প্রিয় বন্ধু গাছ

280

আমার প্রিয় বন্ধু গাছের কথা বলছি। অনেকেই ভাববেন গাছ আবার বন্ধু হয় নাকি? উদ্ভটে কথা। বাংলার বিজ্ঞানি জগদীশ চন্দ্র বসু প্রথম প্রমাণ করেন গাছেরও প্রাণ আছে। বর্তমানে উদ্ভিদ বিজ্ঞানিরা প্রায় পাঁচ লাখ পঞ্চাশ হাজারের বেশি প্রজাতির জীবন্ত প্রাণ নিয়ে গবেষণা করে চলছেন। আমাদের বাংলাদেশে অনেক প্রজাতির গাছ আছে। তাদের আমরা দেশি প্রজাতি বলে থাকি। আবার জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থাও সহস্রগুনে উন্নত হয়েছে। তাই পৃথিবী অনেক ছোট হয়ে আসছে। ফলে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গাছ পশু পাখি স্থানান্তরিত হচ্ছে। কেউ শখ করে আনছেন আবার কেউ প্রয়োজনে নিয়ে আসছেন।
বাংলাদেশের সীমানায় শুধু যে গাছ আছে, অন্য কোথাও নেই-তেমন গাছের কথা কী আমরা জানি? গাছপালারা মানুষের মতো রাজনৈতিক ভূগোল মানে না। তারা মানে ভূপ্রকৃতিও জলবায়ুকে। আমাদের গাছপালারা সবাই ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার। আবার কিছু কিছু বিদেশি গাছও সম্প্রতি আমাদের আপন হয়ে উঠেছে। উদাহরণত আফ্রিকার তেঁতুল, কৃষ্ণচূড়া, জাকারান্ডা, গগন শিরিষ, আমেরিকার কলকে, মেহগনি, রেইন ট্রি অস্ট্রেলিয়ার ইউক্যালিপ্টাস, ঝাউ, সোনাঝরি ইত্যাদি। আগেই বলেছি গাছ আমার প্রিয় বন্ধু। আমি মনে করি মানুষ যদি গাছের সাথে বন্ধুত্ব পাততে পারে, তাহলে মানুষ খুব সহজে প্রকৃতির গভীর গহনে প্রবেশ করতে পারবে।
আমার ফ্ল্যাটের ছোট লনে অনন্তলতা, অলকা নন্দা, ম্যাক্সিকান চিংড়ি, অপরাজিতা, পার্পেল হার্ট, হাড়ভাঙ্গা লতা, কালো ও সাদা তুলষি, তিতে করলা, ডায়ামথাস, দোপাটি, পিনটেট, রঙ্গন, ঘৃতকুমারী, নয়নতারাসহ অনেকগুলো গাছ। প্রতিদিন আমি ভোরে তাদের সাথে কথা বলি, তাদের যত্ন নেই, প্রতিদিন গাছের কাছে চড়–ই, শালিক, দোয়েল, কাক বুলবুলি, মৌটুসী, পাখিরা যেমন আসে তেমনি প্রজাপতি মৌমাছিসহ নানান কীটপতঙ্গ ও আসে। ওদের সবাইর সাথে আমার ভাব। ওরা ফুল নিয়ে যেমন খেলা করে তেমনি পাত্র থেকে জলপান করে। কেউ কেউ আরার স্নান ও সেরে নেয়। বলা যায় লনের এই গাছগুলোকে ঘিরে জীববৈচিত্র্যের মেলা বসে। আমি গাছের পরিচর্যা করে যেমন আনন্দ পাই। তেমনি গাছ, পাখি ও কীটপতঙ্গ ও তাদের জীবন চক্রে আনন্দ পায়।
জীবজগৎ ও মানব জীবনে গাছ এক এক জনের কাছে এক এক ভাবে ধরা দেয়। যেমন চাষীর কাছে গাছ হলো বলদের কাধে রাখা জোয়াল। জেলের কাছে গাছ হলো নৌকা, যাতে চড়ে সে মাছ ধরতে যায় নদীতে। রাখালের কাছে গাছ হলো ছাগলকে খাওয়াবার লতাপাতা। ছুতোরের কাছে গাছ হলো টেবিল, চেয়ার। মায়ের কাছে গাছ হলো রান্না করার আগুন। পথিকের কাছে রোদ্দুর উঠলে গাছ হলো ছায়া, বৃষ্টি এলে গাছ হলো ছাতা, ছোটদের কাছে গাছ হলো খেলার জায়গা। পাখি আর বাঁদরের কাছে গাছ হলো ঘরবাড়ি। গাছ হলো মাটিকে ধসে যাওয়া থেকে বাঁচবার পাহারাদার। আমাদের সবার জন্য গাছ হলো মস্ত এক ছাদের মতো। সূর্যের প্রখর তেজ থেকে এই পৃথিবীকে রক্ষা করে। গাছ হলো আমাদের পৃথিবীর কাছে ফুসফুস। আমরা যে বাতাস থেকে নিঃশ্বাস নেই। গাছ সে সব তৈরী করে। বিশ্বে এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। বর্ষার সময় বৃষ্টি নেই, গড় মত্তসুরে প্রবল বৃষ্টিপাতে ডুবে যাচ্ছে শহর ও নগর। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে দেশে শীত হ্রাস পাচ্ছে আবার কোথাও প্রচন্ড তুষারপাত। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভ‚মিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানি ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দসহ সুশীল মানুষের জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য শঙ্কিত। সবাই যে যার মতো করে জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা হ্রাস করার জন্য কাজ করছে। মানুষ সৃষ্ট নানাবিধ কারণ ছাড়াও পৃথিবী থেকে গাছের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া অন্যতম কারণ। পৃথিবী জুড়ে যে পরিমান জমি আছে তার ২৫ শতাংশ ভূমি জুড়ে বনভূমি থাকলে সবচেয়ে আদর্শ হতো। তেমনি বাংলাদেশের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ আয়তন জুড়ে গাছ নেই। বাংলাদেশে আছে মাত্র ১০ থেকে ১২ শতাংশ। এতে করে আমাদের দেশে কাম্য স্তরে বৃক্ষ নেই। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের যে আঘাত আসবে, তা থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন হবে। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেয়া যাক; ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশের দক্ষিণ ও উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। বলা যায় সে সময় সুন্দর বনের বনবনানী ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত প্রতিহত করায় জনগণ ও পশু সম্পদ রক্ষা পায়। যার প্রেক্ষিতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি একেবারে হয়নি বললেই চলে। অন্যদিকে ১৯৭০ সালের গর্কিতে নোয়াখালী খুলনা অঞ্চলে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এই দুই উদাহরণ থেকে বোঝা যায় গাছ/বৃক্ষ আমাদের কত আপনজন। শুধু তাই নয় আমরা প্রতিদিন যে শ্বাস নেই তা কিন্তু গাছই সরবরাহ করে থাকে। গাছ প্রকৃতি থেকে বিষাক্ত নাইট্রোজেন শুষে নিয়ে শালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে বায়ু মন্ডলে অক্সিজেন ছাড়ে। আমরা শ্বাসের মাধ্যমে সে অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে থাকি। হাসপাতাল সমূহে মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানোর জন্য জরুরী ভিত্তিতে নলের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে।
আগেই বলেছি একটি দেশে মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা উচিত। আমাদের তা নেই। অথচ আমাদের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটির উপরে। একজন মানুষ দৈনিক ৩ সিলিন্ডার অক্সিজেন ব্যবহার করে থাকেন। বর্তমান বাজার অনুযায়ী এক সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা। আমরা হিসাবটা করবো ৯০০ টাকা হিসাবে। তাহলে একজন ব্যক্তি দৈনিক ৯০০৩=২৭০০ টাকার অক্সিজেন ব্যবহার করে থাকেন। সে হিসেবে এক বছরে অর্থাৎ ৩৬৫ দিনে একজন ব্যক্তি ২৭০০৩৬৫=৯৮৫৫০০.০০ টাকার অক্সিজেন ব্যবহার করে থাকেন। আমাদের গড় আয়ু ৬৫ থেকে ৭২ বছর। আমরা গড়ে ৬৫ বছর ধরি। তাহলে ৯৮৫৫০০৬৫ বছর=৬ কোটি ৪০ লক্ষ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকার অক্সিজেন ব্যবহার করে থাকে। আগেই বলেছি অক্সিজেন সরবরাহ করে একমাত্র বৃক্ষ। মানব জাতির কি সে কথা মনে আছে? এই গবেষণা থেকে এই স্পষ্ট যে, মানব জাতির জীবনের জন্য বৃক্ষ কত জরুরী। কারণ অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। তাই আমাদের উচিত হবে পরিকল্পিতভাবে বনায়ন করা। এই পৃথিবীতে কেউ কাউকে কোন কারণ বা লাভ ছাড়া অর্থ সাহায্য করে না। কিন্তু একমাত্র বৃক্ষই মানুষকে কোন কিছুর বিনিময় ছাড়া সাড়ে ৬ কোটি টাকার অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। তাই বৃক্ষ আমাদের অতিপ্রিয় বন্ধু বৈকি? যে নিঃস্বার্থে আমাদের সেবা করে থাকে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশ এক সময়ে জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ছিল। প্রায় ৫৭০০ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ ছিল। আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে দেশের এই বৈচিত্রময় জীববৈচিত্র্য এখন হুমকীর সম্মুখীন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ইতিমধ্যে শতাধিক প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্ন প্রায়। আবার কেউ কেউ আশংকা করছেন এ সংখ্যা আরো বেশি হবে। অন্যদিকে তাড়াতাড়ি ফল ও ফসল লাভের আশায় হাইব্রিড তথা দ্রুত বর্ধনশীল ও বিদেশী গাছ উদ্বেগজনকভাবে দেশীয় গাছের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে। অথচ পরিবেশও প্রতিবেশ বিবেচনায় এনে দেশীয় মূল্যবান গাছ সমূহের গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে আমাদের দেশীয় পশুপাশি খাদ্যের অভাবে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিওডি জিনিরিওতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধরিত্র সম্মেলনের পরিবেশ সনদে স্বাক্ষর করে। এছাড়া ১৯৯৪ সালে অনুসমর্থনপূর্বক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিশ্ববাসীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার ঘোষণা দেয়।
গাছ আমার বন্ধু। গাছ মানুষের প্রিয় বন্ধু। বিজ্ঞানি জগদ্বিশ চন্দ্র বসু গাছের প্রাণ আছে বলে প্রমাণ করেছেন। আমরা আমাদের বাড়ি ঘরে মাঠে বিদ্যালয়ে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে গাছ লাগাতে পারি। সাম্প্রতিক সময়ে বাড়ির ছাদে বাগান করার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। একে ছাদ কৃষি বলা হয়। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৬ কোটি মানুষ যদি একটি করে গাছ লাগানোর জন্য শপথ করি। তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচা যেতে পারে সমস্যা হলো বাংলাদেশিদের দেশপ্রেম নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। একজন ভারতীয় নাগরিকের তার দেশের প্রতি যে ধরনের দেশ প্রেম লক্ষ্য করা যায় কিংবা বিশ্বের অন্যদেশের জনগণের মধ্যে যে দেশ প্রেম দেখা যায়- আমাদের বাংলাদেশিদের কী সে প্রেম আছে। ১৯৭১ সালে আমরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করি। তখন আমাদের ভেতর কাজ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীনতার ৪০ বছর চলছে, হিসাব করে দেখুন এরি মাঝে আমরা আমাদের বনভূমি, জলাশয় এবং সুউচ্চ বৃক্ষ জবর দখল, ধ্বংস, গ্রাস করে ফেলেছি। সুউচ্চ বৃক্ষের অভাবে অনেক পাখি তাদের আবাসন হারিয়ে ফেলে বিলুপ্তির তালিকায় চলে গেছে। শিল্পায়ন ও নগরায়নের নামে পাহাড় টিলা ও শতবর্ষী বৃক্ষগুলো ধ্বংস করে ফেলছি। উন্নয়নের জন্য যদি আমরা গাছ কাটতে পারি। কিন্তু একটি গাছ কাটার পর কী আমরা পাঁচটি গাছ লাগানোর শপথ করেছি। দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য আমরা উদগ্রীব নই। জাতি হিসাবে আমরা বিভক্ত। দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হলে আজ বাংলাদেশ সোনার বাংলায় পরিণত হত। আমাদের ভূমিতে পাহাড়, টিলা, জলাশয়কে অক্ষুন্ন রাখার জন্য সম্মিলিতভাবে সোচ্চার নই। তেমনি একটি বৃক্ষকে বাঁচানোর জন্য ঐক্যবদ্ধ নই নিজের শেকড়ের কথা ভুলে গিয়ে মেকি নিয়ে বেড়ে উঠছে। হত্যা করছি আমাদের প্রিয় বন্ধু বৃক্ষকে।
লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)