প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অপরিণামদর্শিতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের অচল অবস্থা

147

১৭৮৯ সালের ৩০ এপ্রিল আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে জর্জ ওয়াশিংটন শপথগ্রহণ করেন। একটি সরকার গঠন করতে একটি রাষ্টের যাই প্রয়োজন তার কিছ্ইু তখন আমেরিকার ছিল না। মাত্র কয়েক ডজন কেরানি, তাও তাদের অনেক দিনের বেতন বকেয়া ছিল। সেনাবাহিনীতে মাত্র ৬৭২ জন অফিসার ছিল, কোন নৌবাহিনী ছিলনা। সে অবস্থা থেকে দুই শত বৎসরের বেশি সময় ধরে শত শত নেতার এবং কোটি কোটি আমেরিকানদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং সাধনার কারণে আজ সারা বিশ্বে এই মুুহ‚র্ত পর্যন্ত আমেরিকা বিশে^র প্রধান অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি হিসেবে বিরাজ করছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ঊষালগ্ন থেকে আমেরিকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেক ব্যাপারে দ্বিমত সৃষ্টি হলেও শেষ মুহ‚র্তে দেশের সার্বিক মঙ্গলের জন্য ঐক্যমত হতে কোনদিন দ্বিধা করেন নাই। বিশ্বে আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করার জন্য সব আমেরিকানদের ধ্যানধারণায় একটি ঐশ্বরিক ঐক্য যুগে যুগে দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথা ধরা যাক। আসলে আমেরিকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার বিশেষ প্রয়োজন ছিলনা। তারপরও আমেরিকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও প্রধান ভূমিকা নিতে দ্বিধা করে নাই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অংশগ্রহণের কথা ঘোষণা করে তদানীন্তন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উইলসন কংগ্রেসের অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছিলেন যা ছিল মানবজাতির প্রতি আমেরিকার চিরন্তন প্রতিশ্রুতি। সে ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘শান্তির চাইতে “অধিকার” অনেক মূল্যবান। আমাদের হৃদয়ের মণিকোটায় যে মূল্যবোধগুলি লালন করি সেগুলির জন্য আমরা যুদ্ধ করব। তাহলো গণতন্ত্র, যে সরকারের প্রতি তারা আনুগত্য দেখাবে, সে সরকারের কন্ঠস্বর তাদের কন্ঠস্বর হতে হবে। বিশ্বব্যাপী সমস্ত জাতির স্বাধীনতায় বিশ্বে মুক্তি আসবে। এরকম কাজে আমরা জীবন এবং ভাগ্য বলি দিতে পারব। আমেরিকানরা যখন দেখবে সে সুযোগ এসেছে তখন আমেরিকানরা অবশ্যই তাদের রক্ত এবং শক্তি দিয়ে, জীবন ও সুখ বিসর্জন দিয়ে তা অর্জন করবে। এর অন্যথা

Official portrait of President Donald J. Trump, Friday, October 6, 2017. (Official White House photo by Shealah Craighead)

আমেরিকানরা করতে পারে না।’ বর্তমান আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জয়লাভ করার পর ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তার নির্বাচনী স্লোগান ছিল ‘অসবৎরপধ ভরৎংঃ.’ সে স্লোগান বাস্তবায়িত করতে গিয়ে শুধু আমেরিকার রাজনীতি নয় বরং সারা বিশ্ব রাজনীতিতে হ য ব র ল অবস্থার সৃষ্টি করেছেন। প্রথমত: তিনি হলেন এক ধুরন্তর পুরোনো ব্যবসায়ী এবং রাজনীতির সাথে তাঁর খুব একটা সংশ্লিষ্টতা ছিলনা। তাঁর ব্যবসার বাইরে তিনি ‘রিয়েলিটি শো’ এর উপস্থাপক ছিলেন। তাঁর বক্তৃতা, বিবৃতি একটু মনযোগ সহকারে শুনলেই যে কোন রাজনীতি সচেতন মানুষ বুঝতে পারবেন, তাঁর রাজনীতির উপর ন্যূনতম জ্ঞানেরও অভাব রয়েছে। এমন কি আমেরিকার স্বাধীনতার স্থপতিরা কত ত্যাগ, তিতিক্ষা এমন কি গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত মোকাবিলা করে আমেরিকাকে এই পর্যায়ে এনেছেন তার ধারাবাহিক ইতিহাস সম্পর্কে ও তার স্পষ্ট জ্ঞান আছে বলে মনে হয় না। কারণ অনেক বক্তব্যে তিনি বলেছেন তাঁর মতো দেশ প্রেমিক প্রেসিডেন্ট এই পর্যন্ত নির্বাচিত হন নাই। আমেরিকার জন্য তাঁর এই বক্তব্য শুধু অশোভন নয়, আমেরিকার স্বাধীনতার স্থপতিদের জন্য রীতিমত অপমানজনক। অল্প কয়েকদিন আগে ট্রাম্প বরফাচ্ছাদিত হোয়াট হাউসের বাইরে দাঁড়িয়ে একটি বিস্ময়কর ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি কোনদিন রাশিয়ার এজেন্ট ছিলেন না। ও হবাবৎ ড়িৎশবফ ভড়ৎ জঁংংরধ রঃ রং ধ ফরংমৎধপব ঃযধঃ ুড়ঁ বাবহ ধংশ ঃযধঃ য়ঁবংঃরড়হ. ওঃ’ং ধষষ ধ নরম ভধঃ যড়ধী. অর্থাৎ আমি কোন দিন রাশিয়ার জন্য কাজ করিনি। এই প্রশ্নটা আমাকে করাটা অপমানজনক। ইহা একটি নির্বোধ তামশা। কয়েকদিন আগে ‘নিউইয়র্ক টাইম’ পত্রিকা রিপোর্ট করেছে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ডোনাল্ট ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহনের পরই রাশিয়ার হয়ে কাজ করেছে কিনা তার তদন্ত শুরু করেছে। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ নামের বিখ্যাত সংবাদপত্র রিপোর্ট করেছে যে ট্রাম্প পুতিনের সাথে বৈঠকে দীর্ঘ সময় নেওয়ার কারণ হলো পুতিনের সাথে তার দীর্ঘ আলোচনার অনেক কিছু লুকাতে হয়েছিল। অবশ্য এই বিষয়ে স্পেশাল প্রসিকিউটর ‘রবার্ট মূলার’ তদন্ত করে দেখছেন। তিনি ২০১৬ সালের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন।
বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মেক্সিকো সীমান্তে দেওয়াল দেওয়ার জন্য বাজেট বরাদ্দ দেওয়া নিয়ে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরকে নাড়িয়ে দেওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিশ্বে আমেরিকার গৌরব জনক পরিচিতি হলো এটি অভিবাসীদের দেশ। বিশ্বের আশ্রয়হীন মানুষের আশ্রয়স্থল হলো আমেরিকা। যুক্তরাষ্টের প্রথম প্রেসিডেন্ট থেকে ডোনাল্ট ট্রাম্প পর্যন্ত সবাই যে কোন এক জেনারেশনে অভিবাসী ছিলেন। কোন মানুষের দুনিয়ায় কোথাও আশ্রয় না হলেও আমেরিকার দ্বার ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। এখানেই নিহিত ছিল আমেরিকার ঐতিহ্য, বিশালত্ব এবং গৌরব। কিন্ত ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অভিবাসী সম্পর্কে বিভিন্ন অমানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে আমেরিকার গৌরবময় ইতিহাস ম্লান হতে বসেছে। তন্মধ্যে অভিবাসী ঠেকাতে মেক্সিকো সীমান্তে দেওয়াল দেওয়ার বিষয়টি ছিল ট্রাম্পের গত নির্বাচনের একটি প্রতিশ্রুতি। তিনি বর্তমান বাজেটে অভিবাসী ঠেকাতে মেক্সিকো সীমান্তে দেওয়াল দেওয়ার জন্য ৫৭০ কোটি ডলার বরাদ্দ চেয়েছেন। কিন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ডেমোক্রেটিক পার্টির বিরোধিতার ফলে সে বাজেট কিছুতেই অনুমোদিত হচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট ও কিছুতেই ইহা ছাড়া বাজেটের অনুমোদন দিবেন না। ফলে ৮কোটি সরকারি কর্মচারীর বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনুরূপ শার্ট ডাউনের ঘটনা আমেরিকার বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে অনেক বার ঘটেছে। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন, বারাক ওবামা, ডোনাল্ড রিগেন এবং সিনিয়র বুশের সময়ও এরুপ ঘটনা ঘটেছে। কিন্ত এই রকম দীর্ঘ সময় ধরে তাঁদের সময় শার্ট ডাউন হয় নাই। অতি অল্প সময়ে সমস্যার সমাধান হয়েছে এবং উভয় পক্ষই দায়িত¦বোধের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্ত এইবার প্রেসিডেন্টের বাড়াবাড়ির সীমা অতিক্রম করেছেন। ইতিমধ্যেই আমেরিকার প্রশাসন প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। ডেমোক্রেট দলের সদস্যরা দেওয়াল নির্মানের বরাদ্দ না দেওয়ার কথা পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ট্রাম্পও অনড় রয়েছেন। ইতিমধ্যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প জরুরি অবস্থা ঘোষণার হুমকি দিলেও তা থেকে সরে এসেছেন। কিন্ত নতি স্বীকার করবেননা বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন। এদিকে হোয়াট হাউসের ডাইনিং হলের কর্মচারীদের পর্যন্ত বেতন বন্ধ রয়েছে। হোয়াট হাউসের স্বাভাবিক অতিথি আপ্যায়ন পর্যন্ত বাবুর্চির অভাবে বন্ধ রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদ মিডিয়ায় খবর এসেছে। কারণ ডাইনিং হলের কর্মচারীদেরও বাজেট অনুমোদনের অভাবে বেতন ভাতা বন্ধ রয়েছে। মোটামোটি ট্রাম্প সাহেব আমেরিকার সরকারকে বিশ্বের কাছে হাস্যস্পদ করে ছেড়েছেন। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ট্রাম্পের এই কার্যক্রমকে একটি অরাজনৈতিক ব্যক্তির অশালীন আচরণ ছাড়া আর কোনভাবেই বিশ্লেষণ করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন। এই প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্টের বিখ্যাত মানবতাবাদী নেতা প্রয়াত মার্টিন লুথার কিং এর একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন উধৎশহবংং পধহহড়ঃ ৎবসড়াব ফধৎশহবংং, যধঃব পধহহড়ঃ ৎবসড়াব যধঃৎবফ, ড়হষু ষরমযঃ ধহফ ষড়াব পধহ ৎবসড়াব যধঃৎবফ ধহফ ফধৎশহবংং. অর্থাৎ অন্ধকার অন্ধকারাচ্ছন্নতা দূর করতে পারে না, হিংসা বিদ্বেয় দূর করতে পারে না। শুধু আলো এবং প্রেমই অন্ধকার ও হিংসা দূর করতে পারে। কিন্তু এত উচ্চমার্গের কথা কি ট্রাম্প সাহেবের অগভীর মাথায় ঢুকবে? আসল কথা হলো ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট থাকার মেয়াদ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী ২০২০সালের নির্বাচনে তিনি আবার নির্বাচিত হতে চান। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। তিনি মনে করেছেন ২০২০সালে তাঁকে নির্বাচিত হতে হলে তাঁকে দেয়াল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করতে হবে। শুধু একারণেই লক্ষ লক্ষ মানুষের বেতন ভাতা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন এবং আমেরিকার প্রশাসনে একটি ভয়ানক পরিস্থিতির সৃৃষ্টি করেছেন। তিনি মনে করেছিলেন আমেরিকানরা তাঁর ছলচাতুরী বুঝবে না। সম্প্রতি এক জনমত জরিপে ৬২ শতাংশ লোক সীমান্ত দেয়াল প্রশ্নে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছেন।

লেখক : কলামিস্ট