প্রাথমিক শিক্ষা এবং শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য

379

আজ প্রাথমিক শিক্ষার বর্তমান চিত্র সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষকদের বিদ্যমান বেতন বৈষম্য নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করবো। আমরা সকলেই জানি, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছতে সক্ষম হয় না। যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। সব ধরনের শিক্ষার ভিত্তিমূল হলো প্রাথমিক শিক্ষা। মানুষ জীবনের শুরুতে এ শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। অনেকের পক্ষে এই শিক্ষা গ্রহণও সম্ভব হয় না।
প্রাথমিক শিক্ষা আনুষ্ঠানিক প্রচলন কবে থেকে চালু হয় তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এখন প্রাথমিক শিক্ষা এক যুগান্তকারী সময়ে প্রবেশ করেছে। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে এদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়। বাড়ানো হয় নানা সুযোগ সুবিধা।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি রয়েছে কে জি স্কুল, ইবতেদায়ী মাদ্রাসাসহ নানা প্রতিষ্ঠান। ভিত্তি যেমন দুর্বল বা সুদৃঢ় না হলে দালানের কাঠামো নড়বড়ে হতে পারে তেমনি জীবনের শুরুতেই প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন সঠিকভাবে না হলে পুরো শিক্ষাজীবনও সুদৃঢ় হবে না। এজন্য প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক। দেশের সব মানুষের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার রয়েছে। এরপরও অভিভাবকের সচেতনতা কাম্য। কারণ মা-বাবা বা অভিভাবক যদি সচেতন না হলে সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। জীবন হয়ে পড়ে লক্ষ্যহীন। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে সরকার। দেয়া হচ্ছে পুরো সেট নতুন বই, উপবৃত্তি, মিড ডে মিল, নানা ধরনের শিক্ষাসামগ্রীসহ অনেক কিছু। পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষকদের নতুন ও আধুনিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হচ্ছে। দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তাও নিয়োগ পেয়েছেন,পাচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে। এতকিছুর পরও প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য কোনভাবেই দূর হচ্ছেনা। বেতন বৈষম্য জিঁইয়ে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতাহীনতাকেই দুষছেন শিক্ষকরা।
সবদেশেই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাকে শিক্ষার ভিত্তিমূল ধরা হয় যা আমাদের দেশেও ব্যতিক্রম নয়। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সরকারিকরণের কারণে সারাদেশের প্রায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের আওতায় এসেছে। এবং তাতে চাকরিরত রয়েছেন লক্ষ লক্ষ শিক্ষক। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোকে ঢালাওভাবে সরকারিকরণের সাথে শিক্ষাবিদ,গবেষক সহ অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের বেতন ভাতা নতুন স্কেলে বাড়ানো হয়। প্রধান শিক্ষকদের দেওয়া হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা। সহকারি শিক্ষকদের তৃতীয়তেই রাখা হয়েছে। মূলত: নতুন বেতন স্কেলের মাধ্যমে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে শিক্ষকদের মাঝে চরম বেতন বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়েছে বলে মনে করেন প্রাথমিক শিক্ষকগণ। প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষকদের মধ্যে স্কেলের তফাৎ বিস্তর। আগে যেখানে সহকারি শিক্ষকগণ প্রধান শিক্ষকদের পরের ধাপে বেতন পেতেন সেখানে বর্তমানে ব্যবধান হয়েছে তিনগুণ যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। বেতন বৈষম্য কমানোর জন্য নানা চেষ্টা তদবির করেছেন সহকারী শিক্ষক সংগঠনগুলো। শহীদ মিনারে দেশের হাজার হাজার প্রাথমিক সহকারি শিক্ষক তাদের কর্মসূচি পালন করেছেন। করেছেন আমরণ অনশনও। মাননীয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীর পর্যায়ক্রমে বেতন স্কেল নির্ধারণের আশ্বাসে অনশন ভঙ্গ করলেও কাঙ্ক্ষিত কোন অগ্রগতি হয়নি। অতি স¤প্রতি এই বেতন বৈষম্যের প্রতিবাদে আবারো প্রাথমিক শিক্ষকরা (প্রধান ও সহকারি যৌথভাবে) ধারাবাহিক কর্মসূচীর পর ঢাকায় শহীদ মিনারে মহাসমাবেশ করতে চাইলেও সেখানে তাদেরকে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি।উল্টো পুলিশ লাঠিচার্জ করে। আহত হন বেশকিছু শিক্ষক।কিন্তু কর্তৃপক্ষের বোধোদয়তো হয়ইনি তার উপর বেতন স্কেল আরো নীচে নামিয়ে প্রধান শিক্ষকদের ১১ তম ও সহকারি শিক্ষকদের ১৩ তম গ্রেড প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যেখানে শিক্ষকদের দাবি ছিল প্রধান শিক্ষকদের ১০ ম ও সহকারী শিক্ষকদের ১১ তম গ্রেড প্রদান করার। কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি শিক্ষকনেতা ও সংগঠনের অনৈক্য এবং দালালি-দলাদলিও বৈষম্যের ক্ষেত্রে কম দায়ী নয়! স্কেলে বেতন বৈষম্য কোনভাবেই যুক্তিসঙ্গত হয়নি। যোগ্যতাভিত্তিক স্কেল প্রদান করা হলে এ ধরনের বৈষম্য থাকতো না।
কারণ, বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিতরা আসছেন সেটা প্রধান শিক্ষক হোক আর সহকারী শিক্ষক হোক। এ ধরনের বৈষম্য বজায় থাকলে প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় তারা আগ্রহ হারাবে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেতন বৈষম্য একটি বড় বিষয়। এক সময় শিক্ষক নেতা ও সংগঠনে বিভেদ ছিল না। শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিরসনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রধান শিক্ষকদের ১০ ম ও সহকারি শিক্ষকদের ১১ তম স্কেলে বেতন নির্ধারণের শিক্ষকদের দাবি অবিলম্বে মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাই। আর কত উপযুক্ত সম্মানী থেকে শিক্ষকদের বঞ্চিত করা হবে?
এদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পুরোনো পদ্ধতির ক্লাশ রুটিন (যাতে বিরতিহীনভাবে ক্লাশ নিতে হয় শিক্ষকদের), বার্ষিক ছুটির তালিকা (যেখানে জাতীয় দিবসগুলোও সংযুক্ত) সহ নানা বিষয়ে অসামাঞ্জস্য বিদ্যমান রয়ে গেছে। এসব সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্য ধরে রাখতে হলে বিজ্ঞানসম্মত ক্লাশ রুটিন প্রণয়ন, শর্তহীন শতভাগ উপবৃত্তি প্রদানের পাশাপাশি শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিরসন করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রদান করা সময়ের দাবি। হতাশা আর মানসিক কষ্টে যেন শিক্ষকগণ আর না ভোগেন সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

লেখক : শিক্ষক