প্রাথমিক শিক্ষক বদলী এই প্রসঙ্গে কিছু কথা

155

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক বদলীর ব্যাপারে সরকার সময়ে সময়ে বিভিন্ন নীতিমালা তৈরী করে থাকে। গত তিন চার বছর যাবৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলীর ক্ষেত্রে জানুয়ারী মাস থেকে শুরু করে মার্চ মাস পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থাৎ সরকার ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী, পুরো বছরে মধ্যে জানুয়ারী থেকে মার্চ মাসে কোন শিক্ষক বদলী হতে পারবে। এখন কথা হচ্ছে, চাকুরীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন অবস্থার সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় ভালো কাজে অনেক শত্রু সৃষ্টি হয়। তাই নিজের নিরাপত্তার জন্যে দ্রুততার সাথে তাৎক্ষণিক বদলীর প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু বর্তমান বদলীর নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিবছর জানুয়ারী থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বিদ্যালয় পরিবর্তনের কথা উল্লেখ থাকলেও বিভিন্ন প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারনে শিক্ষকদের শুধু মার্চ মাসে বদলী করা হয়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া উপজেলা ভিত্তিক। অর্থাৎ যে উপজেলায় স্থায়ী বাসিন্দা সেই উপজেলায় নিয়োগ দেয়া হয়। তাই একই উপজেলায় কোন শিক্ষকের বদলীর বিষয়ে কোন জটিলতা নেই, যে রূপ আন্তঃ উপজেলা বা জেলা বদলীতে জটিলতা দেখা দেয়।
জানামতে বাংলাদেশের এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে একটিও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। ইতোপূর্বেকার কমিউনিটি, বেসরকারি, রেজিষ্টার্ড সহ বিভিন্ন টাইপের বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণ বা সরকারি হওয়ায়, এখন অধিকাংশ শিক্ষকের বাসস্থান হতে এক কিলোমিটারের মধ্যে ২/৩টি বিদ্যালয় রয়েছে। এই অবস্থায় যে কোন বিদ্যালয়ে বদলীতে কোন শিক্ষকের যাতায়তের ব্যাপারে সমস্যা হবার কথা নয়। সাধারণত কোন বিদ্যালয়ের কোন শিক্ষককে বদলী করা হয়, শিক্ষকের আবেদনের প্রেক্ষিতে। এছাড়া জনস্বার্থে ও প্রশাসনিক বদলীর ব্যবস্থা আছে। তবে এখানে প্রায় সব বদলী ‘আবেদন’ এর প্রেক্ষিতে হয় বলে অধিকাংশ শিক্ষক নিজ এলাকায় বা সুবিধাজনক স্কুলে বদলী হয়ে যুগ যুগ ধরে অবস্থান করে আসছে।
আবার শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাতে দেখা যায়, কিছু বিদ্যালয়ে ৫০/৬০ জন শিক্ষার্থীর জন্যে রয়েছে ৫/৬ জন শিক্ষক। একই ভাবে আবার দেখা যায় ৫০০/৬০০ শিক্ষার্থীর জন্যে সমসংখ্যক শিক্ষক। কিংবা ১০০ ছাত্রছাত্রীর জন্যে ১০ জন শিক্ষকশিক্ষিকা, আবার ১০০০ জন ছাত্রছাত্রীর জন্যে ১০ শিক্ষকশিক্ষিকা কর্মরত আছে। তাই জনস্বার্থে প্রতি দুই তিন বছর অন্তর উপজেলার অভ্যন্তরে বিদ্যালয় ভিত্তিক ছাত্রছাত্রীর অনুপাতে শিক্ষক সমন্বয় করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য যদিও এই বছর নবজাতীয়করণ হওয়া বিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে নিকটবর্তী আগের পুরানো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুইজন করে শিক্ষক পারস্পরিক বদলীর কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যা সার্বিক সমন্বয়ে সাথে সামঞ্জস্য নয়। শিক্ষকদের মধ্যে সার্বিক সমন্বয় না হলে মানসম্মত সুষম শিক্ষা অর্জিত হবে না।
কারণ এখানে দেখা যায়, বহু বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক দীর্ঘদিন কর্মরত থাকার ফলে ঐ শিক্ষকের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের জড়তা ও জটিলতা সৃষ্টি হয়। অথচ মাঠ পর্যায়ে এমনও শিক্ষককে গৌরবের সাথে বলতে শুনা যায়, আমি এই স্কুলে ২৫ বা ৩০ বছর যাবৎ শিক্ষকতা করে আসছি। আবার সগৌরবে অনেক শিক্ষক বলছেন আমি যে বিদ্যালয়ে প্রথম যোগদান করেছি, সেই বিদ্যালয় হতে অবসর গ্রহণ করেছি। আবার এমনও দেখা যায়, যে বিদ্যালয়ে দীর্ঘ ২০/২৫ বছর সহকারি শিক্ষক পদে চাকুরী করেছে, সেই বিদ্যালয়েই প্রধানশিক্ষকের প্রমোশন নিয়ে তদ্বির করে থেকে গেছে। অর্থাৎ যে স্কুলে আজকের দিন পর্যন্ত সহকারি শিক্ষক ছিল, আবার সেই স্কুলে পরের দিন হয়ে গেল প্রধান শিক্ষক। এতে করে বিদ্যালয় পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
এখানে উল্লেখ করতে হয়, কোন শিক্ষক একই বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন থাকার ফলে স্বাভাবিক ভাবে একটা জড়তা, নিষ্ক্রিয়তা, যেমন পরিলক্ষিত হয় একই সাথে স্বৈরতান্ত্রিকতাও চলে আসে। অনেক সময় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়, কোন শিক্ষক একই স্কুলে বছরের পর বছর থাকার ফলে এলাকার সর্বসাধারণের সাথে আত্নীয়তার বন্ধনের মত সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে উঠে। আবার দেখা যায় দীর্ঘদিন একই বিদ্যালয়ে থাকার ফলে এলাকার অধিকাংশ মানুষ সম্মানিত শিক্ষকের ছাত্রছাত্রী, যারা এসএমসি সহ বিভিন্ন কমিটিতে সদস্য হিসাবে অন্তর্ভূক্ত। তাই এলাকার মুরুব্বী শিক্ষক হওয়াতে অন্যায় অনিয়ম সহ যেকোন ধরনের শৃঙ্খলা বর্হিভুত কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট হলেও কেউ বলার থাকেনা। এতে করে বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। যেমন- শিক্ষকের আগমন প্রস্থান সময়মত ঘটেনা, শিক্ষার্থীর শিখনশিখানো কার্যক্রম সফল হয়না। সহকারি শিক্ষক যদি দীর্ঘদিন একই বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকে, তাহলে প্রধান শিক্ষকের বিভিন্ন কাজে বাধা সৃষ্টি করে, নিজেই প্রধান শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে সচেষ্টা হয়। যারফলে বিদ্যালয়ে সার্বিক ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে পড়ে।
এই যে বিষয়গুলো উপস্থাপন করলাম, তা কিন্তু দৃশ্যমান ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। এইজাতীয় বাস্তব বহু ঘটনার আমিই নিরব স্বাক্ষী। এই অবস্থায় আমার চিন্তাশীল প্রস্তাব বা পরামর্শ হচ্ছে, শিক্ষক কোন বিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ৫ বছর হলে ঐ শিক্ষককে জনস্বার্থে দ্রুততম সময়ে নিকটতম বিদ্যালয়ে বাধ্যতামুলক বদলীর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
তাই আমার প্রত্যাশা থাকবে, ব্যক্তিস্বার্থে নয় জনস্বার্থে কর্তৃপক্ষ উল্লেখিত পরামর্শ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন। আগামীতে এই ধরণের বদলীর নীতিমালা প্রণয়নে দীর্ঘসময় ধরে বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা বিষয়টি গুরুত্ব দিবেন। একই সাথে বর্তমানে চলমান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নবজাতীয়কৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে শিক্ষক সমন্বয় বিষয়টিতে, সর্বজুনিয়র শিক্ষককে নিকটবর্তী বিদ্যালয়ে প্রেরণ না করে, দীর্ঘদিন কর্মরত শিক্ষককে ঐ বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে বদলীর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।