প্রোজ্জ্বল চেতনার স্মারক

79

প্রকৃতি যখন নোতুন উচ্ছ্বাসে কৃষ্ণচুড়া আর রক্তপলাশের লাল রঙে ও বর্ণিল আয়োজনে বসন্ত বরণে ব্যস্ত, ঠিক তখনই মাতৃভূমি রঞ্জিত হয়েছিল মাতৃভাষাপ্রেমী ছাত্র, যুবা, শিক্ষকের রক্তে। পাখির কলতান স্তব্ধ হয়েছিল, ইতিহাস থমকে দাঁড়িয়েছিল ১৯৫২ র ২১শে ফেব্রুয়ারি। মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য ঢাকা শহরেই হয়েছিল সেই ভাষার লড়াই ফেব্রুয়ারির আগুন ঝরা রক্ত পিচ্ছিল রাজপথে। শোণিতে লেখা হয়েছিল বর্ণমালার এক অনন্য ইস্তেহার। সঙ্গত কারণে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির অপরিমেয় আত্মোৎসর্গে আত্মপরিচয় আবিষ্কারের প্রত্যয়দৃপ্ত একটি দিন। যে রক্তঝরা দিনটি ভাষা আন্দোলনের প্রোজ্জ্বল চেতনার স্মারক। তাই একুশ মানে মাথা নত না করা, একুশ মানে ¯পর্ধিত উচ্চারণে মায়ের ভাষায় কথা বলা, পাকিস্তানিদের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হওয়া, স্বদেশ এবং মায়ের ভাষাকে স্বীকৃতির লক্ষ্যে নিজেকে উৎসর্গ করা। বায়ান্নর একুশে মানে সমস্ত সত্তা দিয়ে, অনুভ‚তি দিয়ে মায়ের মুখের মধুর ভাষায় অবগাহন করা।
দীর্ঘদিনের আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে বাঙালিকে মুক্তি দিয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জাতীয়তাবোধের সার্থক স্বাক্ষর। এই একুশে ফেব্রুয়ারি মধ্যেই নিহিত ছিল বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের বীজমন্ত্র, যা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। আমাদের প্রাণের দীপ্ত জাগরণে এ দিন এখনো নতুন বোধ সঞ্চার করে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করেছিল সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ অমর ভাষা শহীদ। আজন্মলালিত প্রাণের ভাষার সম্মানরক্ষার তাগিদেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বরকতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন অধ্যাপক আনোয়ার পাশা। ভাষা আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন বিশিষ্ট অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সন্তোষ ভট্টাচার্য প্রমুখ। ভাষা শহীদদের আত্মবলিদানের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে সারা দেশের মানুষ দ্রোহ আর প্রতিরোধে জেগে উঠেছিলেন। ভাষা শহীদদের দেশপ্রেম ও ভাষাপ্রেমের ইতিহাস আজও আমাদের আত্মচেতনাকে জাগ্রত করে ভাষা,সংস্কৃতি,কৃষ্টির উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য রক্ষায় সংকল্পবদ্ধ করে তোলে । একুশের যে চেতনা এ দেশের মানুষের আত্মপরিচয় আবিষ্কারের পথ দেখিয়েছে, সে চেতনায় সমগ্র বাঙালিসত্তা উপলব্ধি করে আমরা বাঙালি, বাংলা আমার মাতৃভাষা, আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলি । বাংলা ও বাঙালির আবহমান সংগ্রামে একুশের মৃন্ময় চেতনা বহমান থাকবে স্রোতস্বিনী নদীর মতো। তাই বাঙালির আবেগে-উচ্ছ্বাসে-ভাবনায় অমর একুশে অনিবার্য ভাবে উচ্চকিত।
পকিস্তানি শাসকরা চেয়েছিল একমাত্র উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার বদলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলেছিল। এ হীন ষড়যন্ত্র বুঝতে সময় লাগেনি আমাদের পূর্ব প্রজন্মের। তাঁরা সে দিন হয়ে উঠেছিলেন প্রতিটি বর্ণমালার যোগ্য সেনানী এবং মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাঙালি সেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। পকিস্তানি শাসকদের অন্যায় সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি বরং কঠোর অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদমুখর হয়ে সংগ্রাম-আন্দোলন গড়ে তুলেছে, পুলিশের রাইফেল- লাঠির মার খেয়েছে, বুটের আঘাত সহ্য করেছে, টিয়ার গ্যাসের যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়েছে এবং জেল-জুলুমের শিকার হয়েছে। বাঙালির জাতিসত্তাকে মুছে দিতে চেয়েছে। বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধংস করে তাদের চিরতরে পদানত রাখতে চেয়েছে। কিন্তু বাংলার বীর সন্তানেরা সেটা করতে দেয়নি। বুকের রক্তে মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন।
একুশ বাঙালিকে দিয়েছে শেকড়ের সন্ধান আর অমেয় সাহস । যে সাহসে বাহান্নোকে ¯পর্শ করে ¯পর্ধিত ভাষার সৌকর্যে রচিত হয়েছিল বাঙালি জাতিসত্তার অহংকারের ইতিহাস অধ্যায় একাত্তর। একুশের মধ্যে প্রোথিত হয়েছিল স্বপ্ন চেতনার অঙ্কুরিত বীজ। ১৯৫২-তে বাঙালির সম্মিলিত প্রতিরোধ ও আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে যে বীজটি রোপিত হয়েছিল বাংলাদেশের মাটিতে তারই ক্রমপরিণতিতে আমাদের স্বাধিকারের সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ। বায়ান্নর ২১ ফেব্রæয়ারির আত্মত্যাগ ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে এক নতুন প্রত্যয় ও প্রতীতী দান করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বে ৩০ লক্ষ শহীদ আর ২ লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগে ১৯৭১ এ অর্জিত হয়েছিল আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। কবির ভাষায়- একুশ আমার রক্তে বাজায় অস্থিরতার সুর/ বিপ্লব জানি মহামহীরুহ একুশ তো অংকুর। আমরা পল্লবিত একুশের অঙ্কুরে। আমাদের যা কিছু অর্জন, যা কিছু গৌরব তা একুশের আদর্শে অর্জিত। একুশ কেবল বাংলা ভাষার লড়াই ছিল না, একুশ ছিল বাঙালির সার্বিক মুক্তির সংগ্রাম।
বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির অস্তিত্ব রক্ষার সেই লড়াইয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল শিক্ষা, সমাজ ও অর্থনীতির লড়াইও। একুশের মধ্যে উপ্ত ছিল বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম, এদেশের মানুষের সব রকম শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আকাক্সক্ষা। যখনই বাঙালি নির্মম আক্রমণের শিকার হয়েছে, একুশে হয়ে উঠেছে তখন প্রতিরোধের অগ্নিবীণা। কারণ প্রতিপক্ষ জানে, বাঙালির শেকড়ের নাম তার ভাষা আর ভাষার লড়াই, সেখান থেকেই বাঙালি দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যায় ভাষা, সংস্কৃতির অজেয় শক্তিতে। পাকিস্তানিরা মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে গুঁড়িয়ে দিয়েছে শহিদ মিনার। কিন্তু শহিদ মিনার শুধু আমাদের কাছে ইঁট সিমেন্টের অবয়ব নয়। আমাদের প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে আছে এক একটি শহিদ মিনার। সেই মিনার কখনও ভেঙে ফেলা যায় না। তার বিনাশ নেই। অমর একুশ চিরকাল থাকবে বাঙালির হৃদয়ে। একুশের মধ্যে যে জাতীয় চেতনা ও আবেগ আছে, তা প্রচন্ড শক্তি হিসেবে এখনো রয়েছে । আমাদের অস্থিমজ্জায়, ভাষায় ও সংস্কৃতিতে এবং ইতিহাসে যে চেতনা মিশে আছে, তাকে ধ্বংস করা অত সহজ নয়। একুশের মিছিল, একুশের স্লোগান, একুশের গান সেই অপশক্তিকে বারবার রুখছে, ভবিষ্যতে ও রুখবে। আমাদের সামগ্রিক চেতনায় ভাষা আন্দোলনের প্রভাব কেবল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই বিস্তৃত হয়নি। একুশের চেতনা আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে ও এক গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছিল। কবিতার কাব্যিক ব্যঞ্জনায়, গল্পের শাব্দিক ভাঁজে, গবেষণার আগ্রহী বিষয় হিসেবে, নাটকের সংলাপে বায়ান্নর একুশ এখনও প্রাণময়, চেতনাদীপ্ত। সেই দিনই রচিত হয়েছিল মাহবুব-উল-আলম চৌধূরীর দীর্ঘ কবিতা কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি- এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/ রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচ‚ড়ার নিচে/যেখানে আগুনের ফুলকীর মতো/এখানে-ওখানে জ্বলছে রক্তের আল্পনা, /সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।…/ যারা আমার অসংখ্য ভাই বোনকে হত্যা করেছে, /যারা আমার হাজার বছরের ঐতিহ্যময় ভাষায় অভ্যস্ত/মাতৃ সম্বোধনকে কেড়ে নিতে গিয়ে/আমার এইসব ভাই বোনদের হত্যা করেছে/আমি তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি…। -যারা গুলি ভরতি রাইফেল নিয়ে এসেছিল ওখানে/যারা এসেছিল নির্দয়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে/আমরা তাদের কাছে/ভাষার জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ/আমরা এসেছি খুনী জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে। কবি এই কবিতার প্রতিটি লাইনে ঘটিয়েছেন প্রতিবাদের বিস্ফোরণ। তিনি অনবদ্য কাব্যিক প্রতিবাদে, রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়া বাঙালির রক্তের কণায় কণায় প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন । একটিমাত্র কবিতার জন্যই মাহবুব-উল আলম চৌধুরী বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন।
কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন – আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচ‚ড়া থরে থরে শহরের পথে/কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো বা/একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয় – ফুল নয়, /ওরা শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।/একুশের কৃষ্ণচ‚ড়া আমাদের চেতনারই রঙ। সে-চেতনা ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের দৃপ্ত আবেগময়তায় ভাস্বর – আবার সালাম নামে রাজপথে শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ/বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।/সালামের বুকে আজ উন্মথিত মেঘনা/সালামের চোখ আজ আলোকিত ঢাকা/সালামের মুখ আজ তরুণ, শ্যামল পূর্ব বাংলা। কবি শামসুর রাহমানের ষাট-সত্তর দশকের সামগ্রিক কাব্যেই ছিল একুশের চেতনার প্রকাশ। কবি শামসুর রাহমান ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতার শুরুতেই আবেগ উত্থিত শব্দমালায় লিখেছেন – নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।/মমতা নামের পূত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড় ঘিরে রয় সর্বদাই। আটচল্লিশ থেকে ঊনসত্তর বাংলা ভাষা ও বর্ণমালার বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র, অনেক চক্রান্ত হয়েছে । কবি বেদনার্ত হয়ে লিখেছিলেন- তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার? /উনিশ শো বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পু®পাঞ্জলি বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহিয়সী।/সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে/কতো নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।/এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি।/এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউরের পৌষ মাস! /তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো/ বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা! এ কবিতায় বাংলা বর্ণমালা ও আপন অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য স¤পর্কের কথা বলে উনিশ’শ বায়ান্নর দারুণ রক্তিম পু®পাঞ্জলিকে স্মরণ করেন। বর্ণমালার দুরবস্থা দেখে ব্যথিত তিনি। আবু বকর সিদ্দিক লিখেছেন ‘তোমাতে উঠেছে ফলে/ রক্তমুখী একুশের দীপ্ত বীরগাথা/ তোমাতে উঠেছে জ্বলে/শতদল যৌবনের/উষ্ণাভ ই¯পাতপাতে’ (বাংলা ভাষার অর্ঘ্যে)।
একুশের প্রোজ্জ্বল ভাবনায় আরো অনেক তরুন তুর্কির মতো ভাষাশৈলীর অনন্য আবেগে ভাষাসৈনিক কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ভাষা শহীদদের নিয়ে লিখেছেন তাঁর প্রথম ও বিখ্যাত কবিতা ‘কোন এক মাকে’। আবেগের ফলগুধারায় তিনি একজন মায়ের ছেলের জন্য অপেক্ষার হৃদয়মথিত কথামালার চিত্রকল্প কবিতায় সাজিয়েছেন । যখন “কুমড়ো ফুলে ফুলে/নুয়ে পড়েছে লতাটা,/সজনে ডাঁটায়/ভরে গেছে গাছটা; যখন ডালের বড়ি শুকিয়ে সন্তানের জন্যে অপেক্ষা করছেন মা; ছেলে তখন মাতৃভাষাকে রক্ষা করবার আন্দোলনে আত্মনিবেদিত। চিঠিতে লিখেছে : ‘মাগো, ওরা বলে,/সবার মুখের কথা কেড়ে নেবে/তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না।/বলো, মা, তাই কি হয়?/তাই তো আমার ফিরতে দেরি হচ্ছে।/তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে তবেই না বাড়ি ফিরবো।/লক্ষী মা, রাগ ক’রো না,/মাত্রতো আর কটা দিন’।” কিন্তু ছেলে তার বাড়ি ফেরে না। ছেলের বদলে মায়ের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছেলের ছিন্ন-ভিন্ন লাশ! কবির ভাষায়- ঝাপসা চোখে মা তাকায়/উঠোনে উঠোনে/যেখানে খোকার শব/শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে। মায়ের আদরের সেই খোকাটির আর বাড়ি ফেরা হয় না। অথচ ঘরে প্রতীক্ষারত মা ছেলের জন্য সখের উড়কি ধানের মুড়কি ভাজে, নারকেলের চিড়ে কোটে।
একসময় কুমড়ো ফুল শুকিয়ে যায়, ঝরে পড়ে কিন্তু খোকা ছুটি পায় না। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ এই কবিতায় অত্যন্ত কোমল হাতে, ঝাপসা চোখে ভাষা আন্দোলনে শহীদ ছেলের জন্য মায়ের প্রতীক্ষা যে কত তীব্র, কত কষ্টের তা বিবৃত করেছেন। মাগো ওরা বলে কবিতাটিকে নির্দ্বিধায় ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত অন্যতম সেরা কবিতা হিসেবে বলা যায়। একুশের প্রেক্ষাপট নিয়ে রচিত কবিতায় কখনও ফুটে উঠেছে সন্তানহারা মায়ের নির্মম প্রতীক্ষা, কখনও কবিতায় স্থান পেয়েছে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার অক্ষরে প্রতিবাদ। একুশের কবিতাগুলো দেশের ঐতিহ্যগত চেতনারই ফসল। এসব কবিতার প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ পৃথিবীবাসীকে জানিয়ে দেয় বাঙালিরা তাদের মায়ের ভাষাকে প্রাণের চেয়ে ও বেশি ভালবাসে। কবিতার মতো বিপুল না হলেও বাংলাদেশের উপন্যাসেও ভাষা-আন্দোলনের বহুমাত্রিক প্রতিফলন ঘটেছে। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে একুশের সৃজনশীল কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিকদের লেখার ভেতর একুশের চেতনা কাজ করেছে প্রগাঢ়ভাবে। পরবর্তীকালে এ চেতনা সমস্ত বাঙালির জীবনকে করেছে উচ্চকিত, আন্দোলিত ।
‘একুশে ফেব্রæয়ারী’ সংকলনের অবিসংবাদিত স¤পাদক হাসান হাফিজুর রহমান ‘অমর একুশে’ কবিতায় প্রকাশ করেছেন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারদের আত্মদানের মর্মন্তুদ কাহিনী বিন্যাসে ভরা বিষন্ন আবেগ। হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর কবিতার প্রতিটা লাইনে অনুভ‚তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন অদম্য প্রানপ্রবাহে-কি আশ্চর্য প্রাণ ছড়িয়েছে – একটি দিন আগেও বুঝতে পারি নি, /কি আশ্চর্য দীপ্তিতে তোমার কোটি সন্তানের প্রবাহে-প্রবাহে/সংক্রমিত হয়েছে -/একটি দিন আগেও তো বুঝতে পারি নি দেশ আমার।/শহিদের আত্মাহুতি বাঙালির জীবনে সঞ্চারিত করেছে এক অদম্য শক্তি /তাদের একজন আজ নেই; /না, তারা পঞ্চাশজন আজ নেই।/আর আমরা সেই অমর শহীদদের জন্যে,/ তাঁদের প্রিয় মুখের ভাষা বাংলার জন্যে একচাপ পাথরের মতো/এক হয়ে গেছি/হিমালয়ের মতো অভেদ্য বিশাল হয়ে গেছি। আবদুল গাফফার চৌধুরী ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন আমার ভাইয়ের রক্তের রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি কবিতাটি। যা প্রথমে আবদুল লতিফ, পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের সুরে গান হয়ে ওঠে। প্রতিটি একুশে ফেব্রæয়ারিতে এই গানটি অনুরণিত হয় বারবার । যে গানের কথা ও সুর আমাদের বিহ্বল করে এবং একুশের শহিদদের বাংলা ভাষাপ্রীতির কথা ও ত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
মাতৃভাষা, মাতৃভ‚মির অস্তিত্ব চেতনা বাঙালির সংগ্রামী ইতিহাসের প্রথম পাঠ । বাংলা ভাষা তথা বাংলা বর্ণমালা বাঙালির সত্তায় সগৌরবে বিরাজমান। প্রতি বছর কুড়ি ফেব্রুয়ারি মধ্য রাত থেকে শুরু হয় আমাদের পথ চলা শহিদ মিনারের পাদদেশে, যেখানে ঘুমিয়ে আছেন বীর শহিদ রফিক, জব্বার, বরকত, সালাম-সহ আরও অনেকে। এক অমোঘ এবং স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল পায়ে পায়ে শহিদ মিনারের দিকে ফালগুনের রোদ উপেক্ষা করে মানুষ হেঁটে চলে অবিরাম।
লাখ লাখ মানুষ সে দিনও মিছিল করে হেঁটে এসেছিলেন, জনসমুদ্রে লেগেছিল জোয়ার, সকলের গতিপথ একই দিকে। এখনো একের পর এক মানুষের ঢেউ এসে ভাসিয়ে দেয় রাজপথ, বসন্তের চড়া রোদ হার মানছে মানুষগুলোর হৃদয়ের উষ্ণতার কাছে। ভাষা শহিদ স্মারক সৌধে অগুনতি মানুষ শ্রদ্ধায় অবনত হচ্ছে উত্তরপুরুষের কাছে । জাতি-ধর্ম-বর্ণ এবং রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ভুলে মানুষ আজ ও এক সঙ্গে পায়ে পায়ে হেঁটে চলেছেন জাতিসত্তার আলোকস্তম্ভ শহিদ মিনারের দিকে।