প্রসঙ্গ : ৯১’-এর ঘূর্ণিঝড়, করোনাকাল এবং মানুষ মানুষের জন্য

63

এমরান চৌধুরী

মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ খুব জনপ্রিয় একটি গান। গানটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এ দেশের গানপ্রিয় ও সচেতন মানুষ খুব ভালোভাবেই জানেন এবং বুঝেন। এই গানটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের মানুষ প্রথম মানুষের জন্যে কাজে নামে ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে। এই গান গেয়ে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে ত্রাণ সংগ্রহে সেদিন রাস্তায় নেমেছিল এদেশের লাখো লাখো জনতা । এই লাখো লাখো জনতার মধ্যে ছিল ছাত্র-ছাত্রী, রাস্তার পথচারী, ফুটপাতের হকার, দিনমজুর, মুদি দোকানদার থেকে শুরু করে সমাজের সব শ্রেণির মানুষ। আর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল স্কুলের শিক্ষার্থী, খেটে খাওয়া মানুষ, রাস্তার ভবঘুরে, ভিক্ষুক এমনকি বাসা-বাড়ির সকল গৃহিণী। সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসে সেদিন দুঃস্থ, নিরন্ন, অসহায়, ঠাঁইহারা এবং মাতৃপিতৃহীন শিশুরা আশার আলো দেখতে পেয়েছিল।
যে কোনো দুর্দিনে, দুর্বিপাকে, প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট দুর্যোগে সৃষ্ট পরিস্থিতি সরকারের একার পক্ষে সামাল দেওয়া মোটের ওপর সম্ভব নয়। এ জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে, দেশের যে কোনো অশুভ সময়ে, মহামারীতে দেশের সর্বশ্রেণির, সর্বপেশার মানুষের অংশগ্রহণ জরুরি ও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার, আহত-আঘাতপ্রাপ্তদের চিকিৎসার আওতায় আনা, নিহতদের দাফনকাফন, পুনর্বাসন কাজে আমরা সরকার, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, ক্লাব, সভাসমিতিসহ তখনকার জননেতা চট্টলবীর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল স্বেচ্ছাসেবীকে নিরলস, নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে এগিয়ে আসতে দেখেছি। এই জননেতা সেই দুঃসময়ের দিনগুলোতে নিজের কাঁধে করে লাশ বহন করেছেন। কখনো একাই নিজের হাতে মরদেহের গোসল দিয়েছেন। দাফন ও সৎকারে অংশ নিয়েছেন। যে কোনো মহৎ উদ্যোগের পেছনে থাকতে হয় কারও না কারও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাহসী হাত। যে হাতের রোশনাইতে অন্যরা আলোকিত হয়, কাজে প্রাণিত হয় আর এগিয়ে আসে শত শত মানুষ। সেদিন তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে বিপন্ন মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চট্টগ্রামের মানুষ নিশঙ্ক, নির্ভীকচিত্তে। এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের তেমন একজন মানুষ। তাঁর আজন্ম আরাধ্য ছিল মানুষের সেবা। আমৃত্যু তিনি তাই করে গেছেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর প্রথম ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এদেশের মিডিয়া জগতে আসে বিস্ময়কর পরিবর্তন। বাংলাদেশের ইতিহাসে আবির্ভাব ঘটে সরকারি টেলিভিশনের পাশাপাশি প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন একুশে টেলিভিশন ( ঊঞঠ). পরিবর্তনে অঙ্গীকারাবদ্ধ এই সেøাগানকে সামনে নিয়ে ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে এই চ্যানেলটি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মতো এটিও ছিল প্রথম টেরিস্টোরিয়াল পদ্ধতিতে সারাদেশে স¤প্রচারিত টেলিভিশন। সে সময় একুশে টেলিভিশনে প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং। বার্তা প্রধান ও পরিচালক ছিলেন মুশিক মুনীর। এক ঝাঁক ডাকসাইটে সাংবাদিক ও সংস্কৃতিমনা মানুষ। যোগ দিয়েছিলেন আবেদ খানের মতো প্রতিতযশা সাংবাদিক, শামসুদ্দিন হায়দার ডালিমের মতো হ্যান্ডাম উপস্থাপক, যোগ দিয়েছিলেন জ ই মামুন, মুন্নিসাহা, সামিয়া জামান, সামিয়া রহমান, শাকিল আহমদের মতো অসংখ্য সৃজনশীল টিভি সাংবাদিক। এই চ্যানেলটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল সংবাদ উপস্থাপনা। একমাত্র সংবাদের কারণেই চ্যানেলটি রাতারাতি আটষট্টি হাজার গ্রামে পৌঁছে যায়। শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম, সামিয়া জামান বা সামিয়া রহমান যখন সংবাদের ঝাঁপি নিয়ে উপস্থিত হতেন তখন দর্শকের চোখ ইটিভির পর্দা থেকে একবিন্দুও নড়ত না। সংবাদ পরিবেশনায় নতুনত্ব ও অভিনবত্বের কারণে একুশে টেলিভিশন সবার কাছে আদৃত হয়েছিল।
একুশে টেলিভিশনের একটি সচিত্র প্রতিবেদন সে সময় বাংলাদেশ ছাপিয়ে সারা পৃথিবীর সকল মানবিক মানুষকে নাড়া দিয়েছিল। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন সাংবাদিক মুন্নি সাহা। ওয়াইল্ড পোলিও ভাইরাসে (দুরারোগ্য একটি রোগ) আক্রান্ত একটি শিশুকে বাঁচাতে প্রয়োজন পড়ে প্রায় কোটি টাকার। কিন্তু তার অসহায় পরিবারের পক্ষে কোটি টাকা দূরের কথা,হাজার টাকা যোগান দেওয়াও সম্ভব ছিল না।প্রতিবেদনটির এক একটি বাক্য, এক একটি কথা তীরের ফলার মতো প্রত্যেক মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। টাকার অংকের কথা শুনে তার স্নেহপরায়ণ পিতার যখন হাত পা অবশ হয়ে আসছিল তখন এই অবোধ শিশু ‘আবিদ ‘বাংলার মানুষের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রেখে পরম আত্মবিশ্বাসে বলেছিল, বাবা! তুমি কোনো চিন্তা করো না, এদেশের মানুষ একটি করে টাকা দিলে ১২ কোটির ওপর টাকা উঠবে, যা দিয়ে আমার চিকিৎসা হবে।’ আবিদের বুকে একটি যন্ত্র প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন ছিল, ঐ সময় যার মূল্য ছিল ৮০ লক্ষ টাকা এবং তা একমাত্র আমেরিকায় পাওয়া যেত। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আবিদ যখন একুশে টেলিভিশনের প্রতিবেদক মুন্নি সাহার কাছে এসব কথা বলছিল তখন হাজারো বাঙালির চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। আবিদের আহবানে তড়িৎ সাড়া পড়ে বিপুল মানুষের। মাত্র কয়েকদিনে আবিদের সহায়তা তহবিলে জমা পড়ে কোটি টাকার ওপর। মানুষ মানুষের জন্য কী করতে পারে এরচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে? একুশে টেলিভিশন আজ আগের অবস্থায় না থাকলেও এই টেলিভিশনের ঐ প্রতিবেদন আজও বিপন্ন মানুষের সেবায় এগিয়ে আসতে বিপুলভাবে অনুপ্রেরণা যোগায়।
বর্তমান করোনাকাল শুরু হওয়ার পর থেকে এদেশের কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী, সাধারণ মানবিক মানুষ, ছাত্র-যুবা যেভাবে এগিয়ে এসেছেন করোনা আক্রান্ত, করোনার ফ্রণ্ট লাইনযোদ্ধাদের তা এক কথায় অতুলনীয়। করোনাকালে আমাদের সমাজে যে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছিল তা অত্যন্ত অমানবিক। আপন ছেলেমেয়েরা বাপ- মায়ের লাশ হাসপাতালে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল। করোনা সন্দেহে গর্ভধারিণী মা-কে জঙ্গলে ফেলে দিয়েছিল নিজের সন্তান। নিজের স্ত্রী অসুস্থ স্বামীকে ফেলে চলে গিয়েছিল বাপের বাড়িতে। করোনা ডেটিকেটেড হাসপাতালে চাকুরি করে এই কারণে অনেক চিকিৎসক, সেবিকা ও স্বাস্থ্যকর্মীকে নানাভাবে নাজেহাল হতে হয়েছিল। অনেক বাড়িওয়ালা চিকিৎসাকর্মীদের বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার মতো চরম হুমকিও দিয়েছিল। এমনকি লাশের গোসল, দাফনকাফন ও সৎকারে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না মৃত মানুষের সন্তানদের। এই যখন অবস্থা তখন এগিয়ে আসে জীবনবাজি রাখা কিছু ব্যক্তি এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্যে এই অপার, অতুল বাক্যের মর্ম-আহবানে সাড়া দেয় অনেক অনেক সংগঠন। করোনাকালে এসব ব্যক্তি সংগঠন যদি মানবতার চরম বিপর্যস্ত সময়ে সর্বাত্মক হাত বাড়িয়ে না দিতেন তাহলে হাসপাতালের মর্গ ভরে ওঠত লাশে আর লাশে। হয়তো রাস্তাঘাটেও পড়ে থাকত লাশ। আর মানুষ পেত না কোটি টাকার সম্পদ রেখে যাওয়ার পরও মৃত্যুর সময় এক গ্যাস পানি।
এখনও সমাজে চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো মানুষ আছে। মুন্নি সাহার মতো জীবনঘনিষ্ঠ সাংবাদিক আছে। যাঁদের কারণে মানবতা, মানবিকতা নীরবে নিভৃতে কাঁদতে কাঁদতে আবার নতুনভাবে প্রাণ পায়। ফিরে আসে চট্টলবীর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বার বার। নারায়ণগঞ্জের পৌর কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার করোনাকালে করোনাক্রান্ত মানুষের পাশে থেকে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা শুধু অনুকরণীয়ই নয় একটি অনন্য কাজের দৃষ্টান্ত হয়ে এলাকার মানুষকে যুগে যুগে অনুপ্রেরণা যোগাবে। এই মানুষটি একাই নারায়ণগঞ্জে জাতিধর্মনির্বিশেষে প্রায় একশ এর কাছাকাছি মানুষের দাফনকাফন ও সৎকারে অংশ নিয়েছেন। দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে যে সকল সংগঠন নিজেদের জীবনের প্রতি কোনো রকম তোয়াক্কা না করে লাশের শেষক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চট্টগ্রামের গাউসিয়া কমিটি, আল মানাহিল ফাউন্ডেশন, ঢাকার আল মারকাজুল ইসলাম, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, রহমতে আলম সমাজকল্যাণ সংস্থা ও আল রশীদ। এসব সংগঠনকে জানাই প্রাণখোলা অভিনন্দন। এছাড়া দেশের আনাচে কানাচে অসংখ্য ব্যক্তি, এমনকি মহিলারাও এগিয়ে এসেছিলেন মানবতার জয়গানে সামিল হতে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি অকৃতজ্ঞ মানুষ চিরকালই অকৃতজ্ঞ থেকে যাবে। তারা ফকিন্নির থালা পর্যন্ত কেড়ে নিতে দ্বিধা করবে না। কিন্তু সমাজে এখনও কৃতজ্ঞ ও মানবিক মানুষের সংখ্যা বেশি। তাঁরা বরাবরই এগিয়ে আসবে বিপন্ন মানবতার সেবায়, তাঁদের কণ্ঠে বার বার ধ্বনিত হোক ভূপেন হাজারিকার ওই কালজয়ী গান…
মানুষ মানুষের জন্য,
জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি
কি মানুষ পেতে পারে না?
ও বন্ধু –
মানুষ মানুষের জন্য।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক