প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সহশিক্ষা কার্যাবলীর ভূমিকা

1432

আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ প্রাথমিক শিক্ষার সাথে জড়িত। ৫ থেকে ১০ বছরের এসব কচিমুখের শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কর্ণধার। এরাই আমাদের আলোর দিশারী। নতুনের আবাহনে এরাই সুন্দরের ধ্বজাধারী। প্রাক প্রাথমিক থেকে শুরু হয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে গিয়ে শেষ হওয়াএই শিক্ষাক্রমের ধারাবাহিকতায় সুনিপুণভাবে সন্নিবেশ করা আছে পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন। শিশুর বয়স, মেধা বয়স, অভিরুচির উপর ভিত্তি করে বিশেষজ্ঞ গবেষক দ্বারা তৈরী এসব শিক্ষা নীতি পাঠক্রম সন্নিবেশিত। শিশু শিক্ষার্থী সহজেই মুগ্ধ হতে পারে সে মত সাজানো আছে ধাপে ধাপে। আকর্ষণীয় এবং সহজ বোধ্য এসব পাঠ্যক্রম শিশু শিক্ষার্থীদের নান্দনিক মানস গঠনে মুখ্য ভ‚মিকা পালন করে। বয়সের ধাপে ধাপে তাদের শেখা পছন্দ ও রুচির পরিবর্তন ঘটে। এটা বিশেষভাবে মাথায় রেখে সাজানো এর প্রতিটি ধাপ।
শিক্ষা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। অশিক্ষিত ব্যাক্তি মাত্রই সমাজের জন্য বোঝা স্বরুপ। শিক্ষা ছাড়া একটি জাতির উন্নতি কল্পনা ও করা যায় না। একটি জাতিকে উন্নতির ক্রম বর্ধমান পথে ধাবিত হতে গেলে ও ছুড়ায় পৌঁছাতে হলে শিক্ষা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তবে জাতীয় উন্নয়নের জন্য সবছেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ হলো প্রাথমিক শিক্ষা। একটা ভাল বীজ থেকেই সম্ভব একটা গাছ মহীরুহ হয়ে উঠা, তেমনি মান সম্মত প্রাথমিক শিক্ষা জাতীর ভবিষ্যৎ গঠন ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। প্রাথমিক শিক্ষাই হলো শিক্ষা ব্যাবস্থার বীজ।
গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ১৫ (ক) অনুচ্ছেদে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে মৌলিক জীবন ধারণের উপকরণ হিসেবে নির্ধারন করা হয়েছে। এছড়া ১৭ (ক), (খ) ও (গ) অনুচ্ছেদে বালক বালিকাদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাসহ নিরক্ষরতার দূরীকরণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে। এজন্য ১৯৯২ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয় এবং সরকার প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তিসহ নানা ধরনের উৎসাহমূলক পদ্ধ্বতি গ্রহণ করে। এছাড়া শিক্ষাকে এখন প্রতিটি মানুষের দোর গোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য নানা ধরনের সংগঠনসহ বিদেশি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
কোন বিষয়কে ভালভাবে জানা, বোঝার জন্য আমরা তাত্বিক শিক্ষাকে যতটা গুরুত্ব দিয়ে থাকি সহশিক্ষাকে ততটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করিনা। অথচ শিশুর প্রতিভা, ব্যাক্তিত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি, দক্ষতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা বিকাশে সহশিক্ষা মূক কার্যক্রম সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে। শিশু শিক্ষার পারম্ভিক স্তর হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ কারনে পাঠ্যসূচির বিষয় ভিত্তিক শিখন কার্যক্রমের পাশাপাশি সহশিক্ষাকেও সমভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ, তাঁর মেধা, মনন ও তাঁর সৃষ্টিশীলতার প্রকাশের জন্য সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম উল্ল্যেখযোগ্য ভ‚মিকা পালন করে। এ কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকল প্রকার সহশিক্ষা কার্যাবলীর অনুশীলন করার জন্য আমাদের সবাইকে আন্তরিক ভাবে কাজ করতে হবে। তাহলেই বিদ্যালয় গুলো হয়ে উঠবে মানবিকগুনাবলী সমৃদ্ধ মানব শিশু তৈরীর কারখানা।
একজন বিশিষ্ট মনীষী ম্যারকন বলেছেন- অ ংপযড়ড়ষ ড়হষু রিঃয বীঃৎধপঁৎৎরপঁষধৎ ধপঃরারঃরবং ড়িঁষফ নব ধং ধনংঁৎফ ধং ধ ংপযড়ড়ষ রিঃযড়ঁঃ ঃযবস. অর্থাৎ সহশিক্ষাক্রমিক কার্যাবলী ছাড়া যে কোন বিদ্যালয়ই অবান্তর। আমাদের একথা মনে রাখতে হবে সহশিক্ষা ক্রমিক কার্যাবলীকে বাদ দিয়ে শিক্ষার উদ্দেশ্য সফল হতে পারেনা। কেননা সহশিক্ষামূলক কার্যাবলী প্রচলিত বিষয় ভিত্তিক পাঠ্যক্রমের পরিপুরক হিসেবে কাজ করে।
নিন্মে বিভিন্ন সহশিক্ষামূলক কার্যাবলীর বর্ণনা দেওয়া হল ঃ ১। খেলাধুলা ও শরীর বৃত্তিয় কর্মকাÐ ঃ সকল প্রকার খেলাধুলা যেমন- ফুটবল, সাঁতার কাটা, হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, কেরাম, লুডু ইত্যাদি, তাছাড়া এথলেটিকস জিমনেসটিকস ইত্যাদির আয়োজন করা। ২। সাহিত্য বিষয়ক কর্মকান্ডঃ কবিতা আবৃতি, গল্প বলা, রচনা প্রতিযোগীতা, উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগীতা, নাটক, দেয়ালিকা, ম্যাগাজিন প্রকাশনা ইত্যাদির আয়োজন করা। ৩। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড- সকল প্রকার সংগীত, গান বাজনা, নাচ, কমোডি, অভিনয়, বিচিত্রা অনুষ্ঠান ম্যাগাজিন শো ইত্যাদির আয়োজন করা। ৪। শিক্ষা সফর ও পিকনিক- নিয়মিত শিক্ষা সফরের আয়োজন, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান ভ্রমণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়, দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং মনের অনুসন্ধিতসু ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাই বলা হয়ে থাকে, ‘ঔড়ঁৎহবু রং ঃযব ঢ়ধৎঃ ড়ভ বফঁপধঃরড়হ ড়ভ ড়ঁৎ ষরভব.’
৫। ধর্মীয়, সামাজিক ও জাতীয় দিবস উদ্যাপন- বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সেসব দিবসের তাতপর্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে উপলব্দি করতে পারে। ৬। শিক্ষামূলক র‌্যালি- শিক্ষামূলক গানের মাধ্যমে ব্যানার ফেস্টুন প্ল্যাকার্ড বহন করে যেকোন কর্মসুচী বা শিক্ষা সপ্তাহ পালন করা। এতে গনসচেতনতার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা নিজেরাও সমৃদ্ধ হতে পারে। ৭। ফুল ও ফলের বাগান, বৃক্ষ রোপন ও কৃষিকাজঃ শিক্ষার্থীদের সাথে মিলেমিশে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফুল ও ফলের বাগান, ফলজ, বনজ, ঔষধী গাছের চারা রোপনের পাশাপাশি সব্জী চাষ, গাছের পরিচর্যা, আগাছা পরিস্কার, গাছের যতœ ইত্যাদি কাজের অভ্যাস ভবিষ্যৎ জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ৮। চারু ও কারুকলার চর্চা- শিশুদের নান্দনিক বিকাশের জন্য চারু ও কারুকলা বিশেষ ভ‚মিকা রাখে। চিত্রাংকন, ছবি আঁকা, নকশা, ভাস্কর্য, আলপনা, এবং মাটি, কাঠ, বাঁশ, দড়ি, তুলা, বেত, শষ্যসহ খেজুর, তাল, নারিকেলের পাতা ইত্যাদি ব্যাবহারের বিভিন্ন শিল্প কর্ম তৈরী করতে পারে।
সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীর উদ্দেশ্য ঃ ১। শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ ঃ- প্রত্যেক শিশুর মধ্যে জন্মগতভাবে কিছু প্রবনতা থাকে। উন্নত বিশ্বে শিশুর প্রবনতা গুলো গভীরভাবে প্রর্যবেক্ষনের মাধ্যমে তাঁর জন্য উপযোগী শিক্ষা ব্যাবস্থা করে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। কিন্তু একজন শিক্ষক ইচ্ছা করলে শিশুর প্রবনতা গুলো কাজিয়ে লাগিয়ে শিশুর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে। যদি শিক্ষক-শিক্ষক সহপাঠ্যক্রমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করে থাকেন, তাহলে শিশুরা সত্যিকারের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠবে। ২। আত্ম বিশ্বাস গঠন ঃ- সহপাঠ্যক্রমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর আত্ম বিশ্বাস জাগিয়ে তোলা যায়। আর এই আত্ম বিশ্বাসেরব মাধ্যমে আসে আত্মনির্ভরশীলতা। শিশুরা গৃহে সাধারণত মাতার উপর নির্ভরশীল থাকে। বিদ্যালয়ে এসেও তারা যদি শিক্ষকদের উপর নির্ভরশীল থাকে তবে তারা ভবিষ্যতে সার্থক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারবেনা। তাই বিদ্যালয়ের সহশিক্ষা ক্রমিক কার্যাবলীর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে। ৩। পাঠের একঘেয়েমি দুরীকরণ- সহপাঠ্য ক্রমিক কাজের মাধ্যমে শিশুর শিক্ষার মধ্যে বৈচিত্র আসে।
ফলে তাঁর পড়ালেখার একঘেয়েমি দূর হয় এবং তাঁর বিদ্যালয়ের প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত হয়।৪। শৃংখলা স্থাপন- সহশিক্ষামূলক কার্যাবলী সঠিক ভাবে পরিচালিত করতে পারলে বিদ্যালয়ের শৃংখলা রক্ষা করা যায়। খেলার মাঠের নিয়ম-কানুন, বিভিন্ন সভার নিয়ম-কানুন বা এরূপ অন্যন্য অনুষ্ঠানের নিয়ম-কানুন অনুশীলনের মাধ্যমে শিশুরা স্বতস্ফুর্তভাবে শৃংখলার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ৫। দৈহিক ও মানসিক বিকাশ- সহপাঠ্যক্রমিক কাজের মাধ্যমে শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশ সাধিত হয়।
বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চালিত হয়। ফলে শিশুর দোইহিক বিকাশ পূর্ণতা লাভ করে আবার বক্তৃতা, বিতর্ক ইত্যাদির মাধ্যমে শিশুর মানসিক বিকাশ পুর্ণতা লাভ করে।
সররোপরি বলা যায়, সফল ও স্বার্থক মানব জীবন গঠনে সহশিক্ষামূলক কার্যাবলী গুরুত্ত¡পূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। “হাওয়া খেলে যেমন পেট ভরেনা, কিন্তু খাদ্য হজমের জন্য হাওয়ার প্রয়োজন।“ ঠিক তেমনি শিক্ষাকে প্রকৃতভাবে অর্জন এবং জীবন উপযোগী করতে হলে সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম বড়ই দরকার। এ কারণে প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা ও জীবন মান গঠনে তাত্তি¡ক শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষাক্রমিক জ্ঞান প্রদান করা আবশ্যক এ লক্ষ্যেই সকলের কাজ করা উচিত।

লেখক : সহকারী শিক্ষক, হাটহাজারী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।