প্রয়োজন উৎপাদনমুখী মানবিক শিক্ষা

94

একটি দেশ, একটি জাতির অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হলো শিক্ষা। এই বিবেচনায় বলা হয়, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’। একজন মানুষ যেমনি মেরুদন্ড সোজা হয়ে স্থির দাঁড়াতে পারেন, ঠিক তেমনি একটি জাতির ভিত্তিমূল, উন্নয়ন, অগ্রগতি, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া নির্ভর করে শিক্ষার উপর। যে জাতি যত বেশী শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশী উন্নত, সভ্য, অগ্রসর। শিক্ষা অর্জন মানুষের জন্মগত এবং মৌলিক অধিকার। আমাদের সংবিধানে মানুষের মৌলিক যে, পাচঁটি অধিকারের কথা বলা আছে তাতেও শিক্ষাকে স্থান দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সার্বজনীন, অপরিহার্য, ব্যাপক ও বিস্তৃত। একজন মানুষকে প্রকৃত মানবিক গুণাবলি, সামাজিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষা সৃজনশীল অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মানুষের মন-মানসিকতার উৎকর্ষ সাধন হয়, মানুষ নিজেকে সমাজে বিকসিত, উদারমনা, আলোকিত করে। একই সাথে তাঁর আলোয় পরিবার, সমাজ, দেশ আলোকিত হয়। একটি কুপিবাতি যেমন তার পার্শ্ববর্তী স্থানকে আলোকিত করে, তেমনি তাকেও অন্যরা দেখতে সাহায্য করে। প্রতিটি মানুষকে আলোকিত করে।
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সম্পদের সুষম ব্যবহারের জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। কিন্তু বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা সেই বিবেচনায় কতটুকু ভূমিকা রাখছে বা রাখতে পারছে তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন । বিজ্ঞানী নিউটন বলেছিলেন, তিনি সারাজীবন জ্ঞান-সমুদ্রের উপকূলে নুড়িপাথর কুড়িয়েছেন। সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা যদি করতেই হয়, তবে সেই সমুদ্রটি হবে অজ্ঞানতার, যার উপকূলে জ্ঞানের দু’কয়েকটি নুড়িপাথর কুড়ানো অসম্ভব নাও হতে পারে।
শিক্ষার্থীকে প্রচন্ড কৌতুহলী হিসেবে গড়ে তোলার পরামর্শ তিনি দিয়েছেন। সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে জ্ঞান বিচার করার অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে শিক্ষা সাহায্য করে। যে শিক্ষার বদৌলতে মানুষ নিজের পরিবারের সমাজ ও দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সমাজের সূচনা করবে সে শিক্ষাই প্রকৃত আদর্শের এবং কাক্সিক্ষত।
বর্তমানে আমাদের দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষার হার বাড়ছে, কিন্তু সেবাধর্মী, মানবিক এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের তাল মিলেয়ে চলার মতো উপযোগী হচ্ছেনা । এদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রভৃতি কারণে শিক্ষাব্যবস্থা প্রত্যাশিত মান অর্জন করতে পারেনি। আমাদের এই ভূখন্ড অন্যান্য উন্নত দেশের আয়তনের তুলনায় খুবই ছোট। কিন্তু জনসংখ্যায় অনেক বেশী।
জনসংখ্যা একটি দেশের জন্য শুধু সমস্যা নয়, সম্পদ। দেশে শিক্ষিত জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়লেও সে তুলনায় বাড়ছে না দক্ষ জনশক্তি। দেশের এই বিপুল জনসংখ্যা সামাল দিতে বিভিন্ন খাতের প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, ডিপ্লোমা শিক্ষা খাতে তেমন কোনো উদ্যোগ কিংবা যথাযথ সুযোগ-সুবিধা নেই। এ কারণে দেশের বিভিন্ন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানে অন্তত দুই লাখ বিদেশি কাজ করছেন। শুধু টেক্সটাইলেই বিদেশি কর্মজীবীর সংখ্যা এখন ১৯ হাজারেরও বেশি। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে ডিপ্লোমা শিক্ষায় শিক্ষিতের হার অনেককম, ৫ থেকে ৮ শতাংশ মাত্র। ডিপ্লোমা শিক্ষাহীনতার কারণে অগ্রসরমান কয়েকটি খাতে দক্ষতাসম্পন্ন বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তৈরি পোশাক শিল্প, শিপ বিল্ডিং, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ফুড অ্যান্ড বেভারেজসহ বিভিন্ন খাতের শিল্পোদ্যাক্তাদের বিদেশি চাকরিজীবীদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সবক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের দ্বার অবরিত করা যাবে এমনটি ভাবা না গেলেও ডিপ্লোমা শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষতাসম্পন্নরা যাতে নিজ নিজ ক্ষেত্রে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ লাভ করতে পারে, এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। কর্মক্ষম কিংবা সৃজনশীলরা যাতে অলস বসে না থাকেন তা নিশ্চিত করতে হবে।
অর্জিত শিক্ষা দিয়ে পরবর্তীতে কর্মজীবনে যদি সঠিকভাবে দেশ, সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখতে ব্যর্থ হয় তা হলে সেই শিক্ষা ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে ভাবতে হবে। একই কথা প্রযোজ্য বিদ্যমান ডিপ্লোমা শিক্ষা নিয়েও। প্রয়োজনভিত্তিক, পরিমান, আর চাহিদাভিত্তিক কোর্স কারিকুলাম তৈরি এখনো করা হয়নি।
তরুণরা সর্বোচ্চ সার্টিফিকেট কিনে কর্মের জন্য দ্বারো দ্বারে ঘুরে, আর বিদেশি পেশাজীবী শ্রমিক প্রতিনিয়ত নিয়োগ দিতে হচ্ছে। এ অবস্থা অব্যহত থাকলে হয়তো এই তরুণ প্রজন্মের মেরুদন্ড ভেঙে যাবে না, কিন্তু মচকাবে। এতে বাস্তবিক অর্থে জাতিও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। জাতিকে এই বিপদের হাত থেকে, বিশেষ করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি নির্ভর ডিপ্লোমা শিক্ষার সুযোগ দিয়ে তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলতে হবে। তা হলে সম্ভাবনাময় এসব তরুণ প্রজন্মই একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ উপহার দিতে পারবে। এজন্য সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে হাতে কলমে শিক্ষাদান, পাশাপাশি মানবিক গুণাবলী অর্জিত হয় এমন শিক্ষাদানের প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে।
প্রয়োজন যাচাই না করে নানা রকম ও ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের ‘গিনিপিগ’ বানানো হচ্ছে। তাতে হতাশ এসব শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকবৃন্দ। এ নিয়ে প্রায়শই তাদের ক্ষোভ-অসন্তোষ, হতাশার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা, দেশের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনবল প্রশিক্ষণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে তারা তাদের স্বার্থসিদ্ধির অনুকুল করে শিক্ষাব্যবস্থার বিন্যাস করেছিলো। তারা উৎপাদনমুখী মানবিক গুণাবলী অর্জনের শিক্ষাকে নিরোৎসাহীত করেছিল। অবশ্য পরিবর্তিত যুগের সাথে, প্রযুক্তির সাথে, সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ঢেলে সাজানো দরকার চলমান শিক্ষা ব্যবস্থা। সে খাতে জ্ঞানার্জনে মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষের সাথে কর্মের হাতছানি দেওয়া শিক্ষা ব্যবস্থা সৃষ্টি করা দরকার। এটা বলা সংগত হবে যে, এখনো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ঔপনিবেশিক চিন্তা চেতনাকে লালন করছি।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের এত বছরে শিক্ষাব্যবস্থা পূণর্বিন্যাসের লক্ষ্যে বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন গঠন হলেও ঔপনিবেশিক আমলে গড়া মানসিকতা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারি নাই।
বাংলাদেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার হতাশা দূরে সভা, সেমিনার, আলোচনা, পরামর্শ অনেক গ্রহণ করা হয়েছে, বাস্তবায়ন হয়েছে কমই। যে শিক্ষায় মনুষ্যত্ব বোধ ও বিবেক জাগ্রত করে শিক্ষার্থীকে যথার্থ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে কর্মপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করে, সে শিক্ষা থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে।
কলেজকেন্দ্রিক শিক্ষাকে শুধু বর্জন নয়, প্রতিহত করতে হবে। স্থগিত করতে হবে নতুন কলেজ অনুমোদন। জিপিএ ০৪ এর কম পাওয়া শিক্ষার্থীদের কলেজ ভর্তি নিষিদ্ধ করতে হবে। ঐ সমস্ত শিক্ষার্থীদের বাস্তবসম্মত দেশ উন্নয়নের কর্মের নিশ্চিয়তা দেওয়া ডিপ্লোমাতে নিক্ষিপ্ত করতে হবে। একাজ যত দ্রুত করা সম্ভব হবে দেশ ও জাতির মঙ্গল তত দ্রুত হবে।