প্রেম ও ধর্ম কেনাবেচার হাট

157

গত পর্বের পর
দেখুন ইরফান আলী খান সাহেব, আপনাদের দু’জনের যে বিয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছিল সেটা আমি জানি। কিভাবে জেনেছি সেটা এখন আর জেনে লাভ নেই। তবে আপনাদের বিয়েটা হয়ে গেলেই আমি বেঁচে যেতাম। শ্রেয়া আমার স্ত্রী। ভালোবাসে আপনাকে। শ্রেয়া আমার সাথে নির্জীব পড়ে থাকার চেয়ে আপনার সাথে সজীব থাকাটাই উত্তম হতো। বললেন শৈবাল চৌধুরী।
আপনি হতেন শ্রেয়ার চতুর্থ স্বামী বর। ইসলাম ধর্মমতে একজন পুরুষ স্ত্রী হিসেবে চারজন নারীকে গ্রহণ করতে পারে। যদি তাদের প্রত্যেকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা এবং বিচারের সমতা করতে পারে। ওখানে শ্রেয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টো। সে তিনজন স্বামীকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বা না করেই চতুর্থজনকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারছে। আমাকে বিচ্ছেদের পত্র পাঠিয়ে দিলে আমি মুক্তির মহানন্দে সেটা মেনে নিতাম।
চৌধুরী সাহেব বাদ দিন না ওসব। শ্রেয়া লাশ হয়ে আপনার বাসার মেঝেতে পড়ে আছে। তার সাথে আমার কী হতে পারতো না পারতো ওসব ভেবে আমাদের মধ্যে তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই। বললেন ইরফান আলী খান।
আপনার সাথে আমার সম্পর্কের তিক্ততা বাড়বে না। আমি এখন সময় আর পরিস্থিতির সাথে সমন্বয় করা শিখে গেছি। না হয় আপনার বাসায় গিয়ে দেখা হওয়ার সাথে সাথেই আপনাকে খুন করে ফেলতাম। আমি জানি দোষটা আপনার একার না। শ্রেয়ারও। তাছাড়া শ্রেয়া আপনার কাছে গেলেও রোমান্টিক অর্থ নৈতিক কোনভাবেই খারাপ থাকতো না।
আমরা মনে হয় চট্টগ্রাম শহরের কাছাকাছি এসে পড়েছি। বললেন ইরফান আলী খান। রাস্তার দু’পাশে জাহাজ-কাটা যন্ত্রাংশের দোকান দেখলেন। ভাটিযারী, চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামেও যাত্রা বিরতি হবে? বললেন ইরফান আলী খান।
হতে পারে। ওদের নিজস্ব বাস কাউন্টার আছে। ওখানে যাত্রী ওঠা-নামা করতে পারে।
কক্সবাজার পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে। প্রায় বার ঘন্টার জার্নি। বললেন ইরফান আলী খান।
ঠিক তাই। জার্নিটা আমার খারপা লাগছে না। দু’জনে কথা বলতে বলতে যাচ্ছি। আজই আমাদের পরিচয় হলো। একসাথে ভ্রমণও করছি। ব্যাংকের গদ বাঁধা জীবন থেকে হঠাৎ অঘোষিত ছুটি পাওয়া বড় ভাগ্যের ব্যাপার। যদিও পরবর্তী প্রতিটি মুহূর্তের জন্য আমরা দু’জনই শঙ্কিত এবং ভীত। কাল সকালের সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই বুঝা যাবে শ্রেয়ার আত্মহত্যার ব্যাপারটি মানুষের গোচরে এসেছে কি না। জানাজানি হলেই তো পুলিশ, সাংবাদিক সব একাট্টা হয়ে মাঠে নেমে পড়বে। অযথা টেনশান করে কাজ নেই। চলুন আমরা আমাদের মতো খোশ গল্প না ‘খোশ গল্প’ বলা যাবে না কারণ কথায় কথায় আমাদের মুখোশের আড়ালের চেহারাটাও খুলে যাচ্ছে। তাই গল্প না বলে স্মৃতির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতেই যাই।
এক নাগাড়ে বলে থামলেন শৈবাল চৌধুরী। পুনরায় শুরু করলেন শ্রেয়ার দ্বিতীয় স্বামীর সাথে ঘর-সংসার এবং বিচ্ছেদের কাহিনী আপনাকে বলবো বলেছিলাম।
জি। শ্রেয়া কি তার দ্বিতীয় স্বামীর গল্প আপনাকে বলেছিল?
একটি মেয়ে তার বিশ্রী অতীত সম্পর্কে স্বামীকে বলে? এটা আপনি বিশ্বাস করেন?
যেটুকু বলেছিল সেটুকুই আপনাকে বলবো। তাছাড়া আপনিও তো শ্রেয়ার চতুর্থ স্বামীদেব হতে যাচ্ছিলেন। আপনাকে তো আমার সম্পর্কেও অনেক কথা বলেছে।
ইরফান আলী খান কথা বাড়ালেন না।
শ্রেয়ার দ্বিতীয় স্বামীর নাম বাদল রহমান। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে। বায়ান্ন-তেপ্পান্ন হবে। বাসা ছিল মোহাম্মদপুরের শের শাহশুরী রোডে। বাদল সাহেব ব্যবসা করতেন। পরিচয়ের সুত্রটা কীভাবে হয়েছিল তা শ্রেয়া বলেনি। প্রথম স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পর নাকি সে খুব হতাশ হয়ে পড়েছিল। ফিরে গিয়ে মা-বাবাকে কিভাবে মুখ দেখাবে সে চিন্তায় বাধ্য হয়ে ফার্মগেটের একটি ছাত্রী হোস্টেলে উঠেছিল। শ্রেয়ার বাবা-মা তাকে ফিরে যেতে বলেছিল। পরিবারের মতে ভালো একটি ছেলে দেখে বিয়েও দেবে বলেছিল। কিন্তু শ্রেয়া আস্থা রাখতে পারেনি। ডিভোর্সী একজন মেয়েকে অবিবাহিত কোন ছেলে বিয়ে করতে চাইবে না। এটাই তার ধারনা ছিল। অর্থ-বিত্তের প্রতি যে শ্রেয়ার বেশ লোভ ছিল সেটাতো আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন। না হয় শ্রেয়া আপনার সাথে সম্পর্কই করতো না। বাদল রহমান শ্রেয়াকে বলেছিলেন ঘরে তার স্ত্রী আছে। অসুস্থ। তাই শ্রেয়াকে বিয়েতে বাদল রহমানের স্ত্রী দ্বিমত করবেন না। যেকোনভাবে শ্রেয়ার একটি অবলম্বন দরকার। একদিন সন্ধ্যের পর শ্রেয়া বাদল রহমানের সাথে বাসায় গেলো। বাসায় একাই ছিলেন বাদল রহমানের চল্লিশোর্ধ স্ত্রী সালেহা বেগম। তিন বেডের বড় বাসা। সুন্দর সাজানো-গোছানো বসার ঘর। বাদল রহমান চাবি দিয়েই বাহির থেকে দরজা খুলেছিল। শ্রেয়া বসার ঘরের সোফায় বসলো। বাদল রহমান ভেতর ঘরের দিকে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ঘুম জড়ানো চোখে ঢুলতে ঢুলতে সালেহা বেগম এলেন। বাদল রহমান শুধু আমার নামটা উচ্চারণ করলেন। নাম শুনেই আৎকে উঠলেন সালেহা বেগম। কিছুই বললেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন। হয়তো এতোদিন বাদল রহমান তার দ্বিতীয় বিয়ের কথা মুখেই বলেছেন। সত্যি কার্যে পরিণত করবেন এটা সালেহা বেদম ভাবতেই পারেননি। মাথার কাপড় মুখে টেনে দিয়ে ফিরে গেলেন সালেহা বেগম।
ফিরে যাওয়ার সময় সালেহা বেগমের চেহারার দিকে তাকিয়েছিল শ্রেয়া। বেদনায় নীল হওয়া সেই মুখটির কথা অনেকবার বলেছে শৈবাল চৌধুরীকে। কোন নারীই চায় না তার স্বামী অন্য কোন নারীর বিছানায় যাক। তেমন কোন পুরুষও তার স্ত্রীর ব্যাপারে অন্য কোন পুরুষ মেনে নিতে পারে না।
ইরফান আলী খান তব্দ হয়ে শুনছেন। শ্রেয়া যতবারই সালেহা বেগমের নীল মুখটির কথা বলেছে ততবার তার মনের ভেতর বয়ে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড়ের তোলপাড় অনুভব হয়েছে শৈবাল চৌধুরীর। সালেহা বেগমের মুখে কোন ভাষা ছিল না। যাওয়ার কোন জায়গা ছিল না। তাই স্বামীর এমন অবিচার মেনে নিয়েছিল। তবে সালেহা বেগমকে দেখে তেমন অসুস্থ বলেও মনে হয়নি শ্রেয়ার। বাদল রহমান নাকি সালেহা বেগমের যৌন অক্ষমতার কথাই বলেছিল।
যা হোক। বাদল রহামানের গলায় ঝুলে পড়েছিল শ্রেয়া। সালেহা বেগমের সাথে সাক্ষাতের তিন দিনের মাথায় সন্ধ্যা রাতে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে বেশ কয়েকপদের খাবার প্যাকেটও নিজের তল্পিতল্পাসহ বাদল রহমানের বাসায় উঠেছিল। বিয়ের কর্মটা কাজী অফিসেই সেরেছিল মিষ্টি আর সন্দেশ দিয়ে। যদিও মিষ্টি সন্দেশের কোনটাই শ্রেয়া মুখে তোলেনি।
বাসায় ওটার পর সালেহা বেগম নিয়মমাফিক আপ্যায়ন করেছিল শ্রেয়াকে। ওর আলাদা ঘর দেখিয়ে দিয়েছিল। ঢাকা শহরে কোন বাসায় কে থাকলো, কে আসলো গেল তার খোঁজ কেউ রাখে না। টাকার বিনিময়ে ফ্ল্যাট বাসায় এসে সময় কাটিয়ে যায় এমন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং পেশাদার অনেক মেয়ে ঢাকা শহরে আছে। এই ব্যবসাটাও প্রশাসনের গোচরে-অগোচরে দিন দিন জমজমাট হয়ে উঠছে। তবে এমন রমরমা ব্যবসার একমাত্র পথের কাটা ছুটা কাজের বুয়া। তারা এক বাসার ঘটনা অন্য বাসায় গিয়ে রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করে। কখনও কখনও নিজ থেকে কিছু বিশেষণ যোগ করেও বলতে দ্বিধা করে না।
সালেহা বেগমের বাসায়ও প্রতিদিন সকাল আটটায় ছুটা বুয়া আসে। সম্মান বাঁচানোর জন্যই সালেহা বেগম শ্রেয়াকে নিজের খালাতো বোন বলে বুয়াকে পরিচয় করিয়ে দেয়। এবং শ্রেয়া চাকরির সুবাদে ঢাকায় এসে উঠেছে এবং এখানেই তাকে থাকতে হচ্ছে। স্বামী বাদল রহমান দয়া পরবশ হইয়া তার বোনকে বাসায় থাকতে দিয়েছেন। জীবনের প্রয়োজনেই মানুষকে অদ্ভুত মিথ্যে বলতে হয়। সত্যের ভান করতে হয়। শত কষ্টে, অভাবে থেকেও সুখের অভিনয় করতে হয়।
দিন যায়। বাদল রহমান উভয় স্ত্রীর উপর পরম সন্তুষ্টির সহিত সংসার ধর্ম পালন করছে। সংসারের প্রতি যে উদাসীনতা ছিল সেটি আর নেই। সকালে এক টেবিলে তিনজন এক সাথে নাশ্তা করছে। রাতে শ্রেয়ার সাথেই শোয় বাদল রহমান। রাত যত গবীর হয় সালেহা বেগমের বুকটা ভারী হয়ে আসে। বুকের ভেতরের তোলপাড় দুমড়ে-মুচড়ে একাকার করে। নীরব কান্নায় বালিশ ভিজে। ঘুম আসে না। বিছানায় কোন বালিশ বুকে জড়িয়ে হু হু শ্বাস বেড়োয়। ছিটকিনি লাগানো দরজার ভেতর সালেহা বেগম তার আত্মার সাথে কথা বলে। সালেহা জানতে চায়Ñ এই কী ছিল নিয়তি? আত্মার প্রতিউত্তর পাওয়া যায় না। সতীনের সাথেই কি বাকি জীবন এক ছাদের নিচে কাটাতে হবে? নাকি সালেহা বেগম নিজে থেকেই এ ঘর ছেড়ে চলে যাবে? প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন মাথায় এসে ভীড় করে। সালেহা বেগম আত্মার কাছে কোন উত্তর পায় না। নেপথ্যে সালেহা বেগমের আত্মা হাসে। হঠাৎ একটি সমজদার জবাব আত্মার মুখ ফস্কে বেরিয়ে পড়েÑ সবুরে মেওয়া ফলে। সেই মেওয়ার অপেক্ষায় রাতভর নির্ঘুম পায়চারী করে সালেহা বেগম।
গভীর রাতে পাশের ঘরের স্নানঘর থেকে জল ঢালার শব্দ কানে আসে। পায়চারী থামিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে সালেহা বেগম। আর তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ঘুমোতে যায় শ্রেয়া ও বাদল রহমান।
একদিন শ্রেয়াকে প্রশ্নটি করেই বসে সালেহা চেগম। তুমি কেন বাবার বয়সী একজন লোককে বিয়ে করলে?
অনভিপ্রেত প্রশ্নে হোঁচট খায় শ্রেয়া।
তুমি কি জানো নারী হয়ে অন্য একজন নারীর জীবন ধ্বংস করে দিয়েছ?
শ্রেয়া কোন জবাব দেয়নি।
এই বিয়েতে কি তোমার বাবা-মার মত ছিল?
না।
তাহলে?
আসলে আমার একটা অবলম্বন খুব প্রয়োজন ছিল। ভালোবেসে মা-বাবার অমতেই একজনকে বিয়ে করেছিলাম। সেটা টিকেনি। তারপর ওদের কাছে ফিরে যেতেও মন চায়নি। তাছাড়া তিনি বলেছেন আপনি অসুস্থ। আর ওনার দ্বিতীয় বিয়েতে আপনারও কোন অমত নেই।
তোমার কী মনে হয় আমি অসুস্থ?
জি না। তবে তিনি আপনার যে অসুস্থতার কথা বলেছেন সেটাতো আর বাইরে থেকে দেখার সুযোগ নেই।
জিভে কামড় খেলেন সালেহা বেগম। বললেনÑ শ্রেয়া তুমি জেনে রাখো আমি অসুস্থ নই। আর কোন স্ত্রীই তার স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েতে মত দেয় না। আমি অমত করিনি বলে এই নয় যে মত দিয়েছি। ধরে নিতে পারো বাধ্য হয়েছি। না হয় আমার অস্থিত্বই যে টিকে না। এ সমাজের পুরুষদের তুমি কোনভাবে চিনতে পারবে না। অনেকেই বাদল রহমানের মতো দিনের বেলা সাধু আর রাত হলে নেমে পড়ে মহাযজ্ঞে। রাগের মাথায় পুরুষ জাতকে একচোট নিয়ে ক্ষান্ত হলেন সালেহা বেগম।
শোন শ্রেয়া আমি তোমাদের পাকা ধানে মই দেব না। তবে তোমার ভুলের মাশুল তোমাকে একদিন দিতেই হবে। আর একটি কথা আমি আশা করবো এসব তোমার স্বামী জনাবকে বলবে না। সবকিছুই স্বাভাবিক চলবে।
শ্রেয়া কথা বাড়ালো না। তবে সালেহা বেগমের কথায় তার নিজেকে অপরাধী মনে হলো। একজন নারী হয়ে অন্য একজন নারীর বাড়া ভাতে ছাই দেয়া প্রকৃতি কোনভাবেই সয় না। একথা মনে হতেই শ্রেয়ার মনটা চুপসে গেল। বাদল রহমানের প্রতিও তার ঘৃণার রেখা জন্ম নিল। কিন্তু শ্রেয়া এমন একটি ফাঁদে আটকা পড়ল যেখান থেকে খুব সহজে বেরিয়ে যাওয়ারও কোন পথ খোলা রইল না।
বিপত্তিটা ঘটলো যখন রানী তার চার বছরের বাচ্চা নিয়ে ঘরে এলো। কলিংবেলের শব্দ শুনে শ্রেয়া গিয়েছিল দরজা খুলতে। বাচ্চাসহ রানীকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিল। রানীর আর কতোই বা বয়েস। শ্রেয়ার মতোই হবে।
কাকে চাই? বলল শ্রেয়া।
কাকে চাই মানে? তুমি কে?
আমি…। পরিচয় দিতে গিয়ে থামে শ্রেয়া।
বাথরুম থেকে পড়ি কি মরি ছুটে আসে সালেহা বেগম। রানীকে দেখেই খুশিতে আটখানা।
রানী মা মনি আয়। আমার দিয়া নানুমনি এসেছে, বাহ্।
বলতে বলতেই সালেহা বেগম রানীর কোল থেকে চার বছরের দিয়াকে কোলে তুলে নেয়। আদর করে। চুমু খায়। শ্রেয়া কোন কথা বলে না। ওদের পিছু পিছু বসার ঘরে ঢোকে।
সোফায় না বসতেই, গায়ের জামা-কাপড় না ছাড়তেই রানী শ্রেয়াকে ইঙ্গিত করে বলে- মা, ওকে?
সালেহা বেগম শ্রেয়ার দিকে তাকায়। শ্রেয়ার বুঝতে বাকি থাকে না রানী সালেহা বেগমের মেয়ে। আর দিয়া তার নাতনি। দারুন অস্বস্তি নিয়ে শ্রেয়া তার ঘরে গিয়ে দরজার কপাট লাগায়। বালিশে মুখ বুজে কান্না করে। শ্রেয়ার মনে হাজারো প্রশ্ন উঁকি দেয়। বাদল রহমান কখনো বলেনি তার শ্রেয়ার সমবয়সী একটি মেয়ে আছে। মেয়ের ঘরে নাতনি আছে। মেয়ের আলাদা সংসার আছে। মনে প্রচন্ড চোট পেয়ে ভেঙ্গে পড়ে শ্রেয়া। দরজার কপাট খুলে বেরিয়ে আসে না।
ইতোমধ্যে সালেহা বেগমের কাছে শ্রেয়ার পুরো ঘটনা জেনে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে রানী। বাবা বাদল রহমানের প্রতি চরম ঘৃণায় একদলা থুথু ছিটায়। মায়ের কাছে বেড়াতে এলে যে ঘরে রানী থাকে সে ঘরটি দখল করে নিয়েছে শ্রেয়া। কোনভাবেই সমবয়সী একজন মেয়েকে মায়ের আসনে বসাতে পারে না রানী। বাদল রহমান অফিস থেকে ফেরার আগেই দিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়। সালেহা বেগম আটকায়। রানী নিজেকে বোঝাতে পারে না সে তার স্বামীকে কী জবাব দিবে। ছোট্ট দিয়াকে কী বলে পরিচয় করিয়ে দেবে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়। শ্রেয়া তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসেনি। দুপুরের খাওয়া হয়নি। ক্ষিদেয় পেটে মোচড় দিয়ে উঠেছে ক’বার। ঘরে থাকা বিস্কুট দিয়ে জল খেয়েছে। ওতে কী আর ভাতের ক্ষিদে মেটে।
বাদল রহমান যখন বাসায় ফেরে তখন রাত আটটা। কলিংবেল বাজতেই সালেহা বেগম গিয়ে দরজার ছিটকিনি খোলে। সালেহা বেগমকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হয় বাদল রহমান। কারণ শ্রেয়া এ বাড়িতে আসার পর বাদল রহমান অফিস থেকে ফিরলে দরজাটা শ্রেয়াই খুলেছে। হাতের ব্যাগ, বাজার-সদাই নিজের হাতে তুলে নিয়েছে।
কোন কথা না বলেই ভেতরে ঢোকে বাদল রহমান। বুঝতে পারে বাসায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে।
শ্রেয়া কোথায়? নীরবতা ভাঙ্গে বাদল রহমান।
ওর ঘরেই আছে।
ঘুমোচ্ছে?
জানি না।
ঝগড়া-ঝাটি কিছু হয়েছে?
না।
কথা না বাড়িয়ে শ্রেয়ার ঘরের দিকে পা বাড়ায় বাদল রহমান। তখনি সালেহা বেগমের ঘর থেকে নানুভাই নানুভাই বলে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসে দিয়া। বাদল রহমান কোলে তুলে নেয়। আর মুহূর্তেই তার বোঝা হয়ে যায় বাসায় কী ঘটেছে। দিয়াকে কোলে নিয়ে বসার ঘরে এসে আদর করে। মনের ভেতর তোলপাড় চলে বাদল রহমানের। শ্রেয়াকে কী জবাব দেবে। কিভাবে বশে আনবে শ্রেয়া আর রানীকে।
ওদিকে বাদল রহমানের উপস্থিতি টের পেয়েও ঘরের দরজা খোলে না শ্রেয়া। বাবা-মার অমতে বিয়ে করেছিল পঞ্চাশোর্ধ বাদল রহমানকে। এখন সে বাবা-মাকে কী জবাব দেবে। কী করে বলবে তার স্বামীরও শ্রেয়ার সমবয়সী একটি মেয়ে আছে। নাতনি আছে। আত্মীয়-স্বজন আছে। পাড়া-পড়শি আছে। সমাজ আছে। ভাবতে ভাবতে শূন্যতায় ভরে ওঠে শ্রেয়ার মন। সিদ্ধান্তহীনতায় আটকে থাকেনি। ব্যাগ গুছিয়ে সে রাতেই কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে গিয়ে ওঠে। শ্রেয়া তার দ্বিতীয় স্বামী বাদল রহমানের ঘর ছেড়ে পূনরায় বোহেমিয়ান জীবনে ফিরে যায়।
শ্রেয়ার দ্বিতীয় ঘর-সংসারের গল্প শুনতে শুনতে ইরফান আলী খান বিকল হয়ে পড়ে। টের পায় না বাস কখন চট্টগ্রাম দামপাড়া কাউন্টারে এসে থেমেছে। চট্টগ্রামের কিছু যাত্রী নেমে পড়ছে। কক্সবাজারগামী কয়েকজন যাত্রী উঠছে। (চলবে)
খান সাহেব চলুন মাইনাস করে আসি। আরও তিন ঘন্টার জার্নি। বললেন শৈবাল চৌধুরী।
দু’জনে নেমে বাস কাউন্টারের ওয়াশ রুমে গেলেন। ফিরে বাইরে দাঁড়িয়ে কফি নিলেন। কফিতে চুমুক দিয়ে ইরফান আলী খান বললেন- ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রাম শহরটা আমার কাছে বেশ খোলামেলা, স্বস্তির মনে হয়। জানজট তেমন একটা নেই। পাহাড়-সাগরের মেলবন্ধনে শহরটা বেশ উপভোগ্যও। ব্যবসার কাজে অনেকবার চট্টগ্রাম আসা হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে কর্ণফুলী নদীর পাড় দিয়ে শহরে আসার রাস্তাটা আমার কাছে সিঙ্গাপুর বলেই মনে হয়।
বছর পাঁচেক আগে আমিও একবার চট্টগ্রাম এসেছিলাম। অফিসের কাজে। আতোটা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়নি। বললেন- শৈবাল চৌধুরী। ঠিক আছে। তাহলে এবার ফেরার পথে আমরা অন্তত একদিন চট্টগ্রাম হয়ে যাব। ইরফান আলী খান জবাব দিলেন।
হু। চলুন। উঠে পড়ি। বাস ছাড়বে।
দু’জনে বাসে উঠলেন। সিটে বসলেন। গাইড যাত্রী গণনা করে ড্রাইভারকে বাস ছাড়ার নির্দেশ দিল। চট্টগ্রাম শহরের মধ্য দিয়ে বাস চলছে। সন্ধ্যা পেরিয়েছে। রাস্তায় হালকা জানজট আছে। ধীরে ধীরে বাস শহর থেকে বেরুনোর চেষ্টা করছে। কর্ণফুলী ব্রীজ পেরুলো। দু’পাশে গাছের সারি আর মাঝখানে পীচঢালা কালো পথ। অন্ধকারেও পরিবেশটা বেশ ভালো লাগছে। কর্ণফুলী ব্রীজ পেরিয়ে কিছুদূর আসার পরই দীর্ঘ জানজটের ফাঁদে পড়ল বাস। খুব ধীরে এগুচ্ছে। দূর থেকে মাইকের ঝাঁঝালো আওয়াজ আসছে। গানের মতোও মনে হচ্ছে।
রাস্তার উপর গানের আসর বসলো নাকি? বললেন শৈবাল চৌধুরী।
অসম্ভব না। সরকারের আস্থাভাজন হলে রাস্তা দখল করে যা ইচ্ছে করা যায়। বললেন ইরফান আলী খান।
মাইকের আওয়াজ নিকটবর্তী হচ্ছে। গানের পঙক্তিমালা পরিষ্কার হচ্ছে।

হযরত বাবা কেবলা কাবা
আয়নার কারিগর
আয়না বসাইয়া দে মোর
কলবের ভেতর।

এটা কী গান ইরফান আলী খান সাহেব! বললেন শৈবাল চৌধুরী। আমার যতটুকু মনে হয় আধ্যাত্মিক কোন গান হবে। ভান্ডারী গানও হতে পারে। নিশ্চয় সামনে কোন পীরের মাজার আছে। যেখানে কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে। বাৎসরিক ওরশও হতে পারে। বললেন ইরফান আলী খান। ঢাকায় তো ওসব তেমন একটা দেখা যায় না।
ঢাকায়ও আছে। তুলনামূলক কম। বাংলাদেশে পীর-মাজারের আধিক্য চট্টগ্রাম এবং সিলেটেই বেশি।
এই উপমহাদেশে মাজার সংস্কৃতির প্রচলন কখন শুরু হয়েছে আমার জানা নেই। তবে অফিসের কাজে আমি একবার দিল্লী গিয়েছিলাম। সেখানে কাজের ফাঁকে আমার নিজামউদ্দীন আউলিয়ার মাজারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।
কী দেখলেন?
সেখানে যা দেখলাম তাতে একরত্তি ইসলাম ধর্মের কিছু আছে বলে আমার মনে হয়নি। দেখলাম মাজারের বাইরে অনেকগুলো দোকান গোলাপের পাপড়ি, মোমবাতি, আগরবাতি, গোলাপজল, কবরের উপর বিছিয়ে দেয়ার গিলাপসহ নানা প্রকারের জিনিস নিয়ে ব্যবসার পসরা সাজিয়েছে। মাজারে তো খালি পায়ে যেতে হবে। সেই পায়ের জুতো খুললাম অমনি কয়েকজন দোকানী জুতো জমা রাখার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। যেখানে জুতো রাখার ভরসা নেই সেখানে পূন্যের কী ভরসা পাওয়া যাবে বুঝতে পারলাম না। হোঁচট খেলাম।
তারপর দোকানীরা হাকডাক দিচ্ছে। ফুল, মোমবাতি, আগরবাতি গিলাপ নিয়ে যান।
কিছুই নিলাম না। ওসবে আমার বিশ্বাস নেই। মাজারে ফুল দিয়ে, মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালিয়ে কোন পূন্য হয় বলেও আমি মনে করি না। যারা প্রকৃত পীর তারাও কখনো তাদের নিয়ে এ পূজা অর্চনা হোক সেটা চাননি।
ভেতরে গিয়ে তো আমার চোখ চানাবড়া। নিজামউদ্দীন আউলিয়ার কবর ছাড়াও সেখানে আশপাশে অনেকগুলো কবর আছে। কবরগুলো হয়তো পীরের খাদেম অথবা বংশধরদের। আলখেল্লা পরিহিত বেশ কয়েকজনকে দেখলাম যারা মাজারে আগত লোকজনকে কাছে ডাকছে। তাদের আগমনের হেতু জানতে চাইছে। মনোবাসনা পূর্ণের জন্য নির্দিষ্ট একটা ফি এর বিনিময়ে কী করতে হবে সব বলছে। নারী-পুরুষরা দলবেঁধে লাইন ধরে নিজামউদ্দীন আউলিয়ার কবরে একটিবার ঢোকার জন্য গিজগিজ করছে। বাইরে খাদেমদের অনেকেই বড় বড় বাক্স নিয়ে বসে আছে। আগত দর্শনার্থীদের নিকট থেকে দক্ষিণা নিচ্ছে।
যে ঘরটিতে নিজামউদ্দীন আউলিয়ার কবর আছে সেখানে ঠেলেঠুলে প্রবেশ করলাম। দাঁড়ালাম এক কোনায়। মানুষ লাইন ধরে ঢুকছে। গোলাপের পাপড়ি ছিটাচ্ছে। একটার পর একটা সবুজ আরবি লেখা খচিত গিলাপ কবরের উপর বিছিয়ে দিচ্ছে। কেউ সিজদা করছে। কেউ চুমু খাচ্ছে। আর কেউ দোয়া-দরুদ পড়ছে। কবরের পাশে বসে কোরান পড়ছে। মানুষের ঘেষাঘেষিতে গুমোট গরম বেরুচ্ছে। বেশিক্ষণ ভেতরে থাকা গেল না। বেরিয়ে পড়লাম।
বাইরে নিজামউদ্দীন আউলিয়াকে নিবেদিত গানের আসর বসেছে। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ গান শুনলাম। বেচারা গায়কের সম্মুখে দশ রুপি ছুড়ে দিলাম। টাকার জন্যই তো সে গলা ফাটিয়ে গান গাইছে।
ইরফান আলী খান সাহেব।
হু।
শুনছেন?
জি।
নিজামউদ্দীন আউলিয়ার মাজারে গিয়ে মনে হলো ওরা নতুন একটা ধর্ম তৈরি করে নিয়েছে। যার সাথে আমরা যে ইসলাম ধর্মকে জানি তার কোন মিল নেই।
ঠিক তাই! যদিও পৈতৃকভাবে মুসলিম হলেও আমি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে খুব কম জানি। বললেন ইরফান আলী খান।
আমি যে ধর্মবেত্তা তা কিন্তু নয়। তবে ধর্মের নামে এসব অধর্মগুলো মনকে নাড়া দেয়। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ধর্মের নামে যেসব পূজা-অর্চনা আজগুবি গল্পকে ধর্ম বলে চালিয়েছে তাই বংশ পরম্পরায় অধিকতর জৌলস নিয়ে উদযাপিত হচ্ছে।
একটি চাতুর্যের বিষয় লক্ষ্য করবেন ইরফান আলী খান সাহেব।
কী?
একশ্রেণীর লেবাসধারী মৌলানারাই পীর-আউলিয়ার নামে আজগুবি গল্প বানিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের ব্যবসাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করছে। আর এসব কথা প্রকাশ্যে বললেই তাকে নাস্তিক উপাধি দিয়ে শিরচ্ছেদও করতে পারে।
ধীরে চলমান বাস গানের উৎপত্তিস্থলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রং-বেরঙের বাতি দিয়ে আলোক সজ্জায় সজ্জিত গেট। দালান। রাস্তা। মাজারের গলি। গেটে লেখা- হযরত রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরিকত ইমামুল আউলিয়া হুসাই মুহাম্মদ জুলফিকার কাদের শাহ (রঃ) এর মহাপবিত্র বার্ষিক ওরম মোবারক।
‘পবিত্র’ শব্দটির সাথে আমাদের মনে সুন্দর ভালো, কল্যাণকর একটা ধারণা আস্থা গেড়ে বসে আছে। ‘মহাপবিত্র’ শব্দটির মানে কী অতিভালো, অতিকল্যাণকর নাকি অন্যকিছু অর্থ এখন অবধি বোধগম্য হয়নি। বলে থামলেন শৈবাল চৌধুরী।
মাজারের ভেতর থেকে ঢোল-তবলার ছন্দসমেত গানের ব্যঞ্জনা ছড়িয়ে পড়ছে। একমুখী রাস্তার দু’দিক থেকেই মাজারকে উদ্দেশ্য করে গাড়ি আসাতে জ্যামের সৃষ্টি হয়েছে। এভাবেই কারণে-অকারণে সাধারণ মানুষকে সব অন্যায় ভোগ করে যেতে হচ্ছে। মানুষকে দুঃখ কষ্ট দেয়া পাপ। জগতে দুঃখ সৃষ্টিকরা পাপ। ধর্মের নামে অধর্ম করে মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে কোন পূন্য হবে না। মসজিদ, মন্দির, ধর্মীয় উপাসনালয় ছাড়াও অনেক সামাজিক অনুষ্ঠানে গভীর রাত পর্যন্ত মাইক বাজিয়ে যে শব্দদূষণ করা হয়, সমাজের দুস্থ, পীড়িত মানুষদের কষ্ট দেয়া হয়। এ অপকর্ম নিয়ন্ত্রণের কেউ আছে বলে মনে হয় না।
ইরফান আলী খান সাহেব!
বলুন।
আমাদের দেশটা মনে হয় ধর্ম কেনাবেচার হাটে পরিণত হয়েছে। শুধু মুসলমান জাতিটার কথাই ভাবুন। ইসলাম ধর্মকে পুঁজি করে কত মতবাদ, দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এসব দল ও ভিন্নমতাবলীরা একে অপরকে বিধর্মীর চেয়েও বেশি অপছন্দ এবং ঘৃণা করে থাকে। নিজেরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে খুনোখুনিও হয়। ধর্মীয় ব্যবসাকে চাঙা করার জন্য এরা নিজেদের মনগড়া অনেক আচার পালনে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে তাদের ব্যবসা ভালোই হয়।

কক্সবাজার কলাতলী কাউন্টারে যখন বাস এসে থামল তখন রাত দশটা। ইরফান আলী খান ও শৈবাল চৌধুরী হোটেল সী প্যারাডাইজে এলেন। ফোনে আগে থেকে দু’টি আলাদা কক্ষ রিজার্ভ করে রেখে দিলেন ইরফান আলী খান। দু’জনে কক্ষে গেলেন। ফ্রেশ হলেন। রেষ্টুরেন্টে একসাথে খেলেন। তারপর হোটেলের ছাদে সাগরের দিকে পাতানো পাশাপাশি চেয়ারে বসলেন। সাগরের ঢেউয়ের সাঁ সাঁ শব্দ পরপর কাজে বাজছে। আবছা আলোতে নীলজলের সাদা ফেনারাশি দেখা বালুকা ভেলাতে আঁচড়ে পড়ছে। প্রকৃতির নির্দিষ্ট তাল-লয়-ছন্দে চির বহমান ঢেউ যে কারও মনকে উদাস করে দেয়। সাগরের ঢেউয়ের শব্দ আর নির্মল শীতল বাতাসে আনমনা হয়ে পড়েন শৈবাল চৌধুরী। ভাবছেন- সব অতীত জেনেও শ্রেয়া মেয়েটিকে একটু আশ্রয় দিয়ে। ভালোবাসা দিয়ে শান্তিতে ঘর সংসার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। তেমন কোন অভাব না থাকলেও অতি লোভ আর পরকীয়ায় জড়িয়ে নিজেকে শেষ করলো। আমার জীবনটাও বরবাদ করে দিল।
কী ভাবছেন চৌধুরী সাহেব? বললেন ইরফান আলী খান।
ভাবছি কী করা যায়।
কাল সকালের খবরের কাগজ দেখেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পত্রিকায় খবরটি বেরিয়ে গেলে আমাদের নাম জানাজানি হয়ে যাবে। তখন এই হোটেলে থাকাটাও নিরাপদ হবে না। আমাদের দু’জনের জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি হোটেলে দেয়া আছে। পুলিশ খুব সহজেই আমাদের খোঁজ পেয়ে যাবে। ইরফান আলী খান থামলেন। সেরকম কিছু হলে কী করা উচিত তাও তো ভেবে রাখতে হবে।
খবরের কাগজ সংবাদটি দেখার পরই আমাদের হোটেল ছাড়তে হবে। বললেন ইরফান আলী খান।
কোথায় যাব?
এখানে কক্সবাজার শহরের দিকে কিছু কমমূল্যের হোটেল আছে। যেখানে জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়াই পরিচয় গোপন করে ওঠা যাবে। পরিবেশটা এতো ভালো হবে না। থাকা যাবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসা পর্যন্ত আমাদের আত্মগোপনেই থাকতে হবে। পুলিশের একজন এস পি আছে আমার বন্ধু। প্রয়োজনে আমরা তার পরামর্শ নিব। বললেন ইরফান আলী খান। কিন্তু খবরের কাগজে প্রকাশ হওয়ার আগে কাউকে কিছু বলতে চাই না।
হ্যাঁ। বলা উচিতও হবে না। হিতে বিপরীত হতে পারে। কিন্তু একটি বিষয় কোনভাবেই আমার মাথা থেকে সরাতে পারছি না। বললেন শৈবাল চৌধুরী।
কী?
শ্রেয়া কেন যে আত্মহত্যা করলো! করলো। কিন্তু চিরকুটে আমাদের দু’জনকে কেন দায়ী করলো! ইরফান আলী খান সাহেব?
জি।
আপনার সাথে কি শ্রেয়ার এমন কিছু ঘটেছিল যার জন্য ও আত্মহত্যা করেছে? এবং এখন পর্যন্ত আপনি সে কারণটি আমাকে বলেননি। অথবা বলার আস্থা অর্জন করে পারেননি?
চৌধুরী সাহেব, শ্রেয়া এবং আমার সম্পর্কে কিছুই আমি আপনার কাছে লুকোইনি। তবে শ্রেয়ার একটি বিষয় আমার কাছে খুব রহস্যজনক মনে হয়েছিল।
কী?
আপনিসহ তিনজন পুরুষের সাথে সংসার করেছে ও।
হ্যাঁ।
তাহলে ওর বাচ্চা ছিল না কেন? এবং আপনাদের সংসারেও বাচ্চা নেননি কেন?
মৃদু জোৎস্নার আলোতে সমূদ্রের গর্জনকে ম্লান করে দিয়ে ইরফান আলী খানের প্রশ্ন শৈবাল চৌধুরীর কর্ণকূহরে জোরে আঘাত করে।
মানুষের বিবাহিত জীবনের উপর এধরনের একটি প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। যে সত্যিটা শৈবাল চৌধুরী জানে সেটা বলতে গিয়েও থামে। শ্রেয়ার ঔরষে বাচ্চা নিতে চেয়েছিলেন শৈবাল চৌধুরী। তখন শ্রেয়া বলেছিল সে কোনদিন মা হতে পারবে না। সে জন্যই তার প্রথম সংসার টেকেনি। যৌতুকের বিষয়টা আসল নয়। আর পঞ্চাশোর্ধ বাদল রহমান শ্রেয়া মা হতে পারবে না জেনেই বিয়ে করেছিল। একটি মেয়ের জীবনে মা হতে পারাটাই সবচেয়ে বড়ো সার্থকতা বলে আমাদের সমাজ জানে। মা হয়ে মেয়েরাও নিজেদের পরিপূর্ণতা পায়। শ্রেয়া মা হতে পারবে না এটা জেনে শৈবাল চৌধুরী আহত হয়েছিলেন কিন্তু শ্রেয়া কষ্ট পাবে ভেবেই তাকে এ বিষয়ে বেশি কিছু বলা হয়নি।
কী ব্যাপার! চুপ করে আছেন কেন? বললেন ইরফান আলী খান। কী বলবো। হয়তো কোন সমস্যা ছিল। তাছাড়া ওসব বিষয়ে প্রশ্ন করে শ্রেয়াকে কষ্ট দিতে চাইনি। বললেন শৈবাল চৌধুরী।
বিষয়টি আমি জানি! ইরফান আলী খানের এ জবাবে চমকালেন শৈবাল চৌধুরী।
তাহলে তিনি কী শ্রেয়া মা হতে পারবে না জেনে সময়টা উপভোগ করেছে?
কী জানেন?
শ্রেয়া চলে গেছে। কিন্তু তার মা না হওয়ার কারণটা আমাকে সবসময়, পীড়া দিয়েছে। আপনি শ্রেয়ার স্বামী ছিলেন। কিন্তু বিষয়টি হয়তো আপনিও জানেন না।
কী?
শ্রেয়া তার বিয়ের আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিয়ে করার পর কোন বাচ্চা নেবে না। অন্তত এক বছর স্বামীকে দেখবে। তাঁর সাথে বাকী জীবন কাঠিয়ে দেয়া যায় কিনা। যদি তার মনে সে বিশ্বাস জন্মায় তাহলে বাচ্চা নিবে আর না হয় নিবে না।
কী বলছে এসব ইরফান আলী খান! অবাক হয়ে ইরফান আলী খানের চোখে চোখ রাখে শৈবাল চৌধুরী। তাহলে কী শ্রেয়া ওকে মিথ্যে বলেছিল? ইরফান আলী খানের কথাই সঠিক? শৈবাল চৌধুরীকে ভালোবাসতে পারেনি বলে বাচ্চা নেয়নি?
হাজারো প্রশ্ন ভিড় করে শৈবাল চৌধুরীর মাথায়। রাত গভীর হচ্ছে। সমুদ্রের গর্জন তীব্র হচ্ছে। বাতাসের দমকা হাওয়া বাড়ছে। একি সাথে শৈবাল চৌধুরীর বুকের ভেতরও একটি মিথ্যের ঘুর্ণিঝড় বইছে।
চলুন উঠি। বললেন শৈবাল চৌধুরী।
হ্যাঁ। চলুন। ভোরে দু’জনে এখানকার পেপার স্ট্যান্ডে যাব। সবগুলো খবরের কাগজ দেখব।
রাতে ঘুম হলো না কারও। ভোরের আলো জেগে উঠতেই দরজায় ইরফান আলী খানের টোকা পড়ল। দু’জনে মর্নিং ওয়াক এর জামা পড়েই বেরিয়ে পড়লেন। টমটমে চড়ে কক্সবাজারের লালদিঘীর পাড় পত্রিকা স্ট্যান্ডে এলেন। জাতীয় দৈনিকের সবগুলো পত্রিকা তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। কোথাও শ্রেয়ার আত্মহত্যার সংবাদটি চোখে পড়ল না। স্বস্থির শ্বাস ফেলে দু’জনে সমুদ্রের বালুকায় হাঁটলেন অনেকক্ষণ। হোটেলে ফেরার পথে ভরপেট নাস্তা সারলেন। হেঁটেই ফিরলেন। আলাদা হয়ে কক্ষে ফেরার সময় দাঁড়ালেন শৈবাল চৌধুরী।
ইরফান আলী খান সাহেব!
জি।
লম্বা একটা ঘুম দেব। আপনিও ঘুম দেন। কালরাতেও ঘুম হয়নি। প্রয়োজনে লেট লাঞ্চ হবে। দু’জনে বিদায় নিয়ে ফিরলেন।
তিন দিন পেরিয়ে গেল। খবরের কাগজে শ্রেয়ার কোন মৃত্যু বা আত্মহত্যা সংবাদ পাওয়া গেল না। ইরফান আলী খান দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। শ্রেয়ার লাশটি শৈবাল চৌধুরীর বাসার মেঝেতে পড়ে আছে চারদিন হয়ে গেল। ভাবতেই গা গুলিয়ে আসছে। নিশ্চয় ইঁদুর, তেলাপোকা, টিকটিকি সহ হরেক রকম পোকামাকড়ের খাবার হয়েছে। কিলবিল করে খাচ্ছে। ইশ্ শ্রেয়াতো আমাকে ভালোবেসেছিল। পরকক্ষণেই ইরফান আলী খানের ভাবনা পাল্টে যায়। সত্যি কি শ্রেয়া আমাকে ভালোবেসেছিল? নাকি ভালোবাসার অভিনয় করেছিল। যাই হোক। ভালো নাইবা বাসলো। আত্মহত্যা করলো কেন? ওকে হয়তো আমি বিয়ে করতাম কিনা জানি না। কিন্তু ওর ক্ষতি তো কখনো চাইনি। বিছানায় শুয়ে ভাবনার কোন সীমারেখা খুঁজে পায় না ইরফান আলী খান। হোটেল কক্ষের দরজায় টোকা পড়ে। প্রবেশ করে শৈবাল চৌধুরী।
একটি বিশেষ খবর দেয়ার জন্য এলাম।
চমকালেন ইরফান আলী খান। পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছে?
না।
তাহলে?
আজ শ্রেয়ার জন্মদিন। আপনার নিশ্চয় জানা আছে।
হ্যাঁ। একদম ভুলে গিয়েছিলাম।
আমি চাইছি শ্রেয়ার জন্মদিনটি আজ সন্ধ্যায় উদযাপন করবো। বললেন শৈবাল চৌধুরী।
কী বলছেন চৌধুরী সাহেব? শ্রেয়া আত্মহত্যা করেছে। ওর লাশটি আপনার বাসার মেঝেতে পড়ে আছে পোকামাকড়ে খাচ্ছে। এখনো সমাধিস্থও হয়নি। আর আপনি ওর জন্মদিন উদযাপন করতে চাইছেন? বললেন ইরফান আলী খান।
হ্যাঁ। করতে চাইছি। কারণ আমি শ্রেয়াকে কথা দিয়েছিলাম ওর এবারের জন্মদিনটি আমি ব্যতিক্রমভাবে উদযাপন করবো।
কিন্তু শ্রেয়াতো পরপারে চলে গেছে!
পরপারে গেলেও ওর দেহটা এখনো পৃথিবীতে আছে। ওকে দেয়া কথাটি আমি রাখতে চাই। বেশি কিছু আয়োজন করবো না। এখানে সাগরপাড়ে একটি ভাসমান রেস্টুরেন্ট আছে। ‘মায়া’। বাশ আর চটি দিয়ে তৈরি। জোয়ারের সময় রেস্টুরেন্টটি মনে হয় ঢেউয়ের তালে ভাসছে। ‘মায়া’ রেস্টুরেন্টে আমরা শ্রেয়ার জন্মদিন উদযাপন করবো। দু’জনে কেক কাটব আর স্যুপ খাব।
স্ত্রীর লাশ রেখে এমন কমেডি হতে পারে! বললেন ইরফান আলী খান। সত্যিকথা বলতে আমি নিজেকে স্বাভাবিক রাখার জন্যই এরকম আজগুবি কাজ করছি। প্লিজ আমাকে একটু আমার মতো থাকতে দিন। বললেন শৈবাল চৌধুরী। ইরফান আলী খান কথা বাড়ালেন না।
সন্ধ্যা হলো। ভাসমান রেস্টুরেন্ট ‘মায়া’এর খোলা আকাশের নীচে পাতানো চেয়ারে সমূদ্রের দিকে মুখ করে বসলেন ইরফান আলী খান ও শৈবাল চৌধুরী। আকাশে অগণিত তারা। সমূদ্রে মাছ ধরার নৌকাগুলোতে মিটমিটি আলো জ্বলছে। পর্যায়ক্রমিক ঢেউয়ের সাঁ সাঁ শব্দ। রেস্টুরেন্টের ওয়েটার টেবিলে কেক, ছোরা এনে রাখল। মোমবাতি আনা হলো না। বাতাসে জ্বালানো যাবে না।
ইরফান আলী খান চুপচাপ সমূদ্রের বিশাল জলরাশি আর ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।
বুঝলেন ইরফান আলী খান সাহেব, শ্রেয়া মেয়েটি খুব ভালো ছিল। বাড়তি লোভের অংশটুকু বাদ দিলে তাকে একশ’তে একশ’ই দিতে হয়। ওর প্রতি আমার করুণা ও ভালোবাসা দু’টিই ছিল। কিন্তু যখন জানতে পারলাম শ্রেয়ার সাথে আপনার খুব ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে এবং তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওকে বলবো ও যেন আপনারই সত্ত¡ হয়ে যায়। আমার কোন দ্বিধা, ক্ষোভ, ঘৃণা কিছুই থাকবে না। আমি সবসময় চেয়েছিলাম শ্রেয়া সুখে থাকুক। সবসময় ওর মনের চাওয়া-পাওয়ার মিল হোক। একটাইতো জীবন। শ্রেয়া বেঁচে থাকলে ওকে আপনার হাতেই তুলে দিতাম। কী! আপনি শ্রেয়াকে গ্রহণ করতেন না? বললেন শৈবাল চৌধুরী।
ইরফান আলী খান কোন জবাব দিলেন না।
ইরফান আলী খান সাহেব কোন জবাব না দিলেও আপনার মনের আকুতি আমি বুঝতে পারছি।
চৌধুরী সাহেব!
জি।
আপনার অনুরোধটা রাখার জন্যই শ্রেয়ার জন্মদিনের এই নাটকটি করছি। প্লিজ কেকটা কাটুন। হোটেলে ফিরে যাই।
শৈবাল চৌধুরীর মুঠোফোন বেজে উঠলো। চমকে উঠলেন ইরফান আলী খান। গত চারদিনে দু’জনের ফোন একটিবারের জন্যও বেজে ওঠেনি। কারণ দু’জনে নতুন সিম লাগিয়েই ঢাকা থেকে এসেছিল।
শৈবাল চৌধুরী পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করলেন। শুধু একটি উত্তর দিলেন- হ্যাঁ। তারপর মুঠোফোনটি পকেটে পুরলেন।
আপনার ফোন! সিম পাল্টেছেন? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন ইরফান আলী খান।
জি। চলুন কেক কাটি।
শৈবাল চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে কেক কাটার জন্য দাঁড়ালেন ইরফান আলী খান। ঠিক এই সময় সুন্দর নীল শাড়ী জড়িয়ে জমকালো সেজে সামনে এসে দাঁড়ালোÑশ্রেয়া। ইরফান আলী খান ভূত দেখার মতো আৎকে উঠলেন। শ্রেয়াও ইরফান আলী খানকে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। সমূদ্রের ঢেউয়ের গর্জন, লক্ষ তারার ঝিকিমিকি, দমকা বাতাস সবকিছুই যেন থেমে গেছে।
দুঃখিত ইরফান আলী খান সাহেব ও প্রিয়তমা শ্রেয়া। আপনাদের এই শুভ মুহূর্তে আমি হংস মাঝে বকজটা হয়ে থাকতে চাই না। পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখি হোক।
‘মায়া’ রেস্টুরেন্টের কাঠের সিঁড়ি ধরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন শৈবাল চৌধুরী।

সমাপ্ত