোনরকমে সংসারটা চালিয়ে দেয়। নতুন জামাকাপড় কেনার তার সামর্থ নেই। পুরাতন জামাকাপড় পরেই তাকে অফিস যেতে হয়। বাড়িতে যে লুঙ্গি পরে তাও বেশ পুরাতন। বেশ কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। দুই এক টাকা বাঁচানোর জন্য বাজারে বিক্রেতার সঙ্গে কষাকষি করে জিনিসপত্র কেনে। নিরামিষ খেয়েই তাদের দিনগুলো চলে যায়। অফিসে দুপুরবেলায় চা-বিস্কুট খেয়ে কাটিয়ে দেয়। আর্থিক সমস্যার কারণে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গেও ঠিকমতো যোগাযোগ করতে পারে না। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেলেও যেতে পারে না। গ্রামের স্কুলে তার ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে। অপরদিকে গ্রামের অন্যপাশে কলিমের বন্ধুজন অহিদদের বাড়ি। সে দুই ছেলের বাবা। শহরে ছোটোখাটো ব্যবসা করে। আয় রোজগার বেশ ভালো। অভাব কাকে বলে এখনও টের পায়নি। তাই সে সবসময় টাকা-পয়সার দেমাগ দেখায়। কলিমের মিতব্যয়িতা তার মোটেও পছন্দ হয় না। সুযোগ পেলেই দুটো কথা শুনিয়ে দেয়।
ক’দিন আগে কলিম হাট থেকে অল্পকিছু বাজার করে বাসায় ফিরছিল। এমনসময় পথিমধ্যে তার সঙ্গে অহিদের দেখা। কলিমকে উদ্দেশ্য করে অহিদ বলে, “আরে কলিম এভাবে শাকপাতা খেয়ে আর কতদিন চালাবা? ভালোমন্দ কিছু খাও। জীবন তো শেষ হয়ে যাচ্ছে।” “কী করব ভাই! ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করছে। তাদের লেখাপড়ারই খরচ ঠিকমতো দিতে পারি না। ভালোমন্দ আর খাব কীভাবে?” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কলিম উত্তর দেয়। “ছেলেমেয়েদের পিছনে খরচ করে শুধু শুধু টাকাগুলো মাটি করছ। পড়ালেখা করে কী হবে শুনি? তোমার ছেলেমেয়েরা তো আর চাকরি পাবে না। চাকরি পেতে হলে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হবে। সেই সামর্থ কি তোমার আছে? তাই বলছিলাম- মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দাও। আর ছেলে দুটোকে কাজে লাগিয়ে দাও। দেখবে সব সমস্যা সমাধান হয়েগেছে।” প্রতিউত্তরে কলিম বলে, “না ভাই। যতদিন পারি ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা শেখাই। না পারলে তখন না হয় ভেবে দেখব কী করা যাবে।” যদিও অহিদের সঙ্গে কলিমের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তথাপিও সুযোগ পেলেই অহিদ কলিমের জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক যেমন-খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, চলাফেরা ইত্যাদি নিয়ে অপমানসূচক কথা বলে। অন্যের ভালো সে মোটেও সহ্য করতে পারে না। তার মনটা হিংসায় পরিপূর্ণ।
অন্য একদিন কথাপ্রসঙ্গে অহিদ বলে, “শোন কলিম, আমার দুই ছেলেকে ব্যবসায় লাগিয়ে দিলাম। লেখাপড়া শিখিয়ে আর কী হবে বলো? এই সমাজে যার টাকা আছে তার সম্মান আছে। টাকাই আসল, বুঝলে? অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমি বাড়ি বানানোর কাজে হাত দেব। ভাবছি- বাড়ি বানানো শেষ হলে সুন্দর সুন্দর ফার্ণিচারে ঘরগুলো সাজিয়ে রাখব। আর আমার শোবার ঘরে একটা সুন্দর একটা পালং রাখব। আরাম আয়েশ করে ঘুমাব। তুমি তো এসব করতে পারবে না। টিনশেডেই তোমার জীবনটা কেটে যাবে। মাঝেমাঝে আমার বাড়িতে এসো। দু’জনে এক পালঙে ঘুমাব। কী বলো?” “না ভাই। আমার পালঙে শোয়ার সাধ নেই। চৌকিতেই আমার ভালো ঘুম হয়। ছেলেমেয়েরা মানুষ হলেই আমি খুশি। ওসব কিছু চাই না।”
এভাবে দেখতে দেখতে বেশ কয়েকবছর পেরিয়ে যায়। কলিম সাহেবের ছেলেমেয়েরা গ্রামের স্কুল থেকে পাশ করে শহরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়। কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। বড় ছেলের পড়া শেষ হওয়ার পরপর বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করে ক্যাডার অফিসার হয়ে যায়। তার মেয়েটা মেডিকেলে চান্স ঢাকাতে পড়ে। তার পড়া শেষের দিকে। ছোট ছেলে শহরে থেকেই পড়াশুনা করছে। অল্পকয়েক বছরের মধ্যে কলিম সাহেবে সব ছেলেমেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যায়। প্রত্যেকে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পেয়ে যায়। তারা সম্ভান্তঘরে বিয়ে করে সংসার শুরু করে। নিতাইপুর গ্রামের লোকজনরা এখন কলিমকে এক নামে চেনে। গ্রামবাসীরা তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে গর্ব করে। ওদিকে অহিদ সাহেবের দুই ছেলে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে থাকে। অল্পবয়সে তারা বিয়েও করে ফেলে। তারা এখন ছেলেমেয়ের বাবা। গ্রামে অহিদ সাহেব একটা পাকা বাড়ি নির্মাণ করছে। বাড়ি নির্মাণ প্রায় শেষের দিকে।
কর্মব্যস্ততার কারণে অহিদের সঙ্গে কলিমের দেখা-সাক্ষাৎ কম হয়। কিছুদিন পর অহিদ সাহেব হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না। ভালো চিকিৎসার জন্য ঢাকা যায়। মাসখানিক চিকিৎসা নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে। একদিন কলিম অহিদের সঙ্গে দেখা করার জন্য তার বাড়িতে যায়। কলিমকে দেখে অহিদের দু’নয়ন অশ্রু-সজল হয়ে ওঠে। দু’জন সুখ-দুঃখের অনেক গল্প করে। কলিমকে ধরে অহিদ বলতে থাকে, “তুমি অনেক বুদ্ধিমান। সার্থক পিতা। ছেলেমেয়েকে কী সুন্দরভাবে মানুষ করলে। টাকার অহমিকায় আমি অন্ধছিলাম। এই যে দেখ। আমার সাধের বাড়ি। সাধের পালং। আর ডাক্তার সাহেব আমাকে পরীক্ষা-নীরিক্ষা বলেছে- সুস্থ থাকতে হলে আমাকে নাকি শক্ত বিছানায় ঘুমাতে হবে। বালিশও মাথায় দিতে পারব না। পরিমাণ মতো খাবার খেতে হবে। নিয়মিত হাঁটতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে নাকি বড় ধরণের বিপদে পড়তে হবে। রিকশা ছাড়া কোনদিন চলাফেরা করতাম না। হায়রে পোড়া কপাল! এখন আমাকে প্রতিদিন দুই এক ঘন্টা করে হাঁটতে হবে। জানো কলিম, ধনসম্পদ আমার কাছে এখন তুচ্ছ মনে হয়। সময় থাকতে আমি শরীরের প্রতি যতœ নিইনি। আমার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া না শেখার কারণে ঠিকমতো ব্যবসা-বাণিজ্যও করতে পারছে না। প্রায় শুনি লস হয়। ক’দিন পরে হয়তো শুনতে হবে ব্যবসায়ে লালবাতি জ্বলে গেছে। তোমাকে সবসময় বোকা ভাবতাম। সুযোগ পেলেই লজ্বা দিয়ে কথা বলতাম। তোমার সঙ্গে কত কটু কথা বলেছি। কিছু মনে কোরো না, ভাই। ক্ষমা করে দিও।” “ছিছি! কী বলছ তুমি? আরে আমি ওসব কি আর মনে রেখেছি?” কলিম অহিদকে সান্ত¡না দিয়ে উত্তর দেয়।
অহিদ সাহেব ছিল অমিতব্যয়ি। যখন হাতে টাকা ছিল তখন খরচ করার সময় দু’হাত ভরে খরচ করেছে। যখন যা মন চেয়েছে তাই করেছে। ইচ্ছেমতো ভোগ করেছে। সে ভাবত- এভাবেই হয় তো সারাটি জীবন চলে যাবে। আর এখন, ভালো চিকিৎসার করার মতো টাকাও হাতে নেই। পড়ন্তবেলায় এসে অহিদ সাহেব অতীত স্মৃতি রোমন্থ করে হিসাব নিকাশ করে দেখছে জীবনের ভুলগুলো কোথায় হয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করে- ঘটে যাওয়া ভুলগুলো কি আর শুধরে নেওয়া যাবে? কপোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তবুও মনের মধ্যে উদিত প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর খুঁজে পায় না।