‘প্রাণের উৎসবে মাতি উল্লাসে’

62

২২ নভেম্বর, ২০১৯ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এলামনাই আমাদের জন্য একটি সুন্দর ও আনন্দঘন দিন। এই দিনটিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ ও নবীন ছাত্র/ছাত্রীদের মধ্যে ঘটবে মহামিলন। প্রাণের আনন্দ ছড়িয়ে পড়বে চারিদিকে। এক অদৃশ্য মায়ারটানে সকলে একত্রিত হতে যাচ্ছে। যেদিন থেকে এলামনাই অনুষ্ঠানের ঘোষণা করা হয় ঠিক সেই দিন থেকে চারিদিকে আনন্দের জোয়ার ভেসেযায়। প্রতিটি ব্যাচের ও বিভাগের শিক্ষার্থীরা অন্যের আনন্দের সাথে নিজের আনন্দকে ভাগাভাগি করে নিতে দিন দিন প্রস্তুতি নিয়েছে। এই আনন্দ অতীতকে ফিরে পাওয়ার, এই আনন্দ শৈশবের গন্ডি পেড়িয়ে যৌবনের জয়গানের স্মৃতি রোমান্থন করার, এই আনন্দ জীবনের সব সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে হাসি-মুখে বরণ করে নেওয়ার এবং এই আনন্দের রেশটুকু আমাদেরকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়। যেন একটি শিকড়ের (চ/বি) টানে সকল শিক্ষার্থীরা তাদের আপন জনকে কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। এই ব্যাকুলতা তাদের কর্মব্যস্ত জীবনের সকল চাওয়া-পাওয়াকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাই তো শত ব্যস্ততা ও বাধা-বিপত্তিকে তুচ্ছ করে সকলেই এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় পাতায় এলামনাইয়ের সংবাদ প্রচার ও সামাজিক যোগাযোগ (২২ নভেম্বর) মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রীদের মাঝে আবেগ সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই দিনটিকে ঘিরে চলেছে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা। এই আনন্দের জোয়ার শুধুমাত্র চট্টগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চবি এর শিক্ষার্থীরা স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে প্রতিদিন নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে।

চট্টগ্রামে অবস্থিত চারুকলা ইনস্টিটিউটে এই নিবন্ধন প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে এই ইনস্টিটিউটে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে নিবন্ধনের জন্য আগত প্রাক্তণ শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে সরব থাকে। এই একটি জায়গাতে সবাই সবার অবস্থান ভুলে যায়। আমরা জানি চবি এর শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশে এদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রতিটি অঞ্চলের সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগীতা মূলক কর্মে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে। আমাদের এই গর্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বীয় যোগ্যতায় দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছে। ব্যাংক, বীমা, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থেকে এদেশের উন্নয়নে কাজ করে চলছে। কিন্তু এই চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে তারা যেন আবার এক একজন শিক্ষার্থীতে পরিণত হয়েছে। যেন চবি এর সেই উচ্ছল চঞ্চল শিক্ষার্থী। যেদিন আমি চারুকলা ইনস্টিটিউটে নিবন্ধনের জন্য যাই সেদিনটি ছিল কেমন যেন আনন্দের একটি দিন। সকাল থেকেই একটি অনুভূতি কাজ করছিল। আবার চবি এর সেই দিনের কথাগুলো বার বার মনে পড়ছিল। ছোট ছোট স্মৃতিগুলো মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছিল। মনে হচ্ছে আমার আশ-পাশে আমার সহ-পাঠিরা বিচরণ করছে। একটি একটি স্মৃতির সাথে এক একটি অনুভূতি আমাকে বার বার সেইদিন গুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই সকাল থেকে আনন্দ মুহূর্তগুলো মনের মধ্যে শিহরণ জাগিয়ে তুলছিল। সন্ধ্যার পর যখন যাত্রা করি তখনও খুব খুব ভাল লাগছিল। অবশেষে যখন চারুকলা ইনস্টিটিউটে পৌঁছলাম ও নিবন্ধন কক্ষের দিকে এগোতে থাকলাম তখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সেই ১ম দিনটিরমতই লাগছিল। চবি এর ভর্তি ফরম পূরণেরমতই সেই আনন্দ টুকু সাথে নিয়ে নিবন্ধনের জন্য এক একটি সিঁড়ি ভেঙ্গে এগোতে থাকি। ইনস্টিটিউটের সিঁড়ির এক একটি ধাপকে চবি এর ফ্যাকাল্টির সামনের সিঁড়িগুলোর সাথে মিলিয়ে ফেলছিলাম। এরপর যখন অফিস কক্ষটির সন্ধান নিচ্ছিলাম তখনও অনুভব করছিলাম, চবি তে ভর্তি হওয়ার সেই দিনটির মত এক এক পা করে এগিয়ে যাওয়ার আনন্দ। ভর্তির সেই দিনটি যেমন ফ্যাকালটির অফিস কক্ষে এসে উপস্থিত হই ঠিক তেমনি নিবন্ধনের জন্য চারুকলার সেই নিবন্ধন কক্ষটির সামনে উপস্থিত হই। সেই দিনটিতে অফিস কক্ষের পাশে ছিল শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমন্ডলীর কক্ষ ও অফিস কক্ষ। নিবন্ধনের দিনটিতে উপস্থিত প্রাক্তণ শ্রদ্ধেয় বড়ভাই-বোনরা আমাদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় বরণ করে নেয়। এরপর ছবি তোলা, সারিবদ্ধভাবে সবাই নিবন্ধন ফরমটি হাতে নিয়ে ছবিতুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কারফটো বেশী স্পষ্ট হবে, কে সবার সামনে দাড়াবে, কে পিছনে দাঁড়াবে- এই নিয়ে চলতে থাকে হাসা-হাসি ও হইহুল্লা। আমাদের পরে আরো অনেকেই নিবন্ধনের জন্য আসে। সেই একই অবস্থা, কেউ কেউ ব্যাচের সকলকে নিয়ে উপস্থিত হয়। বড় ভাই-বোনদের সাথে এক হয়ে ফটো সেশনে ব্যস্ত মুহুূর্তগুলো স্মৃতি হয়ে থাকবে। এই নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি সহজ করার জন্য অনলাইনেরও ব্যবস্থা করা হয়। যে যার অবস্থান থেকে নিবন্ধন করতে থাকে। স্ব-শরীরে ও অনলাইনে প্রায় ৮,০০০ শিক্ষার্থীর নিবন্ধন করা হয়। প্রথমে কিং অব চিটাগং এ ভ্যানু ঠিক করা হলেও পরে জিইসি কনভেশন নির্ধারণ করা হয়। অনেকে আক্ষেপ করেন, চবি-এর চিরসবুজ পরিবেশে এই আয়োজনটি হলে আরো ভালো হতো। সামনের দিনগুলোতে বিষয়টি বিবেচনায় আনার অনুরোধ রইলো। ২২ নভেম্বর ২০১৯ এলামনাইয়ের দিনটিকে ঘিরে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কমতি ছিল না। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য চবি এর শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন সাংস্কৃতিক চর্চ্চার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। গান-কবিতা আবৃত্তি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। একটি বিশাল পরিবেশে সকলকে নিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন যদিও অনেক কষ্টের ও ধৈর্য্যরে তবুও সবাই একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগের জন্য এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছে। আয়োজকরা তাদের সাধ্যমত অনুষ্ঠান সাজানোর চেষ্টা করেছেন। তবুও যারা এই দায়িত্ব নিয়ে এগোচ্ছে তারা নিজের প্রাণের তাগিদেই এই দায়িত্ব পালন করছে।
উল্লেখ্য যে, ১৯৬৬ সালের ২ নভেম্বর মাত্র ২০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এটি একটি উচ্চশিক্ষা ও উন্নতশিক্ষার আধারে পরিণত হয়েছে। বাংলা, ইংরেজী, ইতিহাস এবং অর্থনীতি বিভাগ নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চলা শুরু হলেও পরবর্তীতে শিক্ষা, চিকিৎসা, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আইন বিভাগ সংযুক্ত করে এর পরিধি বৃদ্ধি করা হয়েছিল। তবে ঐ সময়ে উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ সুবিধার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরে কলেজ পর্যায়ে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করতে হয়েছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগামে অবস্থিত বাংলাদেশের একটি সরকারি বহু অনুষদভিত্তিক গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটাজারী থানার ফতেহপুর ইউনিয়নের ১৭৫৩.৮৮ একর পাহাড়ি ও সমতল ভূমির উপর অবস্থিত। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। এই দেশের তৃতীয় এবং ক্যাম্পাস আয়তনের দিক থেকে দেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে এই বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। সে সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্বাধীনতাপূর্ব প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে যেমন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সক্রিয় ভূমিকা প্রশংসার দাবিদার তেমনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে ২০১৬ সালের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানের সফল আয়োজনে এই শিক্ষার্থীদেরই কার্যকরী পদক্ষেপগুলো উল্লেখযোগ্য। সমগ্র বাংলাদেশের উন্নয়ন ধারায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্ব স্ব অবস্থান থেকে অবদান রেখে চলেছে। উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে এই গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বিশ্ব ইতিহাসে প্রশংসার দাবি রাখে।
এলামনাই এসোসিয়েশনের সাথে জড়িত বড় ভাই ও বোন সত্যিকার অর্থেই অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। সামাজিক যোগাযোগ থেকে জানা যায়, প্রতিজন সদস্য থেকে সংগৃহীত ২০০০/- টাকা পূণর্মিলনী অনষ্ঠানে ব্যয় না করে উক্ত টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখা হবে। পরবর্তী উক্ত টাকা সদস্যদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। ১৭ নভেম্বরের কয়েকটি পত্রিকার তথ্য থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে গঠনমূলক কার্যক্রম ভিত্তিক বৃত্তি প্রদানের লক্ষ্যে কার্যকরী সদস্যবৃন্দের পক্ষ থেকে প্রতি বছর ৩০ লক্ষ টাকার শিক্ষা বৃত্তি গঠনের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়। চবি এর শিক্ষার মান্নোয়নে ও পুরানো ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য এই ধরনের গঠনমূলক সিদ্ধান্ত এলামনাইন এসোসিয়েশনের সফলতা অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এই দিনটিকে ঘিরে প্রাণের উল্লাসে সবাই আনন্দে মাতোয়ারা। সুবর্ণ জয়ন্তীতে যে প্রাণের উৎসব দেখা গিয়েছিল তারই ধারাবাহিকে প্রতি বছর প্রতিটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা কোথাও না কোথাও মিলিত হয়। হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলোকে রোমান্থন করতে করতে আবার সেই সোনালী দিনগুলোতে ফিরে যায়। বিভাগ ভিত্তিক ও ব্যাচের ক্রমানুসারে মিলন মেলায় তাদের সহপাঠিদের কাছে পেয়ে প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগের ও প্রতিটি ব্যাচের সমন্বয়ে আয়োজিত ২২ নভেম্বর ২০১৯ এলামনাই আয়োজনের এই মিলন মেলা মহা-আনন্দ ও মহা-সমারোহের সমাবেশে সকলের মধ্যে বিরাজমান ভ্রাতৃত্ববোধ আরো দৃঢ় হবে। আগামী প্রজন্মের কাছে এই সম্প্রীতির শিক্ষা একটি শ্রেষ্ঠ শিক্ষানীয় উদাহরণ হিসেবে চলার পথে পাথেয় হোক এটায় কাম্য। অনেক ধরণের ত্রুটি থাকতে পারে। অনেক ধরণের অব্যবস্থাপনা থাকতে পারে। ক্ষমা সুন্দর চোখে আপনকে আরো বেশি আপন করে নেওয়ার লক্ষ্যেই হচ্ছে ২২ নভেম্বর এলামনাই, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম পূণর্মিলনী।
লেখক: ২৩তম ব্যাচ, ইংরেজী বিভাগ, চবি
অধ্যাপক ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম।