প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রদত্ত ছুটির তালিকা পর্যালোচনা

440

প্রতি বছর সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ছুটির তালিকা প্রকাশের পর, সবশেষে জানুয়ারিতে এসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্যে, বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্যে ছুটির তালিকা অনুমোদিত হয়ে প্রকাশিত হয়ে থাকে। চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের চাকুরী ভেকেশন ডিপার্টমেন্ট হিসাবে অন্তর্ভূক্ত, অথচ ছুটির দিকে তাকালে সম্পূর্ণ বিপরীত, যা নন ভেকেশন ডিপার্টমেন্ট থেকেও কম ছুটি পেয়ে থাকে এবং ভোগ করে থাকে। এই বিষয়ে গত ’১৬ সালে একাধিক দৈনিক পত্রিকায়, গাণিতিক হিসাবের মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছি, যেখানে অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের সরকারি কর্মচারী বছরে ছুটি ভোগ করে ১৩৫ দিন, অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ছুটি ভোগ করে ১১৮ দিন। ঐ সময়ের হিসাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বছরে ১৭ দিন ছুটি কম পেয়েও ভেকেশন চাকুরী হিসাবে অন্তর্ভূক্ত। সেই দিনের সেই হিসাব তো গেলো, এবার দেখা যাক, যেই পরিমাণ ছুটি প্রাপ্য, তা ভোগ করার অধিকার বা ভোগ করতে পারে কিনা!
প্রতি বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছুটির তালিকায় দেখা যায়, শুক্রবার ব্যতীত ৭৫ দিন ছুটি নির্ধারিত থাকে। এবার এই ৭৫ দিন ছুটির তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যাক, বাস্তবক্ষেত্রে শিক্ষক শিক্ষার্থী কত দিন ছুটি পেয়ে থাকে আর কত দিন ছুটি ভোগ করে থাকে।
এই বিষয়ে পর্যালোচনার জন্যে সদ্য সমাপ্ত ’১৮ সালকে ধর্তব্য হিসাবে নিলাম। ঐ বছর (২০১৮ সাল) যে সকল জাতীয় দিবস পালিত হয় সেই গুলোর মধ্যে ২১ ফেব্রæয়ারী জাতীয় শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ, ১৭ এপ্রিল জাতির জনকের জন্মদিন, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। এই ছয়দিন প্রতিবছরের মত, গত বছরেও বিদ্যালয়ে জাতীয় দিবস হিসাবে পালন করা হয়।
জাতীয় দিবস আমাদের জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতীক। এই সকল দিবস বিদ্যালয়ে পালনের ফলে শিক্ষার্থীদের শৈশব কৈশোর কাল থেকে দেশপ্রেম জাগ্রত হবার পাশাপাশি, রাষ্ট্রীয় ইতিহাস সম্পর্কে জানার সুযোগ থাকে। এই বিষয়ে আমার অভিমত, যেহেতু দিনব্যাপী বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠান পালন করতে হয়, সেহেতু ছুটির তালিকায় ছুটি (বন্ধ) হিসাবে না রেখে কর্মদিবস বা খোলার দিন হিসাবে গন্য করা সমীচীন। অথবা জাতীয় দিবস যথাযথ মর্যাদায় পূর্ণদিন পালন করে, পরেরদিন ছুটি ঘোষণা করলে এতে শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে আরো বেশী উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে আবেদন সৃষ্টি হত বলে আমার বিশ্বাস।
যাইহোক, এই তো গেল ছয় জাতীয় দিবস পালনের কথা। যা ছুটির তালিকায় ছুটি হিসাবে অর্ন্তভূক্ত। এরপর এই বছর (২০১৮ সাল) দেখা যায়, হঠাৎ করে ২১ নভেম্বর বুধবার বিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম বারের মত ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সাঃ) পালনের ঘোষনা আসে, চিঠি প্রদান করা হয়। সেই হিসাবে সেই দিনও যথাযথ মর্যাদায় ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যতার মধ্যে দিয়ে পালন করার ফলে, ৭৫ দিন ছুটির তালিকা থেকে বাদ পড়ে আরো একদিন ছুটি।
আবার একই বছর রমজান মাসের ছুটিতে সাবক্লাস্টার আয়োজন করা হয়। যার কারনে সাড়াদেশে বন্ধের মধ্যে সকল শিক্ষককে কমপক্ষে একদিন বিদ্যালয়ে আসতে হয়। কমপক্ষে বলছি এইজন্যে, সাবক্লাস্টারের সাথে যারা সরাসরি সম্পৃক্ত, যেমন- সহপ্রশিক্ষকের দায়িত্বে থাকা কিংবা যাদের বিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয়, তাদেরকে কয়েকদিন বিদ্যালয়ে বা অফিসে আসতে হয়েছে। এই দিনটি বা দিনগুলো সেই ৭৫ দিন ছুটির তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়।
আবার ৩০ ডিসেম্বর দেশব্যাপী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে প্রায় সকল বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্র আর প্রায় সকল শিক্ষক ভোট গ্রহন কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োজিত থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। আর সেই কারনে আরো একদিন ছুটি, সেই ৭৫ দিন তালিকা থেকে বাদ পড়ে।
অন্যদিকে ১৩ এপ্রিল চৈত্র সংক্রান্তি, অনুমোদিত তালিকায় ভুলবশতঃ বা সচেতনতার অভাবে ‘শুক্রবার’ দিন বন্ধে অর্ন্তভূক্ত করা হয় যা প্রতিবছর এরকম একই ভুল হয়ে থাকে। অথচ ছুটির তালিকায় বিঃদ্রঃ দিয়ে উল্লেখ আছে, শুক্রবার ব্যতীত এই ছুটি হিসাব করা হয়েছে। সেই হিসাবে এই একদিনও ’১৮ সালের ৭৫ দিনের তালিকা থেকে বাদ যায়। আবার ’১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর বুধবার ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম ছিল। তাই ছুটির তালিকায় বন্ধ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু দুইদিন আগে বলা হয়, সকাল সাতটায় চট্টগ্রাম এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে শিক্ষকদের উপস্থিত থাকতে হবে কারণ আন্তবিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্ণামেন্ট অনুষ্ঠিত হবে। উল্লেখ্য এখানে উপস্থিত বাধ্যতামূলক এবং হাজিরা বা স্বাক্ষর নিয়ে উপস্থিত নিশ্চিত করা হয়। যদিও নিজ উপজেলা বা জেলার কোন শিক্ষার্থীর দল ছিল না, তারপরেও আসতে বাধ্য করা হয়। তার মানে আরো একটি ছুটি শেষ হল।
এখানে শেষ নয়, দূর্গাপূজার মহা অষ্টমী ১৭ অক্টোবর, ছুটির তালিকায় স্কুল সপ্তমীদিন থেকে বন্ধ। এর সপ্তাহ খানেক আগে চিঠি আসে উপজেলা পর্যায়ে প্রথম বারের মত ‘বিজয়ফুল’ উৎসব চুড়ান্ত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। যদিও অনুষ্ঠানের আগের দিন বিকাল বেলায় এক বিজ্ঞপ্তিতে এই প্রতিযোগিতা পিছিয়ে নেয়া হয়, তথাপি বিদ্যালয় আগে থেকে বন্ধের কারণে অনেকে বা অধিকাংশ শিক্ষক খবর না পাওয়ার দরুন, শিক্ষার্থীদের নিয়ে উপজেলায় এসে ফিরে যেতে হয়। তার মানে তাদের আরো একটি ছুটি নাই।
এই বছর (’১৮ সাল) ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস ছিল শুক্রবার। বিদ্যালয়ে পর্যায়ে সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে নিয়ে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে শিক্ষকদের উপস্থিত থাকতে হয়েছে। শত চেষ্টা করেও অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিত নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি, তবে শিক্ষক উপস্থিতি শতভাগ নিশ্চিত করতে হয়।
এছাড়া বিভিন্ন বছর প্রধান শিক্ষকের হাতে সংরক্ষিত ছুটি থাকে কখনো একদিন, কখনো দুইদিন কিংবা তিনদিন। প্রধান শিক্ষকের হাতে সংরক্ষিত এই ছুটি, সংরক্ষণ করেন শিক্ষা কর্মকর্তা। সেই হিসাবে এই ছুটি গ্রহনের জটিলতার কারনে, ঐ ৭৫ দিন থেকে আরো ২/৩ দিন ছুটি বাদ পড়ে যায়। উল্লেখ্য ’১৮ সালে প্রথম প্রকাশিত তালিকায় প্রধানশিক্ষকের হাতে সংরক্ষিত ছুটি ছিল ১ দিন, পরে আবার বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রদত্ত ক্যালেন্ডারে এ ছুটি দুই দিন করা হয়।
এই সকল দিনগুলো ছাড়াও বিভিন্ন সময় বন্ধ বা ছুটির দিনে, হঠাৎ-হঠাৎ তাৎক্ষনিক তথ্য চাওয়ার ফলে, বন্ধের দিনেও বিদ্যালয়ে কিংবা শিক্ষা অফিসে ছুটে আসতে হয়। আবার রমজান মাসে দীর্ঘ সময় বিদ্যালয় বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীর মধ্যে শিক্ষার বিচ্যুতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। তাই এই সময় অনেক শিক্ষককে, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্তৃক কোচিং করতে বাধ্য করা হয়। কিংবা বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ১০ বা ১৫ দিন কোচিং করানো রেওয়াজে পরিণত হয়ে অলিখিত নিয়ম হিসাবে চলে আসছে। যার ফলে বিদ্যালয়ে আসতে হয়েছে। এই হচ্ছে ’১৮ সালের প্রদত্ত ছুটির তালিকা থেকে বাদ পড়া ছুটির হিসাব। আর একই ভাবে প্রতি বছর আরো কত ধরনের কত রকমের বিষয়ের জন্যে কত ছুটি বাদ পড়ে তার ইয়ত্তা নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রদর্শিত বা নির্ধারিত ৭৫ দিন ছুটি থেকে এত সব ছুটি বাদ দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা কি অর্জিত হয়েছে? মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের জন্যে প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্যে যে আটটি বিকাশের কথা বলা হয়েছে, যেমন- শারীরিক বিকাশ, মানসিক বিকাশ, সামাজিক বিকাশ, আধ্যাত্বিক বিকাশ, আবেগিক বিকাশ, নৈতিক বিকাশ, নান্দনিক বিকাশ, মানবিক বিকাশ এই গুলোর আলোকে চিন্তা করতে হবে। কারণ শিশুকে দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ে অবস্থান করানো ও কম ছুটি (বন্ধ) দেওয়া মানে উল্লেখিত বিকাশ সমূহের পরিপন্থী। আবার বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন মানে শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে বাধ্য করানো নয়, শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও প্রেষণা সৃষ্টির মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে নির্দ্দিষ্টস্তর পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহনে বাধ্য করা। পরিশেষে বলতে চাই, সবার জন্যে মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে মনস্তাত্বিক দিক সহ বহুমুখী পরিকল্পনা করতে হবে। যার মধ্যে আজকের আমার এই লেখার বিষয়বস্তু একটি।