প্রার্থী ছাপিয়ে আলোচনায় প্রতীক

77

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা ফুরিয়ে আসার সাথে সাথে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদে নির্বাচনী প্রচারণার পাশাপাশি প্রার্থীকে ছাপিয়ে ভোটারদের আলোচনার শীর্ষে উঠে আসছে প্রতীক বা মার্কা। জোটের ভোটের মাঠের হিসাব-নিকাশে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের ঐক্য ধরে রাখার ‘দাওয়াই’ হিসেবেও প্রতীকের কথা বলছেন জোটবদ্ধ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। দল বা জোট প্রার্থী নিয়ে মান-অভিমান যা-ই থাকুক না কেন নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে শেষমূহূর্তে প্রতীকই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা।
দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি গত অক্টোবরে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এ জোটে আ স ম আব্দুর রবের জাসদ, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য এবং সর্বশেষ কাদের সিদ্দিকীর কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগও যোগ দেয়। আসন ভাগাভাগি করে এ জোটের মনোনীত প্রার্থীরা ধানের শীষ প্রতীকে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। এছাড়া, বিএনপি আগে থেকেই জামায়াত ইসলামী ও এলডিপিসহ সম্প্রসারিত ২৩ দলীয় জোটের নেতৃত্বে রয়েছে। এর মধ্যে নিবন্ধন হারানো জামায়াত ইসলামী ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করলেও কর্নেল (অব.) অলির এলডিপি দলের নিজস্ব নিবন্ধিত প্রতীক ছাতা নিয়েই নির্বাচন করছেন।
অপরদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সাথে এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়াও এবার অধ্যাপক বি. চৌধুরীর বিকল্পধারাও জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে জাপা নিজস্ব লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করলেও বিকল্পধারা নৌকা প্রতীকে অংশ নিচ্ছে। এছাড়া, ইসলামী দল তরিকত ফেডারেশনও দুটি আসনে নৌকা প্রতীকে ভোটযুদ্ধে নেমেছে।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মধ্যে অন্তত ২০টি আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপিকে ঘিরে গড়ে তোলা নির্বাচনী জোটের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি ধানের শীষ প্রতীকে এবং নয়টি নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোকে বরাদ্দ দেয়ার জন্য রয়েছে মোট ৬৪টি প্রতীক। এর মধ্যে নিবন্ধিত ৩৯ রাজনৈতিক দলের নিজস্ব প্রতীক হিসেবে ৩৯টি বরাদ্দ রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে বরাদ্দ দেয়ার পর অবশিষ্ট প্রতীকগুলোর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পছন্দ অনুযায়ী বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তফসিল অনুযায়ী, ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হবে আগামী ৩০ ডিসেম্বর।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘আমাদের দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে শেষ মূহূর্তে প্রতীকই সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে। যেমন নৌকা আর ধানের শীষ প্রতীক দুটি সর্বশ্রেণির ভোটারের কাছে সর্বাধিক পরিচিত। ভোটারদের বড় অংশের বসবাস হচ্ছে গ্রামে। পেশায় যারা কৃষক-মজুর। তারা ব্যালটে প্রতীক দেখেই ভোটাধিকার প্রয়োগে অভ্যস্ত। এ প্রবণতা আবার নারী ভোটারদের মধ্যে বেশি। তাই প্রচারণার শেষদিকে দলীয় নেতাকর্মীরা ভোটারদের সামনে সব ছাপিয়ে প্রতীকই উপস্থাপন করেন।’
এদিকে, ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ফলাফল বিশ্নেষণ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বলয়ভিত্তিক ভোট বাড়ার চিত্র পাওয়া গেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সম্মিলিত ভোট ছিল ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ। ওই নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপি গৃহীত ভোটের ৩০ দশমিক আট শতাংশ পেয়ে একশ’ ৪০ আসনে বিজয় ঘরে তুলেছিল। আর ৩০ দশমিক এক শতাংশ ভোট পাওয়া আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৮৮ আসন। বাকিরা পেয়েছিল ৩৯ দশমিক এক শতাংশ। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট গিয়েছিল বড় দুই দলের বাইরে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে আসন ছিল ৭২টি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াত ১২ দশমিক এক শতাংশ এবং জাতীয় পার্টি ১১ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। সংসদে দল দুটির আসন ছিল যথাক্রমে ১৮ ও ৩৫টি। এর বাইরেও অন্য দলগুলোর আসন ছিল ১৯টি। সেই থেকে বড় দুই দলের বাইরে আসন ও ভোটের সংখ্যা কমতে শুরু করে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ ৩৭ দশমিক চার শতাংশ ভোট নিয়ে একশ’ ৪৬টি আসন পেয়েছিল। আর ৩৩ দশমিক ছয় শতাংশ ভোট টেনে বিএনপি পেয়েছিল একশ’ ১৬ আসন। ২৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বাকিরা। আগের বারের চেয়ে চার শতাংশ বেশি ১৬ দশমিক চার শতাংশ ভোট পেয়েও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের লাঙ্গল পেয়েছিল ৩২ আসন। আর আট দশমিক ছয় শতাংশ ভোট পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর ঘরে যায় মাত্র তিনটি আসন। বিগত ২০০১ সালে নির্বাচনে চারদলীয় জোটের মাধ্যমে ভোটের রাজনীতিতে জোটবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ শুরু করে বিএনপি। জোটবদ্ধ রাজনীতি শুরুর পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জোটের বাইরে থাকা দলগুলোর ভোট কমছে। অষ্টম সংসদ নির্বাচনে নৌকা ও ধানের শীষের বাইরে ১৮ দশমিক চার শতাংশ ভোট পড়লেও ওইবার জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট ও বিজেপির ভোট গিয়েছিল বিএনপির জোটে। সেই হিসাবে ২০০১ সালে মাত্র ১৩ শতাংশের কম ভোট পড়ে বড় দুই দলের বলয়ের বাইরে। পরের নির্বাচনে তা কমেছে অর্ধেকের বেশি। নবম সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা চার স্বতন্ত্র ও এলডিপির একজন এমপি ছাড়া বাকি দুইশ’ ৯৫ জনই ছিলেন দুই জোটের প্রার্থী। পরিসংখ্যানে নৌকা ও ধানের শীষের বাইরে ১৭ দশমিক ৭২ শতাংশ ভোট পড়ার হিসাব দেখালেও সংসদে আসন পাওয়া জাতীয় পার্টি, জাসদ, জামায়াত, ওয়ার্কার্স পার্টি, বিজেপির মতো দলগুলো ছিল দুই দলের বলয়ে। তাদের ভোটসহ হিসাব করলে ছয় শতাংশেরও কম ভোট পড়ে দুই জোটের বাইরে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগও জোটের ভোটের রাজনীতিতে প্রবেশ করে। দুইশ’ ৭১ আসনের মধ্যে নৌকা প্রতীক পায় ৪৯ দশমিক ১৩ শতাংশ আসন। আর নৌকা প্রতীক বিজয়ী হয় দুইশ’ ৩৫ আসনে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি পায় সাত দশমিক চার শতাংশ ভোট। আসন পায় ২৭টি। দুইশ’ ৬৫ আসনে বিএনপির ধানের শীষ পায় ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট। আসন পায় ৩১টি। আর বিএনপি জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী চার দশমিক সাত শতাংশ ভোট টেনে আসন পায় দুটি।