প্রেরণার বাতিঘর আল্লামা হাশেমী (রহ.)

175

মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

যুগশ্রেষ্ঠ আলেম দ্বীন পীরে কামিল আল্লামা নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ.) একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠান গড়ার শিল্পী। তিনি অসংখ্য গুণের অধিকারি বলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথ দেখিয়েছেন, আলোকিত করছেন। অন্ধকারের সমালোচনা না করে ছোট্ট একটি প্রদ্বীপ জ্বালানোর চেষ্টা অনেক ভাল। তিনি আমাদের মাঝে শত শত আলো জ্বালিয়ে অন্ধকারকে দূরীভূত করেছেন। তিনি একজন দক্ষ যোগ্য অভিজ্ঞ শিক্ষক ছিলেন। তিনি শুধু শিক্ষা দেননি, ভিতরে ভিতরে নির্মাণ করে ছডড়য়ে দিয়েছেন হাজার হাজার ছাত্র দেশ বিদেশে। তিনি শরীয়াতের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন মাদ্রাসা, মসজিদ এবং সংগঠন। তরিকত প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন খানকা। মাথার জ্ঞান এবং সিনার জ্ঞানের সমন্বয় না হলে পথভ্রষ্ট হতে পারে সে কথা তিনি ভালো ভাবে জানতেন বলে সারাজীবন শরীয়তের সাথে তরিকতের কাজ করেছেন। বয়সকে হার মানিয়ে বৃদ্ধ বয়সেও তিনি প্রাতিষ্ঠানিক কাজ চালিয়ে গেছেন। ঈমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা হাশেমী সাহেব হুজুর প্রসিদ্ধ আলেমগনের মধ্যে শীর্ষস্থানে অবস্থান করেছিলেন। আর্দশিক শিক্ষক হিসেবে তাঁর খ্যাতি দেশব্যাপী। যুদ্ধে শহীদ হওয়া দু’মিনিটের ব্যাপার কিন্তু সারা জীবন সত্য ন্যায়ের পথে প্রতিষ্ঠিত থাকা এক কঠিন ব্যাপার। হুজুর জীবনে কখনো সত্য ও ন্যায়ের পথ হতে বিচ্যুতি হননি। আহলে সুন্নাতের ঈমাম হিসেবে তিনি আমাদের ঈমানকে মজবুত করেছেন। এটি তাঁর বড় কাজ।
চট্টগ্রামকে বলা হয় “মদিনাতুল অলি” বা অলিদের শহর। বার আউলিয়ার পূণ্যভূমি চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের জালালাবাদ গ্রামের অভিজাত হাশেমী বংশে আল­ামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ.) ১৯২৮ সালের ২৯ডিসেম্বর দুনিয়াতে শুভ আগমন করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ হযরত ঈমাম হোসাইন (রঃ)’র বংশধর। ছাত্র জীবন হতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও প্রতিভাবান।আরবি, উর্দু,ফার্সি বাংলাসহ অসংখ্য ভাষায় হুজুর ছিলেন পন্ডিত ব্যাক্তি। জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। এক কথায় তাঁকে বলা যায় “ভার্সেটাইল জিনিয়াস” বা বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী। গবেষক হিসেবে তিনি সারাজীবন জ্ঞান সাধনায় জীবনকে উৎসর্গ করছে। গবেষণার স্বাক্ষর হিসেবে তাঁর রচিত অমর গ্রন্থ সমূহ আমাদের অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে,(১)সত্যের আহবান (২)যাদুল মুসলেমিন (৩)আকাইদে বাতেলা (৪)নসীহাতুল তালেবীন (৫)মেরাজুল মুমেনিন (৬)আল-আরবাইন-ফি-মুহিম্মাতিদ দ্বীন (৭) আদদুররুদ দালায়েল বে কেরাহতিল জামাতে ফুন নাওয়াফেল (৮) মুসলমানদের সম্বল পরহেজগারদের দিশারী (৯) ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) কেন? (১০) নূরে মোস্তফা (১১)আল­ামা আহছানুজ্জামান হাশেমী (রহ.)’র জীবনী গ্রন্থ (১২) শাযারাতুয যাহাব (১৩) দো’আর ভান্ডার (১৪) তাযকেরাতুল কেরাম (১৫) ওয়াযায়েফে হাশেমীয়া প্রমুখ। বাল্যকাল হতেই তিনি আল­াহর রাসূল (দ.)’র সুন্নাতের অনুপম আদর্শের অধিকারী ছিলেন। সত্যকে ভালোবাসতেন, মিথ্যা স্পর্শ করেননি কখনো। ন্যায়পরায়নতা ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। তিনি আল্ল­াহ এবং তাঁর রাসুল (দ.) কে স্মরণ করেছেন তাই আমরা তাঁকে অনুসরণ করছি। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি দেশের বিভিন্ন জেলায় ওয়াজ নসিহত এবং বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে শরীয়ত ও তরিকতের খেদমত করছেন। তাঁর বক্তব্যের মূল সূর হলো আল্লাহ পরিচয় এবং তাঁর বাণী মহানবী (দ.)’র মাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশের রহস্য গভীর। তাই প্রিয় নবীকে না বুঝলে আল্লাহ কে বুঝা যাবে না। ওয়াজ নসিহতের সময় তিনি রাসুল (দ.)’র প্রেমে ডুবে যেতেন। একাট্য যুক্তি এবং শরীয়তের দলিল দ্বারা ইসলামের বাণী প্রাঞ্জল ভাষায় মানুষকে বুঝাতেন। জ্ঞানী হতে সাধারণ মানুষ সকলেই তাঁর বক্তব্য সহজে বুঝতে পারতেন বলে তাঁর মাহফিলে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামতো। অপসংস্কৃতিকে যিনি পরিবর্তন করে সুস্থ সংস্কৃতির প্রচলন করেন তিনিই সংস্কারক। আশেকে রাসুল (দ.) আল্লামা হাশেমী (রহ.) একজন সমাজ সংস্কারক। তিনি ওয়াজ নসিহত এবং লেখালিখির মাধ্যমে যুব ও ছাত্র সমাজকে অসামাজিক কার্যকালাপ হতে ফিরিয়ে আনতে বড় ভূমিকা রাখছেন। প্রতি বছর হুজুরের আয়োজনে ১২ দিন ব্যাপী মিলাদুন্নবী (দ.)’র অনুষ্ঠানসহ বহু অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রিয় নবী (দ.)’র জীবনাদর্শ মানুষের মাঝে তুলে ধরে ঈমান আক্বীদা রক্ষার ঈমানী দায়িত্ব পালন করেছেন। সুন্নিয়তের নাম ব্যবহার করে যারা যেখানে সেখানে ভÐ মাজার স্থাপন ও অসামাজিক কর্মকাÐের মাধ্যমে অর্থ আয়ের জন্য ব্যবসা করে তিনি তাদের বিরুদ্ধে সারাজীবন প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ছিলেন। দু’একটি ভÐ মাজার তিনি ধ্বংসও করেছেন। তাঁর প্রতিটি বক্তব্য প্রকৃত অলি ভক্তদের জন্য প্রেরণার উৎস। হুজুরের প্রতিটি আলোচনা যেন বিদগ্ধ ব্যক্তির এক একটি ক্লাস। গাজীয়ে দ্বীনে মিল­াত ঈমামে আহলে সুন্নাত শেরে বাংলা আজিজুল হক আলকাদেরী (রহ.) ইন্তেকালের পূর্বমুহূর্তে আল্ল­ামা হাশেমী হুজুর (রহ.) কে ঈমামে আহলে সুন্নাত হিসাবে ঘোষণা করেন। তখন থেকে ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পযর্ন্ত তিনি আহলে সুন্নাতের ঈমাম ছিলেন। কয়েক বছর পূর্বে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৃহত্তম কাউন্সিলে তাঁকে সর্বসম্মতিক্রমে আজীবনের জন্য ঈমামে আহলে সুন্নাত হিসাবে নির্বাচিত করেছিলেন। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী (রহ.) শহীদ হওয়ার পূর্বে বার আউলিয়ার পূর্ণ ভূমিতে এসে বলে গেছেন ‘বাংলাদেশে সুন্নীয়তের ধারক বাহক বলতে যা বুঝায় তার সব কিছুই আমরা আল্ল­ামা হাশেমী সাহেব হুজুরের কাছে পাই। আল্ল­ামা শেরে বাংলা (রহ.)’র পর দেশের আলেমের মধ্যে সুন্নিয়তের প্রচার প্রসারে আল্ল­ামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমীর অবদান সবচেয়ে বেশি। তিনি একাধারে একজন বিদ্বান ব্যক্তি, গবেষক, বক্তা, লেখক ও আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ একজন কামেল মানুষ। তিনি রাসুল (দ.)’র একজন বলিষ্ঠ আশেক। আমি মনে করি তিনি যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন আমাদের মাথার উপর সূর্য আছে।আমরা তাঁর আলোয় আলোকিত থাকতে চাই যুগ যুগ ধরে।’
বাংলাদেশের কোন আলেম স্বাধিকার (ভাষা আন্দোলন) এবং স্বাধীনতা আন্দোলন দু’টিতে অবদান রাখেননি। হুজুর ছিলেন একমাত্র ব্যতীক্রম। তাঁর দু’টি আন্দোলনেই ভূমিকা ছিল। অনেক আরবি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি যখন পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে কিছুই না বলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকার আলবদরকে সহযোগিতা করেছে তখন হুজুর নির্যাতিত জনগণের পক্ষে একত্তরের মুক্তিযুদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন।
আল­াহর নবীগণ কোন সম্পদ রেখে যান না, রেখে যান জ্ঞান। যে জ্ঞানের উত্তরাধিকারী হলো আলেমগণ। যে জ্ঞান আলেমগণ মানব কল্যাণে উৎসর্গ করেন। আল্লামা হাশেমী সাহেব হুজুরের জ্ঞান ছিল মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। মহানবী (দ.)’র সুন্নাত তিনি নিখুঁতভাবে পালন করতেন বলে সারাজীবন উত্তম চরিত্রের অধিকারী হিসেবে অতিবাহিত করে যেতে পেরেছেন। নবী পাকের আদর্শ অনুসরণ ব্যতীত নায়েবে রাসুল (দ.) হওয়া যায় না। চট্টল ভূমিতে আমাদের মাঝে অনেক কিছু ছিল না কিন্তু আমাদের গর্ব করার মত একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন,তিনি আমাদের হাশেমী হুজুর (রহ.)। তিনি ছিলেন বটবৃক্ষ। সে বৃক্ষের ছায়া চলে গেল। হুজুরের পুরো জীবনটাই অনুসরণ যোগ্য। ফার্সী ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, কদরে নেয়ামত বাদ জাওয়াল দাঁত থাকতে যেমন দাঁতের মর্যাদা বুঝা যায় না তেমনি নেয়ামতের কদর হয় চলে যাওয়ার পর। হুজুর আমাদের জন্য কত বড় নেয়ামত ছিল তা আমরা পরিমাপ করতে পারিনি।
আজ হুজুর নেই। আমরা যেন অভিভাবকহীন হলাম। আমাকে হুজুর পছন্দ করতেন। হুজুরের একটি বইয়ের ভূমিকা আমার দ্বারা লেখতে তাঁর সুযোগ্য শাহজাদা মাওলানা আবুল ফোরকান হাশেমীকে প্রকাশ্যে নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
আল্ল­ামা নুরুল ইসলাম হাশেমী (মা: জি: আ:)’র দরবারে ১২ দিনব্যাপী মিলাদুন্নবী (দ.) মাহফিলের ১০ ম দিনে দরবারের চারদিকে মানুষ আর মানুষ। বলা যায় জন সমুদ্র। হুজুরের সামনে ৩০ মিনিটের অধিক সময় বক্তব্য প্রদার করি। মুগ্ধ হয়ে হুজুর আমাকে নিজ হাতে ফুলের মালা পরিয়ে দিলেন এবং বক্তব্যে আমার কথা বললেন ১০ মিনিটের অধিক সময়। আমার জন্য নিজে দোয়া করলেন এবং সবাইকে দোয়া করতে বললেন। কাল মাহফিলে অর্জিত সম্মান ছিল জীবনের সেরা উপহার। মহান আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া।

লেখক : রাজনীতিক, কলাম লেখক